জানা–অজানা

কীভাবে এল ‘মুরাদ টাকলা’?

কোলাজ: একটু থামুন

মুরাদ নামের এক লোক, যার মাথায় ইয়া বড় এক টাক—‘মুরাদ টাকলা’ শব্দ দুটি শুনলে এমন ছবিই তো চোখের সামনে ভেসে ওঠে, নাকি? গত কয়েক বছরে অনলাইনে যেসব শব্দ খুব বেশি ব্যবহৃত হয়েছে, মুরাদ টাকলা তার মধ্যে অন্যতম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যাকাউন্ট আছে, এমন সব বাংলাদেশি কিংবা বাংলা ভাষাভাষী অন্তত একবার ‘মুরাদ টাকলা’ শব্দ দুটি অবশ্যই শুনেছেন। কিন্তু কীভাবে এল মুরাদ টাকলা? মুরাদ নামের কোনো এক টেকো ব্যক্তিই কি আছেন এর পেছনে?

মূলত মুরাদ টাকলার সঙ্গে ‘মুরাদ’ নামের কিংবা টেকো মাথার কারও কোনো সম্পর্ক নেই। এর মাধ্যমে ইংরেজি হরফে ভুলভাল বা বিকৃত বাংলা লেখার চর্চাকে বোঝানো হয়। যাঁরা এমন বিকৃত বাংলা (কিংবা বাংলিশ) লেখেন, অনেকে তাদেরকেও মুরাদ টাকলা বলে সম্বোধন করেন। অনলাইনের এই জনপ্রিয় শব্দযুগলের উৎপত্তি জানতে ফিরে তাকাতে হবে গত দশকের শুরুর দিকে।

আনুমানিক ২০১২ সালে ফেসবুকের কোনো একটি পোস্টের কমেন্ট বক্সে তুমুল তর্কযুদ্ধের এক পর্যায়ে জয়ন্ত কুমার (Joyonto Kumer) নামের এক ব্যক্তি কমেন্ট করেন, ‘Murad takla jukti dia kata bal, falti pic dicos kan! Lakapora koira kata bal.’ ইংরেজি হরফে ভুলভাল বানানে লেখা এই বাক্যে তিনি মূলত বলতে চেয়েছিলেন, ‘মুরোদ থাকলে যুক্তি দিয়ে কথা বল, ফালতু পিক দিছস কেন? লেখাপড়া কইরা কথা বল।’ স্বাভাবিকভাবেই এই বাক্য নিয়ে হাসাহাসি চলতে থাকে, ছড়িয়ে পড়ে সেই কমেন্টের স্ক্রিনশট।

সেই তর্কযুদ্ধে জয়ন্ত কুমার জিতেছিলেন কি না, তা জানা যায়নি। তবে এই বাক্যের ‘Murad takla’ বা ‘মুরাদ টাকলা’ শব্দযুগল ইংরেজি অক্ষরে বিকৃত বাংলা লেখার এই ‘রীতি’র সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। সে সময় অনলাইন জগতে অভ্র সফটওয়্যারটির সঙ্গে ব্যবহারকারীরা পরিচিত হচ্ছেন মাত্র। ফোনেটিক কি–বোর্ড ব্যবহার করে বাংলা টাইপে অনেকেই তেমন দক্ষ হয়ে ওঠেননি। তাই অনলাইনে ‘মুরাদ টাকলা’ ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল অনেক, যাঁদের ভুলভাল ‘বাংলিশ’ লেখা অন্যদের বিনোদনের খোরাক হয়ে উঠতে থাকে।

সরল বঙ্গানুবাদ: ফোন দিলে ব্লক খাবেন
সরল বঙ্গানুবাদ: বুকের ব্যথাটা কেউ বুঝল না, সবাই বলে, গ্যাসট্রিকের ব্যথা
সরল বঙ্গানুবাদ: পৃথিবীতে সেই মেয়ে ভাগ্যবান, যার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য একটা ছেলে চোখের পানি ফেলে

পরের বছর ফেসবুকে ‘মুরাদ টাকলা’ নামের একটি পেজ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই পেজে অনলাইনে নানা জনের ব্যবহার করা বিভিন্ন টাকলা বাক্য (অর্থাৎ ইংরেজি হরফে ভুলভাল বাংলা লেখা) পাঠোদ্ধার করতে দেওয়া হতো। সঠিকভাবে লেখা বাংলা বাক্যকেও ‘মুরাদ টাকলা’য় রূপান্তর করতে শুরু করেন অনেকে।

সরল বঙ্গানুবাদ: বৃষ্টি শুরু হলো, কী যে ভালো লাগছে! একটা ভেজার মতো মানুষ থাকলে ভিজতাম
সরল বঙ্গানুবাদ: আজকে চট্টগ্রামের জনগণের নেতা কে, কে নিজে নিজের নেতা, তা প্রমাণ হলো, বন্ধুগণ। বিপদে বন্ধুর পরিচয়, তা আজ যথাযথ হলো

এর ফলে ক্রমে ‘মুরাদ টাকলা’ শব্দযুগল এবং এর ব্যবহার অনলাইনে হাস্যরসের অন্যতম উৎসে পরিণত হয়। অন্য দিকে ট্রলের শিকার হওয়ার আতঙ্কে হলেও সঠিকভাবে বাংলা টাইপ করার বিষয়ে অনেকেই সচেতন হতে থাকেন। এখন মুরাদ টাকলাকে কেউ আলাদা ভাষারীতি হিসেবে দাবি করে বসলেও অবাক হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না। ২০২০ সালে মুরাদ টাকলা অভিধানও বেরিয়েছে। সিমু নাসের ও পীয়্যান মুগ্ধ নবী সম্পাদিত এই অভিধানের পরিচিতিতে বলা হয়েছে, ‘অন্তর্জালে মুরাদ টাকলা নামের এই ভাষায় বেশ কয়েক বছর হয় নাজেহাল হচ্ছেন বাংলার আপামর জনগণ। এই ভোগান্তি থেকে জাতিকে বাঁচাতে এল—মুরাদ টাকলা অভিধান।’

তবে যত যা–ই হোক, সম্প্রতি অনলাইনে মুরাদ নামের টেকো মাথার এক ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা যতদূর গড়িয়েছে, তাতে করে মুরাদ টাকলা শব্দযুগলের সঙ্গে তিনিও আজীবনের জন্য জড়িয়ে যাবেন কি না, তা–ই বা কে বলতে পারে! ভবিষ্যতে কেউ যদি দাবি করে যে মুরাদ নামের এক সমালোচিত টেকো ব্যক্তির নামানুসারেই এসেছে মুরাদ টাকলা, তাকে এই শব্দের উৎপত্তির আসল ইতিহাসটা জানিয়ে দিতে পারেন। মুরোদ যেহেতু আছে, পড়ালেখা করেই কথা বলা ভালো।