মলি গিবসনের জন্ম ২০২০ সালের ২৬ অক্টোবর। পৃথিবীতে এসেই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে সে। এক হিসাবে সে তার ২৯ বছর বয়সী মায়ের সমান! কারণ, তার জন্মের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২৭ বছর আগে! মলির ভ্রূণটি সংরক্ষণ করা হয়েছিল ১৯৯২ সালের ১৪ অক্টোবর। দীর্ঘ ২৭ বছর পর, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভ্রূণটি দত্তক নেন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের টিনা ও বেন গিবসন দম্পতি।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেনেসি প্রেস্টন মেডিকেল লাইব্রেরির পরিচালক মার্থা আর্ল নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন, ভ্রূণ থেকে শিশু জন্মবিষয়ক একাধিক মেডিকেল জার্নাল তিনি ঘেঁটেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বক্তব্য, ‘২০ বছরের বেশি সময় ধরে সংরক্ষিত কোনো ভ্রূণ থেকে শিশু জন্মের খবর আমার জানা নেই।’
অর্থাৎ মলিই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করা ভ্রূণ থেকে জন্ম নেওয়া শিশু। এ ক্ষেত্রে মলি অবশ্য জন্মের পরই তার বড় বোন এমার রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছে। কারণ, মলির বড় বোন এমাও পৃথিবীর আলো দেখেছে একই প্রক্রিয়ায়। এমার ভ্রূণটি গবেষণাগারে সংরক্ষিত ছিল ২৪ বছর ধরে!
আরও মজার ব্যাপার হলো, এমাও এক হিসাবে মলির সমান! কারণ, এমা ও মলির ভ্রূণ দান করেছিলেন একই দম্পতি এবং তা একই দিনে—১৯৯২ সালের ১৪ অক্টোবর। তাই সব মিলিয়ে এক অর্থে এমা ও মলি প্রায় তাদের মায়ের বয়সী। ১৯৯২ সালে ওদের মা টিনার বয়স ছিল প্রায় দুই বছর।
মলির জন্মের পরপর তার মা টিনা সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেছিলেন, ‘মনে হয় পৃথিবী জয় করেছি। এখনো দমবন্ধ লাগছে! মাত্র ৫ বছর আগেও যদি কেউ আমাকে বলত আমি একটি নয়, দুটি কন্যাসন্তানের মা হতে যাচ্ছি, আমি তাকে নির্ঘাত পাগল ভাবতাম।’
আর বাবা বেন গিবসন কী বলেন? নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেছিলেন, ‘এই দুজন বাদে আর কোনো সন্তানের কথা ভাবতে পারি না। ওরা শুধু আমাদের জন্যই এসেছে।’
অথচ মা–বাবা হওয়ার সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন টিনা ও গিবসন। সন্তান দত্তক নেওয়ার কথাও ভাবছিলেন দুজনে মিলে। তবে আশার আলো দেখতে শুরু করেছিলেন ২০১৭ সালের একদিন; যেদিন টিনার মা–বাবা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভ্রূণ দত্তক নেওয়ার খবরটি দেখিয়েছিলেন। টিনা বলেন, ‘মা–বাবা যদি সংবাদটি না দেখাতেন, তাহলে কখনো এই অবস্থায় (মা হওয়া) আসতে পারতাম না।’
টিনা গিবসন টেনেসির নক্সভিলের একটা স্কুলে পড়ান, তাঁর স্বামী ৩৬ বছর বয়সী বেন গিবসন সাইবার নিরাপত্তাবিশ্লেষক। এই দম্পতি যোগাযোগ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রূণ সংরক্ষণকারী অলাভজনক সংস্থা ন্যাশনাল এমব্রায়ো ডোনেশন সেন্টারের (এনইডিসি) সঙ্গে। এই সংস্থা থেকে ভ্রূণ দত্তক নিতে পারেন টিনা–গিবসনের মতো দম্পতিরা। এনইডিসির তথ্যমতে, অন্তত ১০ লাখ ভ্রূণ সংরক্ষণ করে সংস্থাটি।
