কথাcom

পিটাই, কিন্তু ক্রেডিট পাই না

প্রথম আলোয় প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে বিশেষ ক্রোড়পত্র, কথাcom। আপনার লেখা রম্য রচনা, আপনার তোলা মজার কোনো ছবি, এমনকি আইডিয়াও পাঠাতে পারেন কথাcom-এ। ঠিকানা: kothacom@prothomalo.com

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

‘এই যে, দৌড়াইয়া গিয়া ফ্লাইং কিক মারলাম, ওইটাই আমি।’ বললেন মন্টু ভাই। তাঁর হাতে রাখা আইফোনে ভিডিও চলছে। হেলমেটধারী একজন লোক বেদম পেটাচ্ছে শার্ট-প্যান্ট পরা এক লোককে। মন্টু ভাই দাবি করছেন, হেলমেট পরা লোকটাই তিনি।

‘এটা আপনি?’ আমার কণ্ঠে অবিশ্বাস। ‘হ ব্যাটা। আমি ছাড়া এই রকম কিক আর কে দিব? দেখ, দেখ, লাত্থি খাইয়া উপুড় হইয়া পইড়া গেছে ব্যাটা। হে হে।’ একটা লোক লাথি খেয়ে পড়ে গেছে, আর মন্টু ভাই হাসছেন। উনি আমাদের এলাকার বড় ভাই। থাকে না কিছু বড় ভাই, যাঁদের আপনি স্বাভাবিক সময়ে খুঁজেই পাবেন না। কিন্তু কোথাও গ্যাঞ্জাম, মারামারি হলেই দেখবেন, সবার আগে সেই বড় ভাই। ‘কিরে, কী সমস্যা, দেখি’ বলে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাওয়া এসব বড় ভাইয়ের প্রথম লক্ষ্য, যেকোনো একজনের গাল চিহ্নিত করে চড়-থাপ্পড় মেরে দেওয়া। কারণ তো পরেও জানা যাবে, আগে হাতের কাজটা সেরে ফেলা দরকার। মন্টু ভাই সে রকমই একজন বড় ভাই। ‘আপনাকে তো চেনাই যাচ্ছে না।’ মোবাইলটা মন্টু ভাইয়ের হাতে দিয়ে বললাম আমি।

‘কী কস?’

‘হ্যাঁ, মাথায় তো হেলমেট। কেমনে বুঝব যে এটাই আপনি?’

‘ফিগার দেইখা বুঝোস না? এই রকম ফিগার আছে নাকি আশপাশে?’

‘তা ঠিক। তারপরও, না বললে বুঝতামই না এটা আপনি। ভালো মাইর দিসেন ভাই। ফুটওয়ার্ক একদম পারফেক্ট। হ্যান্ড আই কো–অর্ডিনেশনে চাপা বরাবর যে ঘুষিটা মারসেন, একের ঘুষি।’

‘হ।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মন্টু ভাই। ‘সমস্যা কী জানোস, এই মনে কর, আমি তো রেগুলার পাবলিকরে পিটাই, কিন্তু ক্রেডিটটা পাই না।’

‘কী রকম?’

‘মিছিলে পিটাই। মিটিংয়ে পিটাই। কেউ আন্দোলন করতে রাস্তায় নামলে অগোরে দেই মাইর। মাঝে মাঝে হোম ডেলিভারিও দেই। মানে, বাসায় গিয়া মাইরা আসি। মাইরটা আমি ভালো পারি। আমার মাইর যে একবার খায়, মনে রাখে আজীবন। কিন্তু এত যে মাইর মারি, সেই হিসাবে ক্রেডিটটা ঠিকমতো পাই না। যেমন, কালকের মাইরটা। ১০ মিলিয়ন লোক দেখসে আমার মাইরের ভিডিও। কিন্তু আমি ফুটেজ পাইলাম না। আমারে কেউ চিনে? চিনে না। না চিনলে লোকজন ডরাইব? তুই ক। রাস্তায় আমারে দেখলে ভয়ে চাইপা খাড়াইব? এই রেসপেক্ট যদি না পাই, তাইলে মাইরা কী লাভ?’

‘কথা তো ঠিক। সহমত। কিন্তু ভাই, আপনি যে এত মারেন, আপনার খারাপ লাগে না? নিরীহ লোকজন আপনার হাতে মাইর খাইতেসে, ব্যথায় চিল্লাইতেসে, মায়া লাগে না?’

‘আরে এডি সব নাটক। সবডি শয়তান। ওরা যদি এতই ভালো হইত, তাইলে রাস্তায় নামত? জানে না, এইটা আমার এলাকা? আর মাইরের দরকার আছে। তুই চা খাবি? না ঘুষা খাবি চাপা বরাবর?’

‘চা খাব ভাই।’

‘তাইলে এইসব নিয়া কথা কবি না।’

‘ভাই, খালি একটা কথা বলেন। আপনি তো খালি হাতেও মারেন, লাঠি-রড-হকিস্টিক দিয়াও মারেন। কোনটা বেশি ভালো লাগে আপনার?’

