আমার বন্ধু দিয়ামিদের দীর্ঘজীবী হওয়ার বাতিক আছে। সে ৩০০ বছর বাঁচতে চায়। যমের মতো ভয় পায় দরজা-জানালার ফাঁকফোকর গলে আসা শিরশিরে বাতাস আর যাবতীয় ভাইরাসকে। ভোরে, সৎমানুষেরা যখন প্রশান্ত নিদ্রায় মগ্ন, হৃদ্রোগকে পেছনে ফেলে সে জগিং করে এগোতে থাকে, সব ব্যাকটেরিয়া আর জীবাণুকে ধ্বংস করতে নদীর বরফ-খোঁড়া পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে অবলীলায়।
তার ধারণা, এর ফলে স্নায়ুতন্ত্র সবল হয়, হৃৎপিণ্ড হয় আরও বলবান, দ্রুততর হয় রক্ত চলাচল। আমার তো বরফ-খোঁড়া পানি দেখলেই সর্দি শুরু হয়ে যায়, তখন কোটের ওপরে পরে নিই আরও একটি সোয়েটার...
কারাতে পদ্ধতিতে মাথার খুলি শক্ত করার লক্ষ্যে সে প্রতিদিন এক ঘণ্টা ধরে মাথা ঠোকে দেয়ালে। মেরুদণ্ড দৃঢ় রাখতে যোগব্যায়াম পদ্ধতিতে দুই ঘণ্টা বসে থাকে সর্পাসনে। প্রতি রোববার ঘরে বসে অলস সময় না কাটিয়ে শরীরে ঘাম ছুটিয়ে সাইকেল চালায়।
এদিকে আমি ডিভানে শুয়ে টিভি দেখে জীবন পার করে দিচ্ছি। অনিবার্য সর্বনাশই আমার নিয়তি। অদূরদর্শিতার যথার্থ মূল্য আমাকে দিতে হবে, এমন কথা পড়লাম ‘সুস্বাস্থ্য’ নামের পত্রিকায়।
এর মধ্যে একদিন শুনি, দিয়ামিদ হাসপাতালে! ডায়েটে গড়বড় করেছিল। কোনো এক তরল পথ্যের বদলে খেয়েছে কঠিন এক খাদ্য। অবস্থা গুরুতর।
আমি নির্ভার চিত্তে ডিটেকটিভ বই পড়ি, শরীরের দিকে কোনো নজর দিই না, ফারের ওভারকোট পরেও শীতে কাঁপি; অথচ এলব্রুস পর্বতের বরফের ওপরে সুইমিং স্যুট পরে শরীরচর্চা করে দিয়ামিদ। হাতের সামনে যা পাই, তা-ই খাই নির্লজ্জের মতো—ভিটামিনের কথা একদমই ভাবি না। ওদিকে দিয়ামিদ তিব্বতীয় অনাহার-পদ্ধতি অনুসরণ করে কী সব ঘাসপাতা খেয়ে তার পাকস্থলী পরিষ্কার করে।
শরীরের প্রতি মনোযোগী হওয়ার কথা আমার, অথচ লঘুচিত্ত আমি ভেরোনিকার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলায় বেশ আগ্রহী। ভেরোনিকা—দিয়ামিদের সাবেক প্রেমিকা। ৩০০ বছর বাঁচা তার পক্ষে অসম্ভব অনুধাবন করে সে দিয়ামিদকে ত্যাগ করে স্বল্পজীবী আমার দিকে নজর দিতে শুরু করে।
দিয়ামিদ যখন তার স্বাস্থ্যের সুরক্ষাকল্পে কঠোর নিয়মাবলি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেছে, আমি তখন তার ভেরোনিকার সঙ্গে ডিস্কোটেকে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে নাচি, তাকে বাসায় পৌঁছে দিই এবং ভূত-ভবিষ্যৎ না ভেবে চুমু খেয়ে বিদায় নিই।
আমার বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। ৮৫ বছর বয়সে বরফ-খোঁড়া পানিতে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎকার দিয়ে, ৯৫ বছর বয়সে অগণ্য বুকডন দিয়ে এবং ১৫০ বছর বয়সে ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়ে জনতাকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার ভাগ্য আমার হবে না। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক পত্রিকা ও হ্যান্ডবুকে উল্লেখ করা ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, যুবক বয়সেই নানা রোগবালাই আমাকে গিলে ফেলবে। তাই বিলম্ব না করে আমি ভেরোনিকাকে বিয়ে করে ফেললাম। আমাদের পুত্রসন্তানের জন্ম হলো। নিজের স্বাস্থ্যের কথা আমি বেমালুম ভুলে গেলাম—বাচ্চার কাপড় বদলাই, ধুই, তাকে হাতে নিয়ে দোলাই, ঘুম পাড়াই... সময় নেই বলে এখন অনেক কম ঘুমাই, কম খাই, ঘরের বাইরে যাওয়া হয় না খুব একটা...
আমার সন্তানদের আমি দিয়ামিদের পদ্ধতিতেই বড় করে তুলব, যাতে তারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয় এবং ৩৫০ বছর ভাইরাসমুক্ত জীবন যাপন করে।
এর মধ্যে একদিন শুনি, দিয়ামিদ হাসপাতালে! ডায়েটে গড়বড় করেছিল। কোনো এক তরল পথ্যের বদলে খেয়েছে কঠিন এক খাদ্য। অবস্থা গুরুতর।
ভেরোনিকার বানানো লোভজাগানিয়া রঙের পিঠা, ম্যারিনেটেড মাশরুম আর ম্যারিনেটেড শসা নিয়ে চললাম সুপারম্যানকে পুনরুজ্জীবিত করতে।
গপগপ করে পিঠা আর মাশরুম খেয়ে হঠাৎ অর্থবহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা দোস্ত, জীবনের মানে কী?’
অনুবাদ: মাসুদ মাহমুদ