এনইডিসির বিপণন এবং উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মার্ক মিলিঙ্গার বলেন, ‘ভ্রূণ দত্তক নেওয়া অন্তত ৯৫ শতাংশ দম্পতিরই অনুর্বরতার সমস্যা আছে। তাদের সাহায্য করতে পেরে আমরা গর্বিত।’
২০১৭ সালের নভেম্বরে টিনা–গিবসন দম্পতির কোলজুড়ে আসে এমা। আগেই জেনেছেন, জন্মের সময় এমাও সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষিত ভ্রূণ থেকে জন্ম নিয়ে রেকর্ডবইয়ে নাম লিখেয়েছিল। তার ক্ষেত্রে ভ্রূণ সংরক্ষণের সময়টা ছিল ২৪ বছর।
এমা ও মলির জন্মের আগে এত পুরোনো ভ্রূণের কার্যকারিতা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিল। টিনা–গিবসন যখন প্রথমবারের মতো ভ্রূণ দত্তক নিতে যান, তখন মনে মনে প্রমাদই গুনেছিলেন! কারণ, এনইডিসিতে গিয়ে শুনতে পান, ভ্রূণটির (এমার) বয়স ২৪ বছর! এত লম্বা সময় ধরে সংরক্ষণ করা ভ্রূণ কি আদৌ কাজ করবে? টিনা–গিবসনের প্রশ্নে আশ্বস্ত করেছিলেন এনইডিসির প্রেসিডেন্ট এবং মেডিকেল ডিরেক্টর জেফরি কিনান। তিনি বলেছিলেন, ভ্রূণের সংরক্ষণের সময়ের ওপর এর কার্যকারিতা নির্ভর করে না। বুঝতেই পারছেন, কিনানের ওই তথ্য পরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কিনান বলেন, ‘এমা ও মলির জন্ম এটাই প্রমাণ করে যে অনেক “বয়স” হয়ে গেছে, এই যুক্তিতে কোনো ভ্রূণকেই বাতিলের খাতায় ফেলা উচিত নয়।’
এনইডিসির পরীক্ষাগার পরিচালক ক্যারল সমারফেল্ট দিয়েছেন চমকপ্রদ এক তথ্য, ‘ভ্রূণগুলো সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, এই সাফল্য তারই ফল। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভ্রূণকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব।’
এমার জন্মের পর, ২০১৭ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সমারফেল্ট বলেন, ‘মায়ের গর্ভে স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় ৭৫ শতাংশ ভ্রূণই বেঁচে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ২৫-৩০ শতাংশ ভ্রূণ চূড়ান্ত সফলতা লাভ করে।’
এ অর্থে এমা–মলি তো প্রায় তাদের মায়ের বয়সী। এ নিয়ে ওদের মা–বাবার বক্তব্য কী? বিষয়টি তাঁদের কাছে কেমন লাগে? গিবসন বলেন, ‘আমরা তো সব সময় মজা করে বলি, এমা একটা বুড়ো মানুষ! হা হা হা!’
টিনা যে দ্বিতীয়বারের মতো মা হতে চলেছেন, এই সুখবর পাওয়া গিয়েছিল ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারিতে। তখনো করোনাকাল শুরু হয়নি। মলি পৃথিবীতে আসতে আসতে করোনাভাইরাস পুরো পৃথিবীতে ত্রাস সৃষ্টি করে ফেলেছে। ফলে জরাগ্রস্ত পৃথিবীর শত দুঃখকষ্টের মধ্যেও মলির জন্ম আনন্দের এক বিরাট উপলক্ষ হয়ে এসেছিল টিনা ও গিবসনের কাছে। টিনার ভাষায়, ‘নিশ্চিতভাবে মলি ২০২০ সালে আনন্দের এক ছোট্ট ঝলকানি!’
সূত্র: সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস ও এবিসি