ভারতবর্ষে এক যে ছিলেন সত্যিকারের শার্লক হোমস

আর্থার কোনান ডয়েলের অমর সৃষ্টি ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’–এর প্রথম প্রচ্ছদ
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস, কোলাজ: একটু থামুন

১৮৮৭ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় বিখ্যাত শার্লক হোমস গোয়েন্দা সিরিজের প্রথম বই আ স্টাডি ইন স্কারলেট। এটা তো সবারই জানা, আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা এই বই সে সময় আলোড়ন ফেলে দেয়। একই বছর কলকাতা থেকে বের হয় আরেকটি গোয়েন্দাবিষয়ক বই—এভরি ম্যান হিজ ওন ডিটেকটিভ। এর লেখক রিচার্ড রিড। তিনি লিখেছেন নিজের কথা। আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস চরিত্রটি কাল্পনিক, কিন্তু রিডের চরিত্রগুলো বাস্তব।

রিচার্ড রিডের ‘এভরি ম্যান হিজ ওন ডিটেকটিভ’ বইয়ের প্রচ্ছদ ও ভেতরের দুই পৃষ্ঠা

সে সময় রিড ছিলেন কলকাতা পুলিশের ইন্সপেক্টর। অপরাধ-রহস্য সমাধানে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। অপরাধ তদন্তের মাঠে নিজের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতাই তিনি তুলে ধরেন এভরি ম্যান হিজ ওন ডিটেকটিভ বইয়ে। বইটি বের করেছিল কলকাতার ডব্লিউ নিউম্যান অ্যান্ড কোম্পানি।

১৮৬৮ সালের ১ এপ্রিল সামনে আসে এক চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড। কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে পড়ে থাকতে দেখা যায় এক বিদেশি নারীর রক্তাক্ত মরদেহ। তাঁকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। পাশে পড়ে ছিল হত্যায় ব্যবহৃত ছুরি। কোনোভাবেই এ হত্যাকাণ্ডের কিনারা করতে পারছিল না কলকাতা পুলিশ। খুন হওয়া নারীর পরিচয় বের করতেও ব্যর্থ হয় তারা। ছবি তুলে রেখে মৃতদেহ সমাহিত করা হয়।

১৮৬৮ সালে কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে পড়ে থাকতে দেখা যায় এক বিদেশি নারীর রক্তাক্ত মরদেহ

মরদেহ মাটির নিচে গেলেও পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা দিন পর দিন বেড়েই চলে। কোনো উপায় না দেখে কলকাতা পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট স্যান্ডার্স হগ এ হত্যারহস্য সমাধানের দায়িত্ব দেন তরুণ পুলিশ পরিদর্শক রিচার্ড রিডকে। অনন্য বুদ্ধিবৃত্তিক তদন্তপদ্ধতির জন্য রিডের সুখ্যাতি ছিল। কমিশনার হগকে তিনি নিরাশ করেননি। অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আমহার্স্ট স্ট্রিট খুনের জট তিনি খুলতে সক্ষম হন। সে বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর এভরি ম্যান হিজ ওন ডিটেকটিভ বইটিতে।

প্রথমেই রিড আত্মহত্যাতত্ত্বকে উড়িয়ে দেন। আত্মহত্যার ক্ষত এত গভীর হয় না। ঘটনাস্থলে যে ছুরিটি পাওয়া যায়, তেমন ছুরি সাধারণত নাবিকেরা ব্যবহার করতেন। কলকাতা বন্দর হয়ে অসংখ্য নাবিক সে সময় কলকাতা শহরে আসা–যাওয়া করতেন। নিহত নারীর পায়ে জুতা ছিল না, তাঁর গায়ে ময়লাও ছিল না। তার মানে ঘটনাস্থলে ওই নারী হেঁটে আসেননি। কিছু উত্তর পাওয়া যায়, কিছু থাকে রহস্যে মোড়া। অন্যতম বড় প্রশ্ন, এই নারীর পরিচয় কী? ওই যে ছবি তোলা হয়েছিল, সেই ছবি রিড সবখানে ছড়িয়ে দেন। কোথাও সেই ছবি দেখে হ্যারিস নামের এক ব্যক্তি এসে জানান, তিনি এই নারীকে চেনেন। নারীর নাম রোজ ব্রাউন।

রিচার্ড রিড

ইঙ্গ–ভারতীয় এই নারী হ্যারিসের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। এ সূত্রের পর বের হয়ে আসতে থাকে একের পর এক তথ্য। রোজের সঙ্গে মাধবচন্দ্র দত্ত নামের এক ব্যক্তির পরিচয় ছিল। মাধবচন্দ্র নাবিকদের কাছ থেকে ছুরি কিনে কলকাতার বউবাজারে বিক্রি করতেন। রোজের বাসা থেকে পাওয়া যায় কিংসলে নামের এক ব্যক্তির ছবি। তিনি হাওড়ার বাসিন্দা। পুলিশের খাতায় তাঁর নামও মেলে। রোজের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। সম্পর্কের কোনো এক পর্যায়ে কিংসলের কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে থাকতেন রোজ। কিংসলেকে ছেড়ে তিনি ওঠেন বৈঠকখানা লেনের হ্যারিসের বাড়িতে।

কিংসলের বাড়িতেও অভিযান চালায় পুলিশ। কিংসলেকে পাওয়া না গেলেও পাওয়া যায় নারীদের রক্তাক্ত পোশাক। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলামত পাওয়া যায়—রোজের বৈঠকখানা লেনের বাড়ির চাবি। কিন্তু কিংসলের কোনো হদিস পাওয়া যায় না। তাকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। লাভ হয়নি। মামলাটি ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’।

তবে ভারতীয় পুলিশে বেশ কয়েকটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে ওই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে। হত্যাকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে কলকাতা পুলিশে প্রথমবারের মতো গোয়েন্দা শাখা প্রবর্তন করা হয়। রিচার্ড রিড এই শাখার ইন্সপেক্টর ও সুপারিটেনডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পান। রোজ ব্রাউনের মরদেহের ছবি তোলা হয়েছিল ‘স্যাশে অ্যান্ড ওয়েস্টফিল্ড স্টুডিও কোম্পানি’র এক আলোকচিত্রীকে দিয়ে। ভারতবর্ষে তদন্তের কাজে ছবি তুলে রাখার নিয়মও ওই প্রথম।

কলকাতা পুলিশে প্রথমবারের মতো গোয়েন্দা শাখা প্রবর্তন হয় রিচার্ড রিডের কল্যাণে

রোজ ব্রাউন হত্যাকাণ্ডসহ আরও অনেক ঘটনা লিপিবদ্ধ এভরি ম্যান হিজ ওন ডিটেকটিভ বইয়ে। বইটি এখন দুষ্প্রাপ্য। তবে বইটির একটি পিডিএফ সংস্করণ বিনা মূল্যে পড়া যাচ্ছে আর্কাইভ ডটওআরজি ঠিকানায় গিয়ে। প্রায় আড়াই শ পৃষ্ঠার এই বইয়ের ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। বইটি থেকে শুধু সে সময়ের অপরাধের বর্ণনাই পাওয়া যায়, তা নয়। সে সময়কে বুঝতেও বইটি বেশ কাজে দেয়।

তথ্যসূত্র: লাইভ হিস্ট্রি ইন্ডিয়া