পাড়ার মাঠে আমিই ছিলাম সাকিব আল হাসান।
বাঁ হাতে ব্যাট করতাম, বাঁ হাতে বল। বল না ঘুরলেও, ব্যাট দিয়ে ঠাসঠুস মারতে না পারলেও মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম, ক্রিকেটই হবে আমার প্রথম কথা। আর শেষ কথা হবে সাকিব আল হাসান। সবার আগে মাঠে যেতাম আমি, আর ফিরতাম সবার পরে। থার্ডম্যানে ফিল্ডিং করতে চাইত না কেউ, কিন্তু আমি আগ্রহ নিয়ে সেখানে ফিল্ডিং করতাম। কারণ অবশ্য ক্রিকেট নয়। কারণ ছিল পরি। থার্ডম্যান অঞ্চলের পেছনেই পরি তার ঘরের জানালার ওপাশে বসে থাকত। কোলে থাকত বই, চোখে থাকত মায়া।
পরি ছিল পরির মতোই সুন্দর। জানালার আবছায়ায় তার দিকে চোরা চোখে তাকাতে তাকাতে আমার দিকে আসা ক্যাচ ছুটে যেত, মিস হয়ে যেত ফিল্ডিং। অথচ আমি তো ফিল্ডিংই দিচ্ছিলাম, তাই না? আমার পিঠের ওপর পরির নজরের তীক্ষ্ণতা আমি সব সময় বুঝতে পারতাম।
তবে রবিন ভাই সব সময় বলত, আমি নাকি ক্রিকেটের ‘ক’-ও পারি না! ব্যাটিংয়ের শুরুতেই ক্রিজে যেতে চাইতাম আমি। কিন্তু রবিন ভাই শুধু শুধুই আমাকে শেষ দিকে পাঠাত। তার এক কথা, আমি নাকি ভালো খেলি না। কত বড় সাহস! সে আমাকে...ভবিষ্যতের সাকিবকে বলে ভালো খেলে না! সিনিয়র বলে তাকে কিছু বলতাম না। কিন্তু আমাকে সে সব সময়ই ব্যাটিংয়ে পাঠাত শেষের দিকে, নয়ে কি দশে। আর ব্যাটিংয়ে গিয়েই আমার ইচ্ছা হতো একটা ছক্কা মারার। এমন ছক্কা যেন সেটা গিয়ে পড়ে পরিদের বাড়িতে। আর পড়লেই বলটা আনতে যাব আমি। পরি আমাকে বলটা কুড়িয়ে দেবে। আমি পরির হাত থেকে বলটা নেব। নিতে গিয়ে ওর হাতের সঙ্গে আমার হাতটা একটু ছুঁয়ে যাবে! আমি বলব, ‘সরি!’ পরি বলবে, ‘ইটস ওকে। আপনি না দারুণ খেলেন!’ আমি লাজুক মুখে বলব, ‘কী যে বলেন!’ পরি আবার বোঝানোর চেষ্টা করবে, ‘না না, সত্যিই আপনি সাকিব আল হাসানের মতো খেলেন!’
আমি একটু হাসব তখন। আর পরি তার হাতের তালুটা বাড়িয়ে দিয়ে বলবে, ‘একটা অটোগ্রাফ দেবেন?’
আমি চট করে পকেট থেকে কলম বের করে পরির নরম হাতে সই করে দেব। এমন একটা দিনের কথা ভেবে আমি সব সময় পকেটে কলম নিয়ে ঘুরি। কিন্তু এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বোলার বল করে ফেলে, আমি বুঝতে পারি না! বল কোন ফাঁকে এসে আমাকে বোল্ড করে চলে যায়, সেটাও বুঝি না। ওরা হইচই করে, আমি মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়ি। পরির জানালার দিকে তাকাতে পারি না। রবিন ভাই বলেন, ‘এ জন্যই আগে পাঠাই না তোমাকে! আজকেও ডাক মারলা! প্রতিদিন ডাক মারবে আর বলবে, সে নাকি সাকিব আল হাসান! হুহ্!’
আমার ভীষণ রাগ হয়। তখন পরির কথা ভাবি আমি। পরির কথা ভাবলে আমার রাগ ঠান্ডা হয়ে যায়। কিন্তু আমার আবারও রাগ হয়, যখন দেখি রবিন ভাই আমাকে বল করতে দিচ্ছে না। আশ্চর্য! যেন আমি বল করতে জানি না। ঠিক আছে, আমার কোনো কোনো বল পিচ থেকে বেরিয়ে যায়, কিন্তু সেগুলো তো ওয়াইড না। একেবারে ডেড হয়ে যায়। কোনো কোনো বল একটু ফুলটস হয়ে যায়। তাতে কী? পৃথিবীর এমন কোনো বোলার আছে, যার বল ফুলটস হয় না? আমাদের সাকিব আল হাসানের বলও ফুলটস হয়। তাহলে? আমি বল করতে চাইলেই রবিন ভাই বলে, ‘এখন না, এখন না। আরেকটু পরে। এখন তো ব্যাটসম্যানরা মারবে!’
