রম্য রচনা

রোল নম্বর না থাকলে কার পা ধোয়া পানি খাব?

হুমায়ূন আহমেদ ছোটদের জন্য ‘জাদুকর’ নামে জীবনঘনিষ্ঠ এক বিজ্ঞান কল্পগল্প লিখেছিলেন। গল্পের প্রধান চরিত্র বাবলু অঙ্ক পরীক্ষায় সাড়ে আট পায়। ধীরেন স্যার বাবলুর খাতার ওপর বড় করে লিখে দেন ‘গরু’। কেবল লিখেই ক্ষান্ত হন না, ক্লাসের সবাইকে দেখাতেও বলেন। কী সর্বনাশ! বাবলু ছোট হলেও মানুষ তো (‘বড়’দের অনেকেই তা মানেন কি না সন্দেহ); তাই লজ্জায়–অপমানে বাড়ি না ফিরে সরকারবাড়ির জামগাছের নিচে বসে থাকে। অসম্ভব নির্জন জায়গাটায় ঘুটঘুটে আঁধার নেমে আসে। বাবলুকে ভয় দেখানোর জন্যই হয়তো অসংখ্য ঝিঁঝিপোকা ডাকতে শুরু করে একসঙ্গে। বিলের দিক থেকে শব্দ আসতে থাকে—‘হঅ হঅ’। ডানপাশের ঝোপ কেমন যেন নড়েও ওঠে। বেচারা বাবলু শার্টের লম্বা হাতায় ঘনঘন চোখ মুছতে থাকে।

ওপরের ‘উদ্দীপক’ অনুযায়ী এবার একটা অসৃজনশীল প্রশ্ন করা যাক। স্কুলজীবনে ‘ভালো’ ছাত্র হয়ে থাকলে এই প্রশ্ন আপনার জন্য নয়। প্রশ্নটা তাঁদের কাছে, স্কুলে যাঁদের রোল নম্বর ১ থেকে ১০–এর মধ্যে থাকত না। প্রশ্নটা হলো, বাবলুর মতো আপনিও কি অমন অপমান সয়েছেন? আপনার ‘জায়গায় বসে’ দেওয়া উত্তর আমি শুনতে পাচ্ছি—হ্যাঁ, এমন অপমান বহুবার সইতে হয়েছে। অবশ্যই হয়েছে। কারণ, এটাই ‘সিস্টেম’! এই সিস্টেম মনখারাপের সিস্টেম।

তবে ২৩ নভেম্বর প্রকাশিত এক খবরে মনটা ভালো হয়ে গেছে। খুব যে ভালো, তা নয়; তবে হয়েছে ঠিকই। খবরটা হলো, করোনাভাইরাসের কারণে পরীক্ষা ছাড়াই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকেরা। ফলে সব শিক্ষার্থীই পরীক্ষা ছাড়া ওপরের শ্রেণিতে উঠবে। মন ভালো করা অংশটুকু হলো, ওপরের শ্রেণিতে ওঠার পর তাদের রোল নম্বর আগের ক্লাসের রোল নম্বরই থাকবে।

সোজা বাংলায় বললে, এবার আর রোল নম্বর নিয়ে কলরোল হবে না, মন খারাপ হবে না কারোরই। এবার প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের বাড়িতে ফিরে কিংবা বাড়ি ফিরতি পথে মা–বাবার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে না যে কেন তাদের রোল নম্বর এগোল না। কিংবা কেন তাদের রোল নম্বর অমুকের মেয়ে বা ছেলের চেয়ে বেশি হলো। কিংবা শুনতে হবে না—অমুকের মেয়ে বা ছেলে তো তোর মতোই ভাত খায়, তাহলে কেন তোর রোল নম্বর পেছনে?

সাবেক সহকর্মী জাহিদুল ইসলাম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘“ওর রোল নম্বর ১ হয়ে গেল! আর তুই কী করলি? ওর পা ধুয়ে পানি খা।”—এই কথাটাই তো মরে যেতে বসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, প্রাথমিকে কারও রোল নম্বর আর পাল্টাবে না; সবাই একই রোল নম্বর নিয়ে পরের ক্লাসে উঠবে।’

অমুকের পা ধোয়া পানির প্রতীকি ছবি

করোনাভাইরাস কত কিছুই তো ওলটপালট করে দিয়ে গেল। অধিকাংশই নেতিবাচক ওলটপালট; তবে এই খবরটা এককালীন হলেও ইতিবাচক ওলটপালটের মধ্যেই পড়ে। সিদ্ধান্তটা বহু বর্ষজীবী হলে তো হুমায়ূন আহমেদের বাবলুর মতো লাখো বাবলু বেঁচে যেত। সত্যিই বেঁচে যেত। কারণ, অন্যের সঙ্গে তুলনা করার এই চর্চা ভয়ংকর ব্যাধির মতোই। ২০১৭ সালে প্রথম আলোতে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল ‘কেন তুমি ওর চেয়ে কম পেলে?’ শিরোনামে একটি ফিচার লিখেছিলেন। তাতে বলেছিলেন—

