সাফল্যের সূত্র

পরীক্ষার ভালো ফলে বেয়ার গ্রিলসের আগ্রহ নেই কেন

বদলে যাচ্ছে চাকরির দুনিয়া, কাজের পরিবেশ, বস ও কর্মীর সম্পর্ক। সেরা কাজটা আদায় করে নিতে প্রতিষ্ঠানগুলো নিত্যনতুন পথ বেছে নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী জিকিউতে এ নিয়ে লিখেছেন বেয়ার গ্রিলস। তিনি একজন অভিযাত্রিক। পাহাড়, সাগর, মরুভূমি কিংবা গভীর জঙ্গলে ছুটে বেড়ান অভিযানের নেশায়। মূলত ডিসকভারি চ্যানেলের ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড অনুষ্ঠানটির জন্য পরিচিতি পেলেও বেয়ার গ্রিলসের আরও বেশ কিছু পরিচয় আছে। তিনি দ্য স্কাউট অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান স্কাউট। নানা রকম টিভি অনুষ্ঠান এবং স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রমের সঙ্গেও যুক্ত আছেন বেয়ার।

পাহাড়, সাগর, মরুভূমি কিংবা গভীর জঙ্গলে অভিযানের নেশায় ছুটে বেড়ান বেয়ার গ্রিলস
এনবিসি

আমার সৌভাগ্য, আমি অসাধারণ কিছু মানুষকে নিয়োগ দিতে পেরেছি। তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে করতেই শিখেছি, একজন ভালো কর্মী কিংবা ভালো নেতার মধ্যে কী কী গুণ থাকতে হয়। যে মানুষগুলো একেবারে শুরু থেকে আমার সঙ্গে কাজ করছেন, তাঁদের নিয়ে আমার গর্ব হয়। তাঁরা পরিবারের একটা অংশ হতে চান।

আপনার অবদান যখন আপনার বেতনের তুলনায় বেশি হবে, তখনই আপনি একজন ভালো কর্মী হতে পারবেন। ভালো কর্মীমাত্রই এটা জানেন। আমি এখানে আর্থিক লাভের কথা বলছি না। যত দিন আপনার পাওয়ার তালিকার চেয়ে দেওয়ার তালিকা লম্বা হবে, তত দিন প্রতিষ্ঠানে আপনার একটা শক্ত অবস্থান থাকবে।

একটা শক্তিশালী দলের অংশ হিসেবে কাজ করতে হলে সব সময় সহজ পথটা অবলম্বন করা মানেই নিরাপদে থাকা, এ ধারণা ভুল। ভালো চাকরিদাতারা আপনার মধ্যে দৃঢ় সংকল্প এবং ইতিবাচক মনোভাব খুঁজবে। আর ভালো কর্মী হিসেবে আপনার বিনিময়টাও তেমনই হওয়া উচিত। আমাদের দলে এমন লোক দরকার, যাঁরা এক ধাপ এগিয়ে থাকতে চান। যাঁরা দিনরাত কাজ করবেন, কখনো হাল ছাড়বেন না। যাঁরা নিজেকে ও আমাদের ‘ব্র্যান্ড’টাকে আলাদাভাবে বিবেচনা করবেন। সংক্ষেপে, আমাদের মূল লক্ষ্য অর্জনে নিজেকে শতভাগ সমর্পণ করবেন, এমন লোকই আমরা চাই। আমাদের লক্ষ্য—তরুণদের অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি উৎসাহী করা। আমরা জানি এ ধরনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্পের জন্য এমন একটা বিশেষ দল দরকার, একতা যাদের শক্তি।

নিজের কাজ নিয়ে গর্ব করার সক্ষমতা আচমকা তৈরি হয় না। শুরু থেকেই দেখেছি, টাকা ছাড়া আরও অনেক অর্জনের আশায় মানুষ কাজ করে। আমি বিশ্বাস করি, নগদ অর্থের চেয়ে লক্ষ্য, মূল্যবোধ কিংবা দূরদৃষ্টির মূল্য অনেক বেশি।

ঝুঁকি নিলে তবেই দারুণ কিছু অর্জনের সুযোগ পাওয়া যায় বলে মনে করেন বেয়ার গ্রিলস

বলছি না টাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমনকি আমরা যখন কাউকে নিয়োগ দিই, একটা পর্যায়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, আপনি কত পারিশ্রমিক চান। সাধারণত এ প্রশ্নের উত্তরে লোকে সোজাসাপ্টাভাবে একটা অঙ্ক বলে দেয়। যদি মানুষটিকে পছন্দ হয়, তাহলে আমরা তাঁর প্রত্যাশার চেয়েও ১০ শতাংশ বেশি বেতনের প্রস্তাব দিই। এটা নিঃসন্দেহে তাঁকে চমকে দেয়। কিন্তু বিশ্বস্ততা, নিষ্ঠা এবং ভালো কাজের মধ্য দিয়ে সেই ১০ শতাংশের তুলনায় বহু গুণ আমরা আদায় করে নিই। যতটা খরচ হয়, তার চেয়ে লাভ হয় অনেক বেশি। এটাই কর্মীদের আরও বেশি গর্বিত, আত্মবিশ্বাসী ও শক্তিশালী করে।

