আজ ২৭ নভেম্বর রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন বরেণ্য অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের। মঞ্চে তিনি বিদ্রোহী নূরলদীনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে রোমহর্ষে জেগে উঠত দর্শক। এ রকম নানা চরিত্রে অভিনয় করে তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী মঞ্চনাটকের অন্যতম সংগঠক ও সফল নাট্যনির্দেশকও ছিলেন আলী যাকের। সংস্কৃতিজগৎ ছাপিয়ে তাঁর মেধার দ্যুতি ছড়িয়েছিল বিজ্ঞাপনী খাতে। একুশে পদকসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ২০১৯ সালে পান মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা। সে বছরের ২৭ এপ্রিল তাঁর জীবনকথা নিয়ে প্রচ্ছদকাহিনি প্রকাশিত হয় প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হলো...
নিজের অফিসঘরটায় এসে বসলেন তিনি। বললেন, ‘কী জানতে চাও?’
‘আপনাকে। আপনার বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে সব।’
হাসলেন। ‘সব কি আর জানা যায়। বলা যায়! দেখি কতটা মনে করে বলতে পারি।’
আমরা বসে যাই শুনতে। ১৬ এপ্রিল ঢাকার বনানীর এশিয়াটিকের অফিস থেকে আমরা চলে যাই চট্টগ্রামে, চলে যাই ১৯৪৪ সালের একটি দিনে।
চট্টগ্রামের সদর স্ট্রিটে এসডিও (তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক) মোহাম্মদ তাহেরের বাড়ি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সিঁড়িঘরের কাছে বালুর বস্তা দিয়ে ট্রেঞ্চমতো করা হয়েছে। সিগন্যালের আওয়াজ কানে এলেই বোঝা যেত, একটু পরই প্লেন থেকে বোমা ছোড়া হবে। তখন সবাইকেই চলে যেতে হবে ট্রেঞ্চে। ৬ নভেম্বর মা রিজিয়া তাহেরের প্রসববেদনা উঠল। সেদিন রাত ১০টার দিতে জন্ম হলো আলী যাকেরের। অনেকেই ঠাট্টা করে বলতেন, ছেলেটা অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে জন্মেছে, এ কারণেই খেতে এত ভালোবাসে।
আসলে তাঁর অতৃপ্তির মূল ভিত্তিভূমি যে হয়ে উঠবে সংস্কৃতিজগৎ, সেটা কেউ ধারণাও করতে পারেনি তখন। তিনি নিজেও কি সেটা ভেবেছিলেন? মুক্তিযুদ্ধের আগে সেভাবে নাটক করারই তো অভিজ্ঞতা ছিল না তাঁর। তাহলে?
বাবার ছিল বদলির চাকরি। পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে হলেও বাবার বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের চাকরির সুবাদে এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরতে থাকে গোটা পরিবার। আলী যাকেরের প্রথম স্মৃতি ফেনীর। মনে আছে শহরটার কথা। মাঝখানে বিরাট দিঘি, চারপাশে সরকারি ভবন। একেবারে কোনায় যে বাংলোটা, সেটাই ছিল এসডিওর বাংলো। উঁচু ভিটার ওপর ছিল পাকা বাংলো। নিচে খড়ের গাদা। বড় ভাই, যাঁকে তিনি দাদা ডাকতেন, তিনি টারজান দেখতেন খুব। মুখে ‘আ আ’ শব্দ করে লাফ দিতেন। যাকের তা দেখতেন। একবার দাদা একটা কাঠের পাটাতন নিয়ে চারদিকে রিকশার বল–বিয়ারিং দিয়ে বানিয়েছিলেন দড়িটানা গাড়ি। বাংলার সামনে পাকা রাস্তা দিয়ে চলত সে গাড়ি। তাতে শব্দ হতো ঘড়ঘড়। বাড়ির অদূরে বাঁধা ছিল এক ষাঁড়। ষাঁড় সে শব্দ পছন্দ করেনি। হঠাৎ দড়ি ছিঁড়ে পিছু নিল ষাঁড়। দাদা দিব্যি পালালেন। যাকের চুপচাপ বসে আছেন গাড়িতে। গাড়ি চলছে না বলে তখন শব্দ নেই। ষাঁড় শব্দ না পেয়ে আবার আস্তে আস্তে চলে গেল। যাকেরের জীবনে ভয়ের প্রথম অভিজ্ঞতা।
খুলনায় থিতু হলেন তাঁরা। বর্ণময় জীবনের শুরু। নীলা সিনেমা হলে (এখন পিকচার প্যালেস) নিয়ন সাইন দেখলেন জীবনে প্রথম। নতুন ছবি এলে মা আর দিদি রিকশায় করে নিয়মিত নীলায় চলে যেতেন। জীবনে প্রথম ছবি দেখা সেখানে। শরৎচন্দ্রের কাহিনি অবলম্বনে জনপ্রিয় ছবি। যাকেরের তা ভালো লাগেনি।
খুলনায় প্রিয় শখ ছিল, দাদা, দিদিসহ হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে কয়লাঘাটা পর্যন্ত যাওয়া। অদ্ভুত সুন্দর লাগত। খুলনায় থাকতেই প্রকৃতির সঙ্গে ভালোবাসা পোক্ত হলো।