ফল প্রকাশের পর এভাবে অন্যের সঙ্গে তুলনা করতে থাকলে শিশুর বিকাশের প্রতিটি ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুর মানসিক বিকাশের যে পর্যায়গুলো রয়েছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জ্ঞানীয় বিকাশ বা ধারণার জগতের বিকাশ (কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট) এবং নৈতিকতার বিকাশ (মোরাল ডেভেলপমেন্ট)। আশপাশের মানুষের আচরণ, পরিবার আর সামাজিক অনুষঙ্গ শিশুর এই বিকাশের ধারাকে প্রভাবিত করে। মা-বাবা যখন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিশুকে আরেকজনের সঙ্গে তুলনা করে, তখন শিশুর ধারণা—জগৎটা কেবলই এগিয়ে থাকার, এখানে যেকোনো উপায়েই হোক আরেকজনকে পেছনে ফেলে সামনে যেতে হবে। সহযোগিতামূলক মনোবৃত্তির বদলে তার মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোবৃত্তি জন্ম নেয়। সেভাবে পেছনে থাকা মানেই হেরে যাওয়া, পরাজয়কে মেনে নেওয়ার গুণাবলি সে ধারণ করতে পারে না, তার মধ্যে অস্থিরতা কাজ করে।
আহমেদ হেলাল, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা

অস্থিরতা বড়দের মধ্যেও দেখা দেয়, যখন তারাও বেকায়দামার্কা প্রশ্নের মুখোমুখি হন। ওই যে একটা কৌতুক আছে না—টিপু নামের এক ছেলে পরীক্ষায় খারাপ করেছে। বাবা বাসায় ফিরেই রিপোর্ট কার্ড নিয়ে ফেটে পড়লেন, ‘আমার কলিগ মকবুল সাহেবের ছেলে বল্টু তো তোর সাথেই পড়ে, ওর রোল ৪ হলে তোর রোল ৩৫ হলো কী করে? সমস্যা কী তোর?’ বাপকা ব্যাটা টিপুর পাল্টা প্রশ্ন, ‘আমার ক্লাসফ্রেন্ড বল্টুর বাবা মকবুল আংকেল তো তোমার সাথেই চাকরি করেন, তাঁর প্রমোশন হলে তোমার প্রমোশন হলো না কেন? সমস্যা কী তোমার?’

টিপুর অবস্থা কী হয়েছিল, তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন। শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবুর ‘সংবিধান’ গানের কথাগুলো মনে পড়ে গেল, ‘আমরা শুধু জানতে চেয়েছিলাম, রাষ্ট্রপক্ষ চোখরাঙানি দিলেন...’।

এই চোখরাঙানি কোথায় নেই! এই তুলনা কোথায় নেই! এই রোল নম্বর কোথায় নেই! স্কুলজীবন পেরিয়ে এলেও অদৃশ্য রোল নম্বর আমাদের কপালে খোদাই করা থাকে। অফিসে, বাসায়, পথেঘাটে—সবখানেই রোল নম্বর আমাদের তাড়া করে। রোল নম্বর এক দুঃস্বপ্ন। ‘বড়’রা ওই রোল নম্বর ধরে ধরে আমাদের পিঠে চাপড় দেন নয়তো থাপড় দেন। কারণ, এটাই ‘সিস্টেম’। আহমেদ হেলাল যা বলেছিলেন, তা আবার বলি, ‘মা-বাবা যখন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিশুকে আরেকজনের সঙ্গে তুলনা করে তখন শিশুর ধারণা—জগৎটা কেবলই এগিয়ে থাকার, এখানে যেকোনো উপায়েই হোক আরেকজনকে পেছনে ফেলে সামনে যেতে হবে।’

আজকের শিশু তো আগামী দিনের ‘বস’, কাজেই তিনি যখন রোল নম্বরের চক্করে পড়েছিলেন, তখন বাকি জীবনে বাকিদের ওই চক্করেই তো ঘোরাবেন। তবে গতকালের আরেকটা খবর দেখে আশাবাদী মনটা বলছে, এই চক্কর কিংবা চক্র হয়তো ভাঙবে। খবরে বলা হয়েছে, ‘প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পাল্টে যাচ্ছে শিক্ষাক্রম। বিষয় ও পরীক্ষা কমিয়ে বইয়ে আনা হচ্ছে পরিবর্তন। প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা এক বছরের পরিবর্তে দুই বছর হবে। দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না।’

পরীক্ষা নেই, রোল নম্বর নেই—আহা, ভাবতেই তো ভালো লাগছে। আমরা অন্তত শিশুদের রোবট বানানোর প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসার কথা ভাবছি। বাস্তবে কী হবে না হবে, জানা নেই। আপাতত রোল নম্বরবিহীন একটা বছর যে যাচ্ছে, তা ভেবেই আনন্দ পাওয়া উচিত। তাই এই মুহূর্তে ‘আমার প্লে লিস্ট’ থেকে লাখো নিপীড়িত পেছনের রোল নম্বরওয়ালাদের জন্য প্রিয় ব্যান্ড ওয়ারফেজের একটা গান ‘ডেডিকেট’ করছি—

হে মহারাজ, এসো আমাদের সমতলে

পাবে জীবন, যাকে বহুদূর গেছ ফেলে

প্রাণে জোয়ার আছে জনতার এ ভুবনে

হে মহারাজ...