খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বন্ধু, স্বজন, আত্মীয়দের ফোন নম্বর আমরা ফোনবুকে নয়, ‘মন বুক’–এ টুকে রাখতাম। অন্তত গোটা দশেক ফোন নম্বর মুখস্থ রাখাই স্বাভাবিক ছিল। ধীরে ধীরে যন্ত্রের প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতা বেড়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইউরোপের অর্ধেকের বেশি মানুষ তাঁদের সন্তান বা কর্মস্থলের ফোন নম্বর বলতে পারেন না। অথচ ছেলেবেলায় মুখস্থ করা বাবা–মায়ের পুরোনো ফোন নম্বর তাঁদের ঠিকই মনে আছে। এমন নয় যে কেবল ফোনবুকে নম্বর সেভ করা থাকে বলেই আমরা নম্বর মনে রাখি না। যন্ত্রের প্রতি নির্ভরতা বাড়ার কারণে আমাদের মস্তিষ্কও নম্বর মনে রাখার কাজে অনভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
এই সমস্যাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন ‘ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া’। শুধু ফোন নম্বর নয়, প্রিয়জনের জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী কিংবা জরুরি মিটিংয়ের তারিখও এখন আর আমরা মনে রাখতে চাই না। এই প্রবণতার ভালো দিক বা মন্দ দিক, দুটোই উঠে এসেছে নানা গবেষণায়।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের স্নায়ুবিজ্ঞানী স্যাম গিলবার্টের মতে, বাজারের ফর্দ কিংবা ফোন নম্বর মনে রাখা মানুষের মস্তিষ্কের কাজ নয়। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি অপ্রয়োজনীয় তথ্য মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন, তাহলে মস্তিষ্ককে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করতে পারবেন।’
দৈনন্দিন জীবনের যেসব তথ্য সংরক্ষণ করে রাখার জন্য ফোন বা কম্পিউটার আছে, সেগুলো মনে রাখা জরুরি নয় বলেই মনে করেন স্যাম। পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ন্যান্সি ড্যানিসের বক্তব্যও স্যামের মতোই। তিনি মনে করেন, যন্ত্রের প্রতি নির্ভরশীলতা যেভাবে আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাকে বদলে দিয়েছে, তাতে দোষের কিছু নেই। নম্বর, তারিখ, পাসওয়ার্ড মনে রাখার চেয়ে মস্তিষ্ককে তুরীয় চিন্তা (ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং), বিশ্লেষণ বা সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখাই শ্রেয় বলে মনে করেন ন্যান্সি ড্যানিস।
একটা সাধারণ তথ্যের জন্যও যদি আপনাকে বারবার ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হতে হয়, তখন আর মস্তিষ্ক সেটা ধারণ করে রাখতে চায় না, তা যত সামান্যই হোক না কেন।
পাল্টা যুক্তিও এসেছে অনেকের কাছ থেকে। ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহামের গবেষক মারিয়া উইম্বার দাবি করছেন, যন্ত্রের প্রতি নির্ভরশীলতার কারণে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি তৈরি হয় না। কোনো তথ্য বা ঘটনা বারবার স্মরণ করলে যেমন তা মনে থাকে, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় তথ্যগুলোও মাথা থেকে চলে যায়। একটা সাধারণ তথ্যের জন্যও যদি আপনাকে বারবার ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হতে হয়, তখন আর মস্তিষ্ক সেটা ধারণ করে রাখতে চায় না, তা যত সামান্যই হোক না কেন।
জাদুঘরে বেড়াতে যাওয়া দর্শনার্থীদের নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন, তাঁরা অধিকাংশই জাদুঘর ঘুরে কী কী দেখেছেন, তা মনে রাখতে পারেননি। একইভাবে আরেক গবেষণায় জানা গেছে, জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) ব্যবহার করে যে গাড়িচালকেরা পথ চলেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই রাস্তা মনে রাখতে পারেন না।
মানুষের মস্তিষ্কের কাজের ধরন খুব অদ্ভুত। জানিয়ে রাখি, স্মৃতি জাগিয়ে তোলার জন্য ঘ্রাণ ভীষণ কার্যকর। একটা চেনা ঘ্রাণ হুট করেই আপনাকে ছেলেবেলার বহু পুরোনো স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আবার দেখবেন, কখনো কখনো গণিত বা পদার্থবিজ্ঞানের সামান্য একটা সূত্র মনে রাখতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা গলদঘর্ম হয়। কিন্তু একটা গান দু–তিনবার শুনলেই মুখস্থ হয়ে যায়।
এ কারণেই অনেকে নিজের ফোন নম্বর মনে রাখতে পারেন না, অথচ বেলা বোসের ফোন নম্বর ভোলেন না কখনো!
সূত্র: বিবিসি ও টুডে ডটকম