‘ওই রকম চয়েস নাই। যখন যেইটা হাতের কাছে পাই, ওইটাই ইউজ করি, বুঝোস নাই? তয় মনে কর, হকিস্টিকটার আলাদা ব্যাপার আছে। ওইটা দিয়া মাইর শুরু করলে আর থামতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় আরও মারি। ওইটা স্পেশাল কেসে বাইর করি। এমনিতে হাতে লাঠি থাকলে ভালো, হাতটা ময়লা হইল না। আমি আবার মাইর দেওয়ার আগে পরে হাতটা স্যানিটাইজ কইরা ফালাই।’

‘আপনি মহান।’

মন্টু ভাই অস্থিরভাবে পায়চারি করলেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার বসে বললেন, ‘ভাবসি পার্টিতে ঢুইকা যামু।’

‘কেন?’

‘ফ্রিলান্সিং আর কত? পার্মানেন্ট দরকার। এখন তো মনে কর কন্ট্রাকে মারি। নেতারা হাজার পাঁচ শ ট্যাকা দিয়া কয়, অমুকরে মাইরা আসো, গিয়া মাইর দিয়া আসি। হাত–পা ভাঙা, কোমর ভাঙা, সবডির আলাদা আলাদা রেট। তয় ট্যাকাপয়সা আমার কাছে বিষয় না। আমি চাই স্বীকৃতি। ওইটা কন্ট্রাকে নাই। তুই আমার কাছের ছোট ভাই, ভিডিও দেইখা তুই-ই চিনতে পারলি না। পার্টিতে থাকলে লোকে চিনব। নাম জানব। ভয় পাইব আমারে। এটাই তো আমি চাই। আর সামনে কল্যাণ সমিতির নির্বাচন, কাজও পামু ভরপুর।’

‘খুবই ভালো আইডিয়া।’

‘তাইলে এটাই করি, কী কস তুই? অফার আছে।’

‘করেন ভাই।’

বেশ কিছুদিন দেখা হয়নি মন্টু ভাইয়ের সঙ্গে। আজ চায়ের দোকানে আসতেই দেখি লোকজনের জটলা। দোকানদার রিপন চা দিয়ে বলল, ‘মন্টু ভাই তো ভাইরাল। কড়া মাইর দিসে এক প্রার্থীরে।’

‘বলেন কী!’ চমকে উঠলাম। মনে পড়ল, কল্যাণ সমিতির নির্বাচন চলছে। আমিও সমিতির সদস্য, তবে সকালে ঘুম থেকে উঠতে না পারায় ভোট দেওয়া হয় নাই। রিপনের মোাবাইলে দেখলাম, এক প্রার্থীকে ঘুষি মেরে পেছন থেকে ফ্লাইং কিক দিচ্ছেন মন্টু ভাই। এবার মাথায় হেলমেট নাই। আশপাশের মানুষ ভিডিও করছে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে। মন্টু ভাইয়ের ইচ্ছা তাহলে পূরণ হবে। যে স্বীকৃতি তিনি চেয়েছিলেন, পেয়ে গেছেন ইতিমধ্যেই। লোকে বলবে, ওই দেখ, কিক মন্টু যায়। মার খাওয়া লোকটার জন্য আমার মায়া হলো। কিন্তু মায়া হলে চলবে না, মন্টু ভাইয়ের কিক, প্রশংসা না করলে আমিও তো কিক খাব।

দুদিন পর চায়ের দোকানে গিয়ে দেখি মন খারাপ করে বসে আছেন মন্টু ভাই। আমাকে দেখেই বললেন, ‘চিন্তা কর, অজ্ঞাতনামা পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হইসে। আরে আমি কি অজ্ঞাতনামা? আমার নাম মন্টু। মাইরটা তো আমি দিসি।’

‘আপনার তো খুশি হওয়া উচিত।’ ভয়ে ভয়ে বললাম আমি।

‘আরে রাখ, যে নেতা আমারে অর্ডার দিসে, সে-ই তো এখন আমারে চিনে না।’

‘হায় হায়।’

‘আমি নাকি দুর্বৃত্ত, দুষ্কৃতকারী, হামলাবাজ! আমি নাকি তাগো দলেরই না। পার্টিতে ঢুকলাম ক্যান তাইলে? আমারে চিনে না। অরেই আমি পিটামু এইবার।’

মন্টু ভাইকে উত্তেজিত দেখে সেদিন আর থাকিনি সেখানে। একটু খারাপ লাগছিল, বেচারা মন্টু ভাই এবারও ক্রেডিট পেলেন না। কিন্তু তারপর থেকে অনেক দিন আর মন্টু ভাইকে দেখলাম না। রিপনও নাকি দেখেনি। কে জানে, ভাই মনে হয় অন্য এলাকায় চা খান এখন।