জি না, কোনো টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে নয়। কাছে আসার সত্যিকার সাহসী গল্প প্রতিদিন রচিত হচ্ছে মেট্রোরেলে—উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। বিশেষ করে অফিস টাইম এবং অফিস থেকে ফেরত আসার সময়ে। প্রথম যেদিন সাহসী গল্পের চরিত্র হয়ে উঠলাম, মিরপুর ১১ নম্বর আসতেই আশপাশের প্রচণ্ড চাপে পড়ে আমি আর আরেক আংকেল মোটামুটি মুখোমুখি অবস্থান নিলাম। চাপ বাড়ছে, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি পরস্পরের দিকে। সংঘর্ষের আশঙ্কা এড়াতে আংকেল তার ব্যাগটা পেছন থেকে সামনে আনার চেষ্টা করলেন। ভিড় গলে ব্যাগ সামনে আনতেও তিনি ব্যর্থ। ব্যাগটা যতটুকু পারা যায় টেনে দিলেন। তাতেও খুব একটা লাভ হলো না।
ইতিমধ্যে তার পেট আর আমার পেট একদম মুখোমুখি। দুজনেরই সামান্য ভুঁড়ি থাকায় রক্ষা। নইলে একদম নাকে-নাক, গালে-গাল লেগে যেত। অবস্থা বেগতিক দেখে দুজনই উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। তাতেও কোনো লাভ হলো না। এবার অন্য আরেকজনের ভুঁড়ির সঙ্গে ঠোকাঠুকি হয়ে গেল।
কাছে আসার সাহসী গল্পে আরেক কেলেঙ্কারি আছে। একদিন তীব্র চাপে আমি কোনোমতে খুঁজে কাছাকাছি একটা হাতলে হাত রাখলাম। কিন্তু হাত রেখেই বুঝলাম, সেখানে আগে থেকে আরেকটি হাত রাখা ছিল। আর কে না জানে, দুটি মানুষের দুটি হাত যদি মেট্রোর একই হাতলে রাখা হয়, এর চেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্য আর হতে পারে না।
এই কাছে আসার সত্যিকার সাহসী গল্পের প্রধান সমস্যা হলো মোবাইল। আপনি ফেসবুক চালান কিংবা ইউটিউব অথবা ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং—পুরো বিষয়টা সবার কাছে উন্মুক্ত। সেদিন আমি ফেসবুক স্ক্রল করছিলাম। দেখলাম আমার ঘাড়ের ওপর থেকে একজন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই বললেন, ‘আমার মোবাইলে চার্জ নাই তো, তাই আপনার ফেসবুক দেখতেছি। আন্দোলনের পর থেইকা তো সবার ফেসবুক হোমপেজ একই!’ এই বলে সে একটা ত্যালত্যালে হাসি দিল। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। বললাম, ‘সবার ফেসবুক এক না!’
এই বলে আমার লিস্টের তিনজন অনিন্দ্যসুন্দরীর ছবি দেখিয়ে মনে মনে কলার উঁচু করে বললাম, ‘বললেন সবার ফেসবুক এক। এই তিন সুন্দরী আপনার লিস্টে আছে? বলেন, আছে?’
তিনি কপাল কুঁচকে বললেন, ‘থাকবে না কেন? তবে মনটা খারাপ লাগে।’
‘কেন?’
তিনজনের মধ্যে একজনকে দেখিয়ে বললেন, ‘উনি গত মাসে জার্মানি চলে গেছে। উনার বাসা থেকে চেরি ব্লোসম গাছ দেখা যায়।’
মেজাজ আরও খারাপ করে বললাম, ‘আপনিই তাহলে সেই লোক, যাকে সব মেয়ের ফ্রেন্ডলিস্টে মিউচুয়াল দেখায়?’
লোকটা এবার খানিক রাগ করলেন, ‘থাক ভাই, লাগবে না। দেখার জন্য ফেসবুক কি আর নাই নাকি ট্রেনে!’ এই বলে আমার মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে পাশের মোবাইলের দিকে তাকালেন। সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো মেট্রোরেলে সিনেমা বা ভিডিও দেখা। মাঝেমধ্যে মনে হয় সিনেমা হলে বসে রিলস দেখছি, কারণ সিঙ্গেল স্ক্রিন হলেও দর্শক অনেক। এমনকি মাঝেমধ্যে পাশ থেকে কেউ না কেউ বলে, ‘ভাই, ব্রাইটনেসটা একটু বাড়ায়ে দেন না। পেছন থেকে দেখা যায় না!’
সেদিন দেখলাম দুজন অপরিচিত আমার সামনেই পরিচিত হয়ে গেলেন একজনের মোবাইলে রিল দেখতে গিয়ে।
মোবাইলেরও আগে মেট্রোরেলের প্রধান দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে ব্যাগ। একেকজনের ব্যাগের সাইজ একেকরকম। এই ব্যাগ নিয়েই আবার যাত্রীদের মধ্যে ঝগড়া লাগে। সেদিন মেট্রোতে উঠেছি একটু বড় ব্যাগ নিয়ে। অফিস শেষে বাড়ি চলে যাওয়ার প্ল্যান। ভিড়ের মধ্যে অল্প বয়সী একটা ছেলে নির্মলেন্দু গুণের মতো আমাকে বলল, ‘আপনার ব্যাগটা এত বড় কেন?’
এর মধ্যেও আশার ব্যাপার হচ্ছে, কেউ কেউ ল্যাপটপ খুলে নাকি মেট্রোতেই অফিস করেন! এটা আমি শুনেছি এবং অবাক হয়েছি। এই ভেবে নয় যে তাঁরা ল্যাপটপ খুলে অফিস করেন। বরং তাঁরা ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ কীভাবে বের করেন, সেটা ভেবে। সেদিন তো আমি ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করতে গিয়ে পাশের জনের ব্যাগের চেইন খুলে ফেলেছিলাম। তিনি শুধু গম্ভীর হয়ে বলেছেন, ‘ওটা আমার ব্যাগ!’