ইতিহাসের এই দিনে

রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ পেত্রোভনার জন্ম

এলিজাবেথ পেত্রোভনা (১৭০৯–১৭৬২)
ছবি:  উইকিমিডিয়া কমনস

এলিজাবেথ পেত্রোভনা ছিলেন রাশিয়ার বিখ্যাত সম্রাজ্ঞী। দুই দশকের রাজত্বকালে কাউকে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়া, অসংখ্য নির্মাণ প্রকল্প এবং শিল্প, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাশিয়াকে উন্নতির শীর্ষবিন্দুতে নিয়ে যাওয়ার কারণে তাঁকে রাশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্রাটদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এলিজাবেথের জন্ম ১৭০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর, রাশিয়ার মস্কোর নিকটবর্তী কোলোমেনস্কয় নামক এক স্থানে। তিনি ছিলেন রাশিয়ার সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট এবং সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিনের কন্যা। ছোটবেলা থেকেই এলিজাবেথ ছিলেন প্রাণবন্ত ও মেধাবী। পাঠ নিয়েছিলেন গণিত, শিল্প, ভাষা, খেলাধুলা ও নৃত্যে। অল্প দিনেই পারদর্শী হয়ে ওঠেন ইতালীয়, জার্মান ও ফরাসি ভাষায়। স্থাপত্যের প্রতিও ছিল তাঁর প্রবল ঝোঁক।

বিয়ের বয়সে পৌঁছানোর পর তাঁর বাবা ইউরোপের রাজকীয় পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্য প্রচেষ্টা চালান। বাবার মৃত্যুর পর রাশিয়ায় আশ্রয় নেওয়া উত্তর জার্মানের ক্ষুদ্র রাজ্য হলস্টেইন-গটর্পের রাজকুমার চার্লস অগাস্টাসের সঙ্গে তাঁর বাগদান হয়। এরপর অল্প দিনের জন্য সম্রাজ্ঞী হওয়া তাঁর মা ক্যাথরিন মারা যান। এর কিছুদিন পর মারা যান তাঁর বাগদত্ত রাজকুমারও। এরপর তিনি অনেকটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন এবং সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে দূরে মায়ের দেওয়া একটা ছোট প্রাসাদে নিভৃত জীবনযাপন করেন।

বাবা পিটার দ্য গ্রেট জীবিত থাকা অবস্থায় ১৭১৮ সালে এলিজাবেথের সৎভাই আলেক্সি মৃত্যুবরণ করেন। তখন সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে অনেক জল্পনার সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে ১৭২৫ সালে পিটার দ্য গ্রেট মারা গেলে তাঁর মা ক্যাথরিন সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৭২৭ সালে সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন মারা গেলে এলিজাবেথের কিশোর ভাতিজা দ্বিতীয় পিটারের রাজ্যাভিষেক হয়। তাঁর মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করেন এলিজাবেথের চাচাতো বোন আনা। আনার ভাতিজা ষষ্ঠ ইভানের সংক্ষিপ্ত শাসনামলে ১৭৪১ সালে একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এলিজাবেথ রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী হন।

এলিজাবেথকে সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় আনতে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে সাম্রাজ্যের রাজকীয় রক্ষী বাহিনী। রাজকীয় রক্ষী বাহিনী ছিল সাম্রাজ্যের অন্যতম শক্তিশালী একটি বাহিনী। রাজকীয় রক্ষী বাহিনী পিটার দ্য গ্রেটের কন্যা হিসেবে এলিজাবেথের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তারা বিশ্বাস করত যে তিনি তাঁর মহান বাবার আদর্শে সাম্রাজ্য পরিচালনা করবেন এবং রাশিয়ার সাম্রাজ্যকে বিদেশি আধিপত্য থেকে রক্ষা করবেন। তা ছাড়া ফরাসি এবং সুইডিশ রাষ্ট্রদূত এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাজকীয় রক্ষী বাহিনী শীতকালীন প্রাসাদে গিয়ে সহজেই শিশুসম্রাট ইভান ও তাঁর মাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর সেন্ট পিটার্সবার্গের সব নাগরিক ও ধর্মগুরুদের ডেকে এনে এলিজাবেথকে রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মস্কোয় সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানটি একটি অভূতপূর্ব ঐশ্বর্য প্রদর্শন করেছিল। আতশবাজির প্রতি সম্রাজ্ঞীর বিশেষ অনুরাগ থাকায় অনুষ্ঠানটি আতশবাজির আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল।

সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ পরবর্তী ২০ বছর রাশিয়ার সাম্রাজ্য শাসন করেন। তিনি ক্ষমতায় এসে বাবা পিটার দ্য গ্রেটের নীতি ও আদর্শে সাম্রাজ্য পরিচালনার কথা ঘোষণা করেন। তা ছাড়া তিনি কোনো মৃত্যুদণ্ডে স্বাক্ষর না করার প্রতিজ্ঞা করেন। মৃত্যুদণ্ড বিলোপের বিষয়টি তাঁর পূর্বসূরি শাসকদের থেকে তাঁকে বিশেষ মর্যাদা দেয়। তিনি সাম্রাজ্যের প্রশাসনে তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত সিনেট ও সাম্রাজ্যের মন্ত্রকের প্রাথমিক রূপ হিসেবে খ্যাত ‘কলেজ’গুলোকে আবার শক্তিশালী করেন এবং মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত করেন।

তাঁর শাসনামলে রাশিয়ার শিল্প ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রভূত উন্নতি লাভ করে। তিনি রাশিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ‘মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং সেন্ট পিটার্সবার্গে ‘একাডেমি অব আর্টস’ প্রতিষ্ঠা করেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উৎসাহ দেন এলিজাবেথ। তাঁর আমলে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়। বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ শুল্কসহ অনেক শুল্ক বিলুপ্ত করে রাজস্ব ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার করেন তিনি। ফলে সাম্রাজ্যের কোষাগার সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। যদিও তাঁর শাসনের শেষের দিকে প্রুশিয়ার সঙ্গে সাত বছরের যুদ্ধ কোষাগারের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। রুশ সৈন্যরা প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে জয়ী হয় এবং সংক্ষিপ্তভাবে বার্লিন দখল করতে সক্ষম হয়।

সাম্রাজ্য পরিচালনার পাশাপাশি আমোদ-প্রমোদ ও বিলাসিতায় অনেকটা সময় ব্যয় করতেন এলিজাবেথ। কথিত আছে, তিনি একই পোশাক দুবার পরতেন না এবং দিনে ছয়বার পোশাক পরিবর্তন করতেন। তাঁর সংগ্রহে ১৫ হাজার পোশাক ও কয়েক হাজার জুতা ছিল। বাগদান ভেঙে যাওয়ার পর তিনি একজন সুদর্শন ইউক্রেনীয় গায়ককে গোপনে বিয়ে করেন। তবে তাঁর স্বামী কখনো সাম্রাজ্যের বিষয়ে আগ্রহ দেখাননি।

১৭৫০-এর দশকের শেষের দিকে সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে এবং ১৭৬১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। তাঁকে সেন্ট পিটার্সবার্গের পিটার অ্যান্ড পল দুর্গের ক্যাথেড্রালে তাঁর মা-বাবার সমাধির পাশে সমাহিত করা হয়।