দীর্ঘায়ু লাভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত কী

পূর্ণবয়সীদের ক্রমবিকাশ নিয়ে প্রায় ৮০ বছর ধরে গবেষণা চালিয়েছে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি। তাতে জানা গেছে, দীর্ঘায়ু লাভের প্রাথমিক শর্ত হিসেবে স্বাস্থ্যকর খাবার, কোলেস্টেরলের মাত্রা কিংবা ব্যায়াম মুখ্য নয়। তাহলে? বিস্তারিত পড়তে পারেন এখানে...

সম্পর্কগুলোর সুস্থতা সুন্দর জীবনের জন্য অপরিহার্য

সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে ঠিক কী কী প্রয়োজন? অর্থবিত্ত, প্রতিপত্তি, আয়েশি জীবনধারা? আমাদের চারপাশে কিন্তু এমন বহুজনেরই খোঁজ পাওয়া যাবে, যাঁরা এ সবকিছু থাকা সত্ত্বেও একটা ভীষণ অসুখী জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন। সব আছে, কিন্তু মনে যে সুখটাই নেই! সুখের শিকড়টাই কোথায় যেন কাটা পড়ে গেছে। সুখের অভাবে জীবনটা হয়ে পড়েছে ‘অসুস্থ’।

জীবনে সাফল্য-ব্যর্থতা আসবেই। সুখ-দুঃখ নিয়েই জীবন। আপনার সাফল্যের সুখটা ভাগ করে নেন কার সঙ্গে? পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গেই তো? ব্যর্থতায় নিমজ্জিত হলে সান্ত্বনার হাতটা কে রাখেন আপনার কাঁধে? নিশ্চয়ই সেই পরিবার আর বন্ধুরা? জীবনে সুখ-দুঃখ যা-ই আসুক, এই সম্পর্কগুলোর সুস্থতা কিন্তু সুস্থ জীবনের জন্য অপরিহার্য। সুস্থ জীবনের জন্য শারীরিক-মানসিক সুস্থতার প্রয়োজন আছেই; তবে শরীর-মনের সুস্থতার জন্য আপনজনদের সঙ্গে সম্পর্কের সুস্থতার গুরুত্বটা ভুলে গেলে চলবে না। দ্য হার্ভার্ড গেজেটে প্রকাশিত এক গবেষণা কিন্তু জানাচ্ছে এমনটাই।

সুস্থতার সূত্র

১৯৩৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার সময়টায় শুরু হয়েছিল এই গবেষণার কাজ। শারীরিক সুস্থতার দিকটা প্রথম দিকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল এই গবেষণায়। বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা আর ব্যক্তিত্বও গুরুত্ব পেয়েছিল তখন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, সম্পর্কের দিক থেকে যে যতটা সুখী, তিনি ততটাই সুখে জীবন কাটান। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রোগব্যাধি আক্রমণ করতেই পারে। কিন্তু সুখী সম্পর্কগুলোই জীবনটাকে করে তোলে শান্তিময়। গবেষকেরা বলছেন, ৫০ বছর বয়সী একজন তাঁর সম্পর্কগুলো নিয়ে যতটা সুখী ছিলেন, আশির ঘরে পৌঁছে তিনি ততটাই সুস্থ থেকেছেন। এমনকি শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেও সম্পর্কের দিক থেকে সুখী একজন খুব বেশি ভেঙে পড়েন না। উল্টোটা ঘটে অসুখী মানুষের বেলায়। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভুগতে পারেন বিষণ্নতায়ও।

সম্পর্কের চারাগাছের গোড়ায় রোজ পানি ঢালতে হয়

ভুল এড়িয়ে জীবনের পথে

একাকিত্ব বড্ড ‘বিষাক্ত’। সবাই থাকার পরও কিন্তু কেউ নিজেকে আবিষ্কার করতে পারেন ‘একা’। পরিবারকে সময় দেওয়া আবশ্যক, বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখারও কোনো বিকল্প নেই। সম্পর্কের চারাগাছের গোড়ায় যে রোজ পানি ঢালতে হয়—এমন কথা আমাদের সবারই জানা। তবু আমাদের ব্যস্ততার শেষ নেই। ছুটে চলার শেষ নেই। নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরীক্ষায় ভালো ফল, ভালো চাকরি, পদোন্নতি—সব আমাদের চাই। বিয়ের অনুষ্ঠানে চাই চমকজাগানো আয়োজন। অথচ এই এত কিছু যাঁদের জন্য, তাঁদের ভালো লাগা-মন্দ লাগার কথাই যেন দিন শেষে আমাদের মনে থাকে না। সামাজিক সম্পর্কগুলোকেও আমরা যেন কেবল উপহারের মোড়কেই সুখী রাখতে চাই। সুস্থ জীবন পেতে হলে এই ভুলগুলো থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।

আমরা কি এমন?

সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীর ওপর তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের অত্যাচারের কাহিনি আমাদের মর্মাহত করেছে তাঁর মৃত্যুর পর। ঘরের স্ত্রীকে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে দিতে তাঁদের যে ভীষণ আপত্তি। এমন ঘটনা একটি-দুটি নয়, অনেক পরিবারে ঘটে চলেছে বছরের পর বছর। বৈবাহিক সম্পর্কে একটি পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে নারী হারাচ্ছেন তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। এ তো গেল অত্যাচারী মনোভাবের দৃষ্টান্ত। মুদ্রার উল্টো পিঠটাও আমাদের খুব চেনা। বিবাহিত পুরুষের প্রতি হয়তো তাঁর স্ত্রীর অগুনতি অভিযোগ। মূল্যবান গয়না, শাড়ি কিংবা আসবাবের জন্য মান-অভিমান। আবার অভিভাবকেরা সন্তানের পড়ালেখা-ক্যারিয়ার নিয়ে অতিরিক্ত চাপে ফেলে দিচ্ছেন। একটাবারও ভাবছেন না, বেচারি সন্তান কী চায়। অন্য দিকে মা-বাবার বয়স হয়ে গেলে তাঁদের শরীর-মনের যত্ন নেওয়া নিজেদের দায়িত্ব বলে মনেই করছেন না ‘বড়’ হয়ে যাওয়া সন্তানেরা।

মা-বাবার বয়স হয়ে গেলে তাঁদের শরীর-মনের যত্ন নেওয়া সন্তানেরই দায়িত্ব

বয়স বাড়ুক আনন্দে

সম্পর্কে মান-অভিমান আসতেই পারে। জীবনে চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাকও থাকতে পারে। কিন্তু সেই ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে সম্পর্কে যেন আণুবীক্ষণিক চিড়ও না ধরে, সেই বিষয়টা খেয়াল রাখা জরুরি। তাই সম্পর্কের যত্ন নিন। সম্পর্কের যত্ন নেওয়া যেন নিজের যত্ন নেওয়ারই এক ভিন্ন রূপ। একজন সুখী ব্যক্তি তাঁর প্রিয়জনদের জন্য নিজের সুস্থতা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হন। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস আর শরীরচর্চা যেমন গুরুত্ব পায় তাঁর কাছে, তেমনি ধূমপানের মতো বদভ্যাসও এড়িয়ে চলতে সক্ষম হন তিনি। জীবনের সমস্যাগুলোকে ইতিবাচক উপায়ে সমাধান করতেও সচেষ্ট থাকেন এমন ব্যক্তি। এমনটাই তো হতে চাই আমরা, তাই না? তাহলে শুরু হয়ে যাক সম্পর্কের যত্ন নেওয়া। আজ থেকেই।

সম্পর্কের যত্ন নেওয়া যেন নিজের যত্ন নেওয়ারই এক ভিন্ন রূপ

বিকৃতি থেকে নিষ্কৃতি হোক

অপর ব্যক্তি বা পরিবার নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে কেউ কেউ বিকৃত আনন্দ লাভ করেন। কার মেয়ের ৩০ পেরিয়েও বিয়ে হলো না, কোন দম্পতি বিয়ের পাঁচ বছরেও সন্তানের মুখ দেখতে পেল না—এগুলো নিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। যাঁর সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তিনি এমন কথা শুনলে যেমন কষ্ট পাবেন, তেমনি আপনার সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতাও আর থাকবে না। আবার তিনি যদি আপনার মন্তব্যটা না-ও জানতে পারেন, তবু যাঁদের সঙ্গে এসব আলাপ করছেন, তাঁদের মনেও আপনি ছিদ্রান্বেষী হিসেবে স্থান পাবেন। এতে কারও সঙ্গেই আপনার সম্পর্কের উন্নতি হবে না। তাই এমন নিচ ভাবনার হাত থেকে নিষ্কৃতি দিন নিজের মনকে। বরং উন্নততর করে তুলুন পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলোকে।