ঢাকার মশা চুমু দেয় নাকি কামড়ায়?

আঁকা: জুনায়েদ আজিম চৌধুরী

চুমু স্নেহ ও ভালোবাসার প্রতীক। কামড়ানো তেমনটা নয়। রাজধানীবাসীর মনে হতেই পারে যে এখানকার মশারা তাদের কামড়াচ্ছে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দুই সিটি করপোরেশন অনুভব করতে পেরেছে যে ঢাকার মশারা আসলে কামড়ায় না, চুমু দেয়। নইলে কি আর এভাবে বংশবৃদ্ধির যথেচ্ছ সুযোগ এখানকার মশারা পায়?

ঢাকায় এবার মশার উৎপাত বেশ। এতটাই যে নিজেদের ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট না থাকলেও, তাদের ‘চুমু’র জোরে অতিষ্ঠ মানুষেরা মার্ক জাকারবার্গের দোকানে ভালোই প্রচার চালাচ্ছে। এবং তারা এ-ও বলছেন যে মশা চুমু নয়, কামড় দিচ্ছে। বলবে না-ই বা কেন বলুন? দিন শেষে চুমুতে মতান্তরে কামড়ে ঘায়েল হয়ে হাসপাতালে তো মানুষকেই যেতে হয়। অবস্থা বেশি খারাপ হলে প্রাণও যেতে পারে। মশাদের বিরুদ্ধে এতটুকু ‘পতিবাদ’ নিশ্চয়ই করা যেতে পারে, নাকি? প্লিজ, এর জন্য কেউ আবার মামলা করে বসবেন না যেন।

তবে যেহেতু মশাদের ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি দেওয়া হয়নি, তাই লাইক-কমেন্টের বন্যা উপভোগ করতে পারছে না ঢাকার মশারা। সেই বন্যার কিয়দংশ দেখতে পারলেও হয়তো চুমু কিংবা কামড়ানোয় আরও কয়েক গুণ উৎসাহ পেত তারা। রাতে বাতি নিভিয়ে আপনি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলেই, কবিগুরুর ভাষায় ‘তোমায় গান শোনাব...’ বলে বর্তমানের তুলনায় অতিরিক্ত বেগে তেড়ে আসতে পারত!

মশারা তেড়ে আসতে থাকুক। কাছে আসতে যতক্ষণ লাগে, ততক্ষণে না হয় চুমু প্রসঙ্গে কথা বলা যাক। আগেই বলেছি চুমুতে স্নেহ ও ভালোবাসা প্রকাশিত হয়। আপনারা জিজ্ঞেস করতেই পারেন, কেন আমি মশার ‘চুমু’ তত্ত্বে আগ্রহী। দেখুন, প্রতিবছরই আমরা হরেদরে মশার কামড় খাই। আমাদের ও আমাদের প্রিয়জনদের ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া প্রভৃতি হয়। চিকিৎসা বাবদ টাকা খরচ হয়। কারও কারও প্রাণ সংশয়ও হয়। কিন্তু বছরের পর বছর ধরেই এ শহরে মশা কমে না।

যদিও মশা কমানোর আয়োজনও কমে না। সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, সিটি করপোরেশন মশার প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করে। তাতে গাপ্পি মাছ ছাড়ে। গত বছর নাকি তিন জলাশয়ে মশা মারতে তেলাপিয়া মাছ ও হাঁস ছাড়া হয়েছিল। সেই হাঁস-মাছ মশা খায়, নাকি মশাদের গুরুপাক ভোজন হয়—তা অবশ্য নাগরিকেরা জানতে পারে না। অবশ্য আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর জানার দরকারই–বা কী!

খবরে জানা গেছে, গত চার বছরে শুধু মশা মারতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নাকি প্রায় ৭৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা খরচ করেছে। ওদিকে আবার মশার বংশ ধ্বংসের বিশেষ ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে শুরু থেকে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলতে থাকলেও, তাতে থোড়াই কেয়ার করে সেই ওষুধ ব্যবহার করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। কিন্তু এত কিছুর পরও ফি বছরই মশার গানের প্রাবল্য বেড়েই চলে। মশারা আমাদের গান শোনাবে বলেই হয়তো পণ করেছে! তার সঙ্গে যদি বাদ্য-বাজনা (পড়ুন গাপ্পি মাছ, তেলাপিয়া, হাঁস, প্রশ্নবিদ্ধ ওষুধ ইত্যাদি ইত্যাদি) বিনা মূল্যে মেলে, তবে তো কথাই নেই।

এমন অবস্থায় মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে মশার কামড়ানোর নিশ্চয়ই অন্য কোনো বিপরীত অর্থের প্রতিশব্দ আছে এবং তাকে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে। কামড়ানোকে যদি খারাপ মনে করি, তবে তো চুমুর কাছেই যেতে হয়।

গবেষণা নিয়ে তাড়াহুড়ো করা যাবে না মোটেও। চালাতে হবে কয়েক বছর। কয়েক হাজার কোটি টাকা যদি গবেষণায় খরচই না হয়, তবে বিশ্ব দরবারে কি তা উপস্থাপন করা যাবে?

আসলে ঢাকার মশাদের নিয়ে একটি গবেষণা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা এমনিতেই গবেষণায় অনেকটা পিছিয়ে। তাতে একটু এগিয়ে যাওয়ার সুযোগও এতে পাওয়া যেতে পারে। মশা কামড়ায়, নাকি চুমু দেয়—সে ব্যাপারে বিস্তারিত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে দুই সিটি করপোরেশন ও মশাদের বক্তব্য ও মতামত আলাদাভাবে জোগাড় করতে হবে। বলতে পারেন, মশাদের বক্তব্য কীভাবে নেওয়া যাবে? আরে, এত দিন মশার প্রগাঢ় ‘ভালোবাসা’য় সিক্ত হতে পারলেন, আর এহেন প্রেমিক-প্রেমিকাদের ভাষা বুঝতে পারবেন না, তা কী হয়? পারলে আমরা ঢাকাবাসীরাই পারব। মশাদের সঙ্গে এমন দীর্ঘ ‘অম্ল-মধুর’ সম্পর্ক পৃথিবীর অন্য কোনো নগরের অধিবাসীদের আছে বলে মনে হয় না। প্রয়োজনে আমরা টেলিপ্যাথিও ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু সাবধান, সিমপ্যাথি দেখানো চলবে না!

তবে হ্যাঁ, গবেষণা নিয়ে তাড়াহুড়ো করা যাবে না মোটেও। চালাতে হবে কয়েক বছর। কয়েক হাজার কোটি টাকা যদি গবেষণায় খরচই না হয়, তবে বিশ্ব দরবারে কি তা উপস্থাপন করা যাবে? একটা বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয় তো আছে, নাকি?

তত দিন না হয় একটু কষ্ট করুন। মশাদের গানে তাল মেলানোর চেষ্টা চালান। চেষ্টায় কী না হয়? আর কামড়ানোর বিষয়টা মনে বেশি কষ্ট দিলে, ভাবতে থাকুন—এগুলো কামড় নয়, এগুলো চুমু। অন্তত মানসিক শান্তি পাবেন। আর মনে মনে মনকলা খেলে, কেউ যে আপনাদের মারতে আসবে না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। কারণ, কথায় তো আছেই—‘পাগলের সুখ মনে মনে...!’