চিরায়ত রম্য

প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে আগুন নেভাল গালিভার

৪ মে ১৬৯৯। আমরা ব্রিস্টল থেকে সমুদ্রপথে যাত্রা শুরু করি। ৫ নভেম্বর প্রচণ্ড ঝড়ে আমাদের পুরো দলটা হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং আমি লিলিপুট নামক এই অদ্ভুত রাজ্যে উপস্থিত হই। এখানকার মানুষগুলো মোটামুটি ছয় ইঞ্চি লম্বা। ঘড়বাড়ি, গাছপালা, পশু-পাখিগুলোও সেই অনুপাতেই ছোট ছোট। অনেকক্ষণ খেয়াল করে দেখলে সেগুলোকে কিছু একটা বলে মনে হয়। পৃথিবীতে যে এমন একটা রাজ্য থাকতে পারে, তা আমার কল্পনাতেও ছিল না।

যা হোক, প্রথম দিনই এরা আমার বন্দুক ও তলোয়ার বাজেয়াপ্ত করে। আর তাদের অদ্ভুত এক কায়দায় আমাকে গ্রেপ্তার করে ফেলে। তারা আকারে এত্তটুকুন হলে কী হবে, প্রযুক্তিগত দিক থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই। খালি সবই তাদের মতো ছোট ছোট দেখতে। আমাকে গ্রেপ্তারের পর নির্দিষ্ট কিছু শর্তে লিলিপুট রাজা আমাকে মুক্তি দেন এবং আমি তাকে ব্লেফুস্কদের সঙ্গে যুদ্ধে সাহায্যের অঙ্গীকার করি।

ব্লেফুস্ক রাজ্যটা ছিল লিলিপুটের উত্তর-পূর্বে। দুই রাজ্যের মধ্যে ছিল ৮০০ গজ চওড়া একটি খাল। আমি সবচেয়ে অভিজ্ঞ নাবিকটিকে খালের গভীরতা জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, খালটি গড়পড়তায় ষাট-সত্তর ‘গ্লামগ্লুফস’ গভীর। যা কিনা ইউরোপীয় হিসেবে প্রায় ছয় ফুট। আমি একটা ছোট পাহাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে চশমা দিয়ে অন্তত গোটা পঞ্চাশেক শত্রুপক্ষের সেনা দেখতে পেলাম। সঙ্গে প্রচুর যানবাহন। আমি কিছু শক্ত লোহার পাত আর দড়ি জোগাড় করলাম। লোহার পাতগুলো বাঁকিয়ে তৈরি করলাম গোটা পঞ্চাশেক আংটা। এরপর সেগুলো আটকে দিলাম একেকটি দড়ির প্রান্তে।

এগুলো নিয়ে প্রায় আধা ঘণ্টা পানিতে হাঁটা ও সাঁতরানোর পর শত্রুপক্ষের মুখোমুখি হলাম। শত্রুরা আমার বপু দেখে ভয়ে জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়ে পালাল। আমি দড়িগুলো বের করে জাহাজের গলুইয়ের সঙ্গে আংটাগুলো আটকে দিলাম। শত্রুদের ছোড়া হাজার হাজার তীর এসে আমার হাতে-মুখে বিঁধতে লাগল। সব কটি আংটা আটকানো শেষে দড়িগুলোর গিঁট বাঁধা প্রান্ত ধরে মারলাম টান। কিন্তু একটা জাহাজও একচুল সরাতে পারলাম না।

এবার আমি আমার ছুরি দিয়ে জাহাজের নোঙর আটকানোর দড়িগুলো কাটতে শুরু করলাম। এরপর খুব সহজেই গোটাপঞ্চাশেক ষণ্ডামার্কা সেনাকে হিড়হিড় করে আমার পেছনে টেনে আনতে লাগলাম। পেছনে চেঁচাতে থাকা হতভম্ভ ব্লেফুস্ক সেনাদের নিয়ে নিরাপদেই লিলিপুটের রাজকীয় বন্দরে পৌঁছালাম, যেখানে রাজা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলেন। রাজপুত্র আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ‘নার্দাক’ উপাধিতে ভূষিত করল।

তিন সপ্তাহ পর ব্লেফুস্ক থেকে একটি দল লিলিপুটে এল শান্তির প্রস্তাব নিয়ে। সভা শেষে তারা আমার বীরত্ব ও মহানুভবতার অনেক স্তুতি বন্দনা করলেন এবং আমাকে তাদের রাজ্যে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। ও হ্যাঁ, তাদের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল দোভাষীর মাধ্যমে।

সেদিন মাঝরাতেই হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল শত শত মানুষের কান্নায়। বেরিয়ে দেখি সর্বনাশ। রানির এক বেকুব দাসী রান্নার সময় কী একটা প্রেমের উপন্যাস পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন আগুন লেগে রানির প্রাসাদ ছারখার হওয়ার জোগাড়। আগুন নেভাতে কিছু মই আর বালতি আনা হয়েছে। কিন্তু আশপাশে কোথাও পানি নেই। বালতিগুলো নিতান্তই ক্ষুদ্র। বেচারা লিলিপুটরা সেগুলো নিয়েই আমার কাছে দৌড়ে আসতে লাগল। আমার কোট দিয়ে সহজেই আগুন নেভানো যেত কিন্তু সেটাও আমি ঘরে ফেলে এসেছি। ভাগ্যিস সন্ধ্যাবেলায় আমি ‘গ্লিমিগ্রিম’ নামক একরকম পানীয় খেয়েছিলাম। সৌভাগ্যবশত সেই পানীয়ের একাংশও আমি ত্যাগ করিনি। আগুনের উত্তাপ ও তা নেভানোর ক্রমাগত চেষ্টায় তলপেটে প্রবল চাপ অনুভব করলাম এবং আমার খাওয়া ‘গ্লিমিগ্রিম’ প্রাকৃতিক নিয়মে আমার পেট থেকে বেরিয়ে তিন মিনিটে আগুন নিভিয়ে দিল।

সকালবেলা রাজার অভিনন্দনের অপেক্ষা না করেই ঘরে ফিরে গেলাম। কারণ, আমি তাদের অনেক বড় একটি উপকার করলেও কীভাবে করেছি তা জানলে জাহাঁপনার মেজাজ কতখানি খাট্টা হবে তা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু রাজা আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, তিনি রাজ্যের বিচারকমণ্ডলীর কাছে আমার ক্ষমার আবেদন পৌঁছে দেবেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারলাম, রানি প্রাসাদ থেকে তাঁর তল্পিতল্পা গুটিয়েছেন এবং প্রতিজ্ঞা করেছেন, প্রাসাদ মেরামতের পরও তিনি আর কোনো দিন সেখানে থাকবেন না।

[অ্যাংলো–আইরিশ সাহিত্যিক জোনাথন সুইফটের (১৬৬৭–১৭৪৫) অমর সৃষ্টি গালিভার’স ট্রাভেলস–এর পঞ্চম অধ্যায় থেকে]

অনুবাদ: আলিয়া রিফাত