কার্টুন: এস এম রাকিবুর রহমান
কার্টুন: এস এম রাকিবুর রহমান

নাটক কম করো পিও

তিতুনকে নিয়ে হয়েছে মহাযন্ত্রণা। বয়স এখনো তিন হয়নি। চটাং চটাং কথা বলে।

কোথা থেকে কে জানে, নতুন একটা বাক্য শিখেছে। যখন-তখন বলে ওঠে, ‘নাটক কম করো পিও।’

এই বয়সে বাচ্চারা যা বলে, তা-ই শুনতে মজা লাগে। কিন্তু মুশকিল হলো, ওর টাইমিং খুবই দুর্দান্ত।

দুপুরে যেমন তিশা ওকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল। এক প্লেট ভাত মাখিয়ে বসেছে। সঙ্গে নিয়েছে তিতুনের খেলনা ডাইনোসরটা। তিশা বলছিল, ‘এখন তিতুন সোনা কী করবে? খাইদাই খেলবে। কে কে খেলবে? মামণি খেলবে, ডাইনো খেলবে, তিতুন খেলবে।’

প্রথমে তিশা নিজে এক লোকমা খাওয়ার ভান করে। ডাইনোসরকেও মিথ্যামিথ্যি একটা লোকমা তুলে দেয়। তারপর তিতুনের মুখের কাছে ভাত নিয়ে বলে, ‘ডাইনোটা তো খেয়ে খুব মজা পেয়েছে। সব খেয়ে ফেলতে চাচ্ছে। কিন্তু ডাইনোকে আমরা দিব না। আমরা দিব তিতুনকে। তিতুন হাঁ করো। হাঁ করো দেখি।’

তিতুন হাঁ করল বটে। তবে খাওয়ার জন্য নয়। ফট করে বলে বসল, ‘নাটক কম করো পিও।’

ভাতটা মিথ্যামিথ্যি খেলেও, থতমতটা তিশা সত্যিই খেল। এইটুকুন ছেলে বাক্যের সঠিক ব্যবহার শিখল কী করে!

তিশার অবস্থা দেখে আমার মায়া হলো খুব। ডাকলাম বানুকে। বললাম, ‘বানু! তিতুন এসব আজেবাজে কথা কোথা থেকে শিখছে? তুমি শেখাচ্ছ না তো?’

‘এই যে খালু একটা ফাউল টক করলেন।’ ময়লা ঝাড়ুটা ডাইনিংটেবিলের ওপর রেখে বানু কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। ‘আমি তিতুনরে বাজে কথা শিখাই?’

‘আহা…তুমি ইচ্ছে করে শেখাও না, বুঝলাম। কিন্তু বিকেল বেলা তুমি যে ওকে নিয়ে বসে বসে মোবাইলে টিকটক দেখো, এটা কি ঠিক? বাচ্চা মানুষ, কী দেখে কী শিখবে…’

‘আর আপনে যে রাইতে বইসা টিভিতে টক শো দেখেন? টক শোতেও তো স্যুট-কোট পিন্দা মানুষ আজেবাজে কথা কয়, সেইটা তো কইলেন না।’

এবার থতমত খাই আমিও।

দেখলাম বানুর সঙ্গে কথায় পারা যাবে না। নিজের জ্ঞানবুদ্ধির কাছাকাছি লেভেলের কাউকে ধরার চেষ্টা করলাম। তিতুনকে বললাম, ‘তিতুন বাবা, তোমাকে “নাটক কম করো পিও” কে শিখিয়েছে?’

‘মুবাইল।’

‘কথাটা তো পিও না বাবা। প্রিয়। বলো প্রিয়।’

‘পিও।’

‘পিও না। প্রিয়।’

‘পিও।’

‘নাটক কম করো প্রিয়।’

‘নাটক কম করো পিও।’

আমার কেন যেন জেদ চেপে গেল। একটা ভুল শব্দ ও কেন শিখবে? বারবার একই কথা বলতেই থাকলাম। তিতুন ভাবল, এটা একটা খেলা। খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল। আমি যতবারই বলি, ‘নাটক কম করো প্রিয়।’ ও বলে, ‘নাটক কম করো পিও।’ এভাবে চলল অনেকক্ষণ। শেষ পর্যন্ত আমি হার মানলাম।

রাতে যখন ঘুমাতে গেছি, তখনো দেখি মাথার ভেতর একই বাক্য ভাঙা টেপ রেকর্ডারের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। নাহ, ঘুম হলো না।

পরদিন ঘুম ঘুম চোখে অফিসে গেছি। গিয়েই শুনি এমডি স্যার ডেকেছেন। জরুরি মিটিং।

মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। আমি টেবিলে নাক গুঁজে কাজ করা লোক। মিটিংটিটিং একদমই ভালো লাগে না। মিটিং মানেই বকবক। আমার কমিউনিকেশন বড় দুর্বল। মিটিংয়ে বেশির ভাগ কথাই বলি মনে মনে। মুখে বলতে পারি না, বলতে চাইও না।

যা হোক। মিটিংয়ের শুরুতেই এমডি স্যার কোম্পানির লসের বিশাল ফিরিস্তি দিলেন, যেমনটা সব সময়ই দেন। এত লস সত্ত্বেও তিনি কীভাবে আমাদের দেখেশুনে রেখেছেন, তার অসীম দয়ায় কীভাবে আমাদের চাকরিটা এখনো টিকে আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষেও বললেন সেই একই কথা, যা সব সময় বলেন। ‘অফিস হলেও, আমরা সবাই একটা পরিবার। আমাদের রাত-দিন পরিশ্রম করতে হবে। বেতনের কথা মাথায় আনা যাবে না। শুধু কাজ করে যেতে হবে। কাজ আর কাজ…’

আর কী কী বললেন, শুনতে পাইনি। ঘুমে চোখ বুজে এসেছিল। চোখ মেলেই দেখি স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখ বড় বড়। চোয়াল ঝুলে পড়েছে। কলিগরাও সব তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অল আইজ অন মি। সবার চেহারায় কেমন হতভম্ব ভাব।

এমডি স্যার রীতিমতো চিৎকার করে উঠলেন, ‘হোয়াট! কী বললেন আপনি? কী বললেন!’

আঁতকে উঠলাম। ‘নাটক কম করো পিও’ তো মনে মনে বলছিলাম। মনের কথাই কি মুখে এসে গেল!