আরে, আমার বল মারতে পারবে নাকি? আমি একটা বল করব, পিচে পড়ে বলটা পরির বেণির মতো ঘুরে যাবে...স্যাঁৎ...ব্যাটসম্যান বোল্ড! আরেকটা ব্যাটসম্যান আসবে, এবার আমার বলটা পরির চাহনির মতো তীব্র হবে...স্যাঁৎ...ব্যাটসম্যান বোল্ড! আরেকটা ব্যাটসম্যান আসবে, এবার বলটা এমন করে দেব...পরীকে দেখলে আমার বুকের রক্ত যেমন ছলকে ওঠে তেমন করে বলটা ছলকে উঠবে ব্যাটসম্যানের সামনে...ব্যস, বোল্ড...! হ্যাটট্রিক! দুই হাত ছাড়িয়ে আমি সাকিব আল হাসানের মতো ছুটে যাব পরির জানালার দিকে। পরি...পরি...পরি!
কিন্তু বল করতে গেলে ঘটনা অন্য রকম হয়ে যায়। একটা বল করি, ব্যাটসম্যানটা এমনই শয়তান, এগিয়ে এসে ধাম করে মেরে দেয়। সোজা ছয়। আর কী নিখুঁত নিশানা! বলটা গিয়ে পড়ে ওই পরিদের বাড়িতেই। আমি ছুটে যেতে চাই বলটা আনতে, অটোগ্রাফ দেওয়ার এই তো সুযোগ! কিন্তু তার আগেই দৌড় দেয় রবিন ভাই। যে লোক ইনজামামের মতো পায়ের কাছে গড়িয়ে আসা বলটা কুড়িয়ে নেয় না, সে রীতিমতো ছুটে যায় পরিদের বাড়িতে বল আনতে। আশ্চর্য, খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার!
কিন্তু আমি সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। মাঠে ক্রিকেট চলে, আমার মন পড়ে থাকে থার্ডম্যানে। আর একদিন সত্যি সত্যি সুযোগটা আসে। হঠাৎ করি শুনি, পেছন থেকে পরি মিহি স্বরে ডাকছে! পরি, আমার পরি! আমি ফিল্ডিং ছেড়ে ছুটে যাই তার জানালায়। পরির হাতে একটা চিরকুট। আমার বুকে ঢিপঢিপ শব্দ। পরি হাত বাড়িয়ে চিরকুটটা দেয়। আমি কাঁপা হাতে চিরকুটটা নিই। আমি উত্তেজিত দৃষ্টিতে তাকাই পরির দিকে। পরি চোখ দিয়ে ইশারা করে রবিন ভাইকে দেখিয়ে দেয়। বুঝিয়ে দেয় এটা আমার জন্য নয়, রবিন ভাইয়ের জন্য। আমি যেন এটা রবিন ভাইকে দিয়ে আসি। আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসে। কিন্তু পরির কথা ফেলিই বা কী করে? মাঠে ফিল্ডিংরত রবিন ভাইকে চিরকুটটা দিই। রবিন ভাই পড়ে। আমি উঁকি মেরে চিরকুটটা পড়ে ফেলি। পরি লিখেছে, ‘রবিন ভাই, আপনার চিঠি পেয়েছি। মোবাইল ফোনের যুগে আপনার সাত পাতার চিঠি পড়ে আমার এত্তগুলা ভাল্লাগছে! আরেকটা কথা...আপনার হাসি কিন্তু একেবারে সাকিব আল হাসানের মতো। আমি কিন্তু সাকিব আল হাসানের ফ্যান...আই লাভ সাকিব আল হাসান...’
তারপর একটা ছোট্ট হার্ট আঁকা। সেটার মাঝ–বরাবর একটা তির চলে গেছে। ছোট্ট তিরটা অবশ্য আমার বুকে বর্শার মতো আঘাত করে গেছে। রবিন ভাই চিরকুট দেখে হাসেন। চট করে পকেটে ঢুকিয়ে নেন। তারপর আমাকে বলেন, ‘কালকে তুমি ওয়ান ডাউনে ব্যাটিং করবা, ঠিক আছে?’
আমি বলি, ‘না, ঠিক নাই। আমি ক্রিকেট থেকে আজকে অবসর নিলাম...’
রবিন ভাই হেসে ওঠেন। তার হাসিটা সত্যিই সাকিব আল হাসানের মতো কি না, তা ভাবতে ভাবতে আমি মাঠ ছাড়ি!