মানবসভ্যতা প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে যেতে যেতে আজকের রূপ পেয়েছে। এ বদল চলমান এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু কিছু ঘটনা আছে, যা এক ধাক্কায় সভ্যতাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছিল। সেসব যুগান্তকারী ঘটনা নিয়ে আমাদের এ আয়োজন...
আধুনিক সময়ে আইনের শাসন ছাড়া কোনো সভ্যতা কল্পনা করা যায় না। ধরা যাক, আজকের দিনে আমাদের সভ্যতায় বিজ্ঞান–প্রযুক্তি ও আনুষঙ্গিক সব সুযোগ–সুবিধা আছে কিন্তু শুধু আইন–আদালত নেই, তাহলে কেমন হতো সেই সভ্যতা? অথবা আদৌ কি তাকে সভ্যতা বলা যেত? মানুষ সভ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র তথা জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে আইন–আদালত ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গঠন করে। আইনের শাসন না থাকলে কোনো জাতি সভ্য হতে পারে না। তাই তো পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতায় দেখা যায় আইনের অনুশাসন। তখনকার দিনে তো আর আজকের মতো কাগজ বা বলপেন উদ্ভাবিত হয়নি, তাই ইতিহাসের প্রথম আইনের অনুশাসনগুলো লিখিত হয়েছিল পাথরের ওপর।
এখন যে এলাকাটি ইরাক নামে পরিচিত, সেটাই ছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়া। সেখানেই পৃথিবীর প্রথম সত্যিকারের সভ্য নগররাষ্ট্রগুলো গড়ে উঠেছিল। ফলে এলাকাটি সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত। এটি ছিল নানা গুরুত্বপূর্ণ নতুন চিন্তার (আইডিয়া) আঁতুড়ঘর। উদাহরণ হিসেবে চাকা উদ্ভাবন, লেখা, আইনের সৃষ্টি ইত্যাদির কথা বলা চলে।
নগররাষ্ট্র ব্যাবিলন ছিল মেসোপটেমিয়ার কেন্দ্রবিন্দু। ১৭৬০ খ্রিষ্টপূর্ব বেশ কটি ধারাবাহিক যুদ্ধের পর ব্যাবিলনের শক্তিমান রাজা হাম্মুরাবি অন্য সব বিপক্ষ নগররাষ্ট্রগুলো গুঁড়িয়ে দেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, তিনি যাতে পুরো মেসোপটেমিয়াকে নিজের অধীন আনতে পারেন। তবে হাম্মুরাবি শুধু যুদ্ধবাজ রাজা ছিলেন না, ফলে যুদ্ধজয় করেই তিনি থেমে থাকেননি। তিনি চেয়েছিলেন প্রথাগত উন্নয়নের পাশাপাশি তাঁর রাজ্যকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে, নতুন কিছু করতে। তাই হাতে নেন বেশ কিছু বড় প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মধ্যে উপাসনালয় তৈরি, খাল খনন, পানির নালা তৈরি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বের দিকে সুমেরিয়ানরা মেসোপটেমিয়ার নদীবর্তী স্থানগুলোকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। রাজা উর-নাম্মু ছিলেন একজন কুশলী রাজ্যনির্মাতা।
২৩০০ খ্রিষ্টপূর্বে সার্গন দ্য গ্রেটের অধীন আকাডিয়ানরা ব্যাপক ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্যে তারা এক সম্রাটের অধীন বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।
রাজা হাম্মুরাবি কঠোর হাতে মেসোপটেমিয়া শাসন করেছেন। তিনি আইন প্রণয়ন ও অপরাধের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করেছিলেন। তাঁর আইনগুলো ‘কোড অব হাম্মুরাবি’ নামে পরিচিত। এটি সবচেয়ে পুরোনো লিখিত আইন। ব্যাবিলনের সূর্য দেবতা শামাশের নামে হাম্মুরাবি প্রণীত আইনগুলো পাথরে খোদাই করা ছিল।
পাথরের স্তম্ভে খোদাই করা হাম্মুরাবির আইনগুলো সাম্রাজ্যের নানা জায়গায় জনসাধারণের প্রদর্শনের জন্য ছিল। যদিও এর মধ্যে মাত্র একটাই খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে মিলেছে ২৮২টি আইন। বিষয় অনুসারে আইনগুলো নানা শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যেমন পারিবারিক বিষয়, বাণিজ্য, ধর্ম ও দাসপ্রথা। জনসাধারণ যদিও পড়তে জানত না, তবু আইনভঙ্গকারীদের দাঁত উপড়ে নেওয়া বা শূলে চড়ানোর মতো শাস্তি ভোগ করতে হতো। আর আইনগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী কাদামাটিতে লিখে আগুনে পুড়িয়ে সংরক্ষণ করা হতো।
এতশত কঠোর আইন সত্ত্বেও মেসোপটেমিয়ায় মজার মজার খেলাধুলারও প্রচলন ছিল। প্রথম বোর্ড গেমের প্রচলন এখানেই।
এখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে হাম্মুরাবির আইনগুলো খুব বর্বর ও নিষ্ঠুর মনে হলেও তা আদতে আধুনিক আইনশাস্ত্রের পথপ্রদর্শক। কেননা ওই আইনই ছিল সূচনা। বিশেষ করে ইচ্ছামতো শাস্তি না দিয়ে নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য শাস্তি নির্দিষ্ট করার বিষয়টির জন্য আধুনিক আইন হাম্মুরাবির আইনের কাছে অনেকাংশেই ঋণী।