আমি এখনো বিশ্বাস করি, যা কিছু কর্মীদের প্রণোদনা দেয়, সেসবের তালিকায় টাকার অবস্থান নিচের দিকে। বিপদে-আপদে বস পাশে আছেন কি না, বস তাঁদের দেখভাল করেন কি না—সেটা বরং আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষমাত্রই ভুল করে। ‘মানুষ’ হওয়ার অপরাধে আপনি আপনার কর্মীকে শাস্তি দিতে পারেন না। ব্যর্থতা তো ঝুঁকি গ্রহণেরই একটা অনিবার্য ফল—এটা মেনে নেওয়ার মতো পরিবেশ গড়ে তোলাই একজন ভালো বসের কাজ। অধিকাংশ মানুষ সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। অতএব একজন বস যদি শুধু সমালোচনাই করেন, কর্মীরাও আর ঝুঁকি নিতে চান না। ফলে তাঁদের কাজের মান ‘সাধারণ’কে ছাপিয়ে যায় না।

একজন ভালো কর্মীকে ঝুঁকি নিতে উৎসাহিত করা উচিত। তবেই না তিনি দারুণ কিছু অর্জনের সুযোগ পাবেন। কিন্তু তিনি তখনই এই ঝুঁকিটা নেবেন যখন তিনি জানবেন—যাঁরা চেষ্টা করেন, ব্যর্থ হন এবং উঠে দাঁড়ান, বস তাঁদের সঙ্গে আছেন।

চাকরির পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবায় উৎসাহ দেন তিনি

জীবন, তথা কাজ হওয়া উচিত আনন্দময়। করপোরেট রীতিনীতি, রাজনীতি আর একক আধিপত্যের চর্চার কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তাই মানুষ নতুন নতুন পথ খুঁজছে। যেমন ধরুন আমাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মীরা যত খুশি ছুটি নিতে পারেন এবং এই ছুটির জন্য তাঁদের বেতন কাটা যায় না। এই বুদ্ধিটা আমি পেয়েছি নেটফ্লিক্সের কাছ থেকে। কোনো কোনো চাকরিদাতা ভাবতে পারেন, কর্মীরা এ সুযোগের অপব্যবহার করবেন। আমাদের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। কারণ আপনি যখন কর্মীদের অধিকার দেবেন, তাঁদের বিশ্বাস করবেন, তাঁরাও সেটা ফিরিয়ে দেবেন। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এ সুযোগ দেওয়ার পরও যতটা ছুটি নেওয়ার কথা, কর্মীরা তা নেন না!

কেউ যখন সিভি পাঠায়, আমি সেটাকে একনজরের বেশি সময় দিই না। কারণ, পরীক্ষার ভালো ফলে আমার আগ্রহ নেই। আমি বুঝতে চেষ্টা করি, বিপদের সময় একটা মানুষ কীভাবে সেটা সামাল দেয়। আমার কাছে বিশ্বস্ততা, একাগ্রতা, সততা ও উদ্দীপনাই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। সনদ নয়।

চাকরির পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবার মতো আরও নানা কিছু করার জন্য আমরা আমাদের কর্মীদের উৎসাহ দিই। যেন কাজের বাইরের জীবনটাকেও তাঁরা গ্রহণ করেন। কেউ যদি রয়্যাল মেরিন রিজার্ভিস্ট কিংবা স্কাউটের সঙ্গে কাজ করতে চান, আমরা তাঁকে যথাসম্ভব সাহায্য করি। আমরা দেখেছি, যেসব মানুষের সামনে একটা বড় লক্ষ্য আছে, যাঁরা স্বেচ্ছাসেবায় শ্রম দেন, সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত থাকেন, স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের দেওয়ার মানসিকতা অন্যদের চেয়ে বেশি হয়। যাঁরা যেকোনো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত, এমন লোকই আমরা চাই। যাঁরা কোনো না কোনোভাবে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার সহজ পথ খোঁজেন, তাঁদের চাই না।

একজন ভালো নেতা বা বসকে কর্মীদের অভিভাবক হতে হয়, তাঁদের কথা শুনতে হয়, বিপদে পাশে দাঁড়াতে হয়, উৎসাহ দিতে হয়। ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে নেতৃত্ব দিতে হয়।

জেনারেল জর্জ মার্শাল একবার একটা ভালো সম্পর্কের সূত্র বলে দিয়েছিলেন। সেটা হলো, ‘মানুষের গল্পটা শোনো। তার পুরো গল্পটা শোনো। সবার আগে তার পুরো গল্পটা শোনো।’

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