এর পরের প্রেম কুষ্টিয়া। তত দিনে বাবা এডিসি (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক) হয়েছেন। যে এলাকায় তাঁরা থাকতেন, সেটা ব্রিটিশরা তৈরি করেছে। রাস্তার দুই ধারে কড়ইগাছ। তার ছায়ায় যাওয়া–আসা। ধানখেত। এরপর খরস্রোতা গড়াই নদ। দাদা কেবল সাঁতার শিখেছেন। একদিন খবর এল, গড়াই নদে দাদা ভেসে গেছেন। মারা গেছেন। বাবা ফিরে এলেন অফিস থেকে। সবাই তখন বলাবলি করছে এডিসি সাহেবের ছেলে গড়াই নদে পড়ে মরে গেছে। সবাই কাঁদছে। এ সময় দাদা একটা পেয়ারা চিবোতে চিবোতে দিব্যি এসে হাজির। বললেন, ‘আমি তো ভাসছিলাম। ডুবে যাইনি।’
এডিসি বাবা এবার কী করতে পারেন, ভেবে দাদা তো সিঁটিয়ে গেছেন। এরপর আলী যাকেরের চোখের সামনে ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা। বাবা এগিয়ে গেলেন দাদার দিকে। তারপর তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। এই প্রথম যাকের তাঁর বাবাকে কাঁদতে দেখলেন। এ রকম একের পর এক বিস্ময়ের পথ ধরেই কাটতে থাকল আলী যাকেরের শৈশব–কৈশোর।
বাবার আবার পদোন্নতি হলো। তিনি হলেন প্রাদেশিক সরকারের সচিব। এবার গন্তব্য ঢাকা। কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় আসার অভিজ্ঞতা আজও ভোলেননি আলী যাকের। ট্রেনের প্রথম শ্রেণিতে গোয়ালন্দ পর্যন্ত আসা। মায়ের এত দিনের সংসার, কত জিনিসপত্র। একটা ওয়াগনে সে আসবাবগুলোও চলল সঙ্গে। গোয়ালন্দে এসে এমু নামের জাহাজ! তিন দিনে এ জাহাজ পৌঁছাবে নারায়ণগঞ্জ! পথে পথে থামছে এমু। কারও কাছ থেকে দুধ, ইলিশ মাছ, মিষ্টি কেনা হচ্ছে। সে এক এলাহি ব্যাপার। জাহাজের গোটা প্রথম শ্রেণিটাই ছিল তাঁদের দখলে, কিন্তু জাহাজের ডেকেই খাওয়া, ডেকেই ঘুম!
ঢাকায় প্রথমে অভয় দাস লেনে, তারপর গেন্ডারিয়ায়। কামরুন্নেসা স্কুল ছিল বাড়ির কাছেই। বেল বাজলেই এত মেয়ে বেরিয়ে আসে! এর আগে এ নিয়ে যাকের ভাবেনইনি কখনো। এই প্রথম নারীদের ব্যাপারে সচেতনতা আর আগ্রহের সৃষ্টি হলো তাঁর।
গেন্ডারিয়ার বাড়িটি কেনা হয়েছিল সাড়ে ষোলো হাজার টাকায়। সব মিলে হাজার বিশেক টাকা খরচ হয়েছিল। বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডে হাত পড়েছিল বাড়ি কেনার সময়।
১৬ কাঠা জায়গায় দেড় তলা বাড়ি।
১৯৫৫ সালে বাবা ছেড়ে দিলেন সরকারি চাকরি। পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করলেন বাওয়ানি জুট মিলস আর বাওয়ানি টেক্সটাইলসে। অসুখ হলে তিনি হোমিওপ্যাথ সেবন করতেন। বুকে ব্যথা হলে মনে করতেন এটা গ্যাসের ব্যথা। একদিন অফিসের পথে তাঁকে বিদায় দিলেন পরিবারের সবাই। কিন্তু সে মানুষটা আর ফিরে এলেন না। ফিরল তাঁর লাশ। হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন মোহাম্মদ তাহের। সেটা ১৯৬১ সাল।
সেন্ট গ্রেগরি থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে যাকের ভর্তি হলেন নটর ডেম কলেজে, সেখান থেকে পাস করলেন ১৯৬২ সালে।
সংসার আর আগের মতো রইল না। বাড়ির নিচতলা ভাড়া দিয়ে পুত্র–কন্যা নিয়ে মা উঠে গেলেন দোতলার পৌনে দুই ঘরের বাড়িতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ড. সাজ্জাদ হোসেন পরিচয় করিয়ে দিলেন সমাজবিজ্ঞানের চেয়ারম্যান জন ই ওয়েনের সঙ্গে। বাংলা, ইংরেজি বা অর্থনীতি না পড়ে ওয়েন পরামর্শ দিলেন সমাজবিদ্যা (সোশিওলজি) পড়তে। সে বিষয়েই স্নাতক হলেন আলী যাকের।
তখন পর্যন্ত নাটকের ‘ন’ও জানেন না তিনি। এখানে একটি তথ্য দিয়ে রাখলে ভালো হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা মিলে একটা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা করেছিল। সেখানে যে কটি বিভাগে অংশ নিয়েছিলেন আলী যাকের, তার সব কটিতেই তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মাকে চিকিৎসার জন্য কলকাতা নিয়ে যাওয়ার সময় শম্ভু মিত্র আর উৎপল দত্তের বেশ কটি নাটক দেখেছিলেন তিনি। পরবর্তী জীবনে এই নাটক দেখার অভিজ্ঞতাই কাজে লেগেছিল তাঁর।
মা চলে যান ১৯৬৪ সালে, দিদি ১৯৬৫ সালে। এক ভয় এসে ঘিরে ধরেছিল তাঁদের।
স্নাতক পড়ার সময়ই ছাত্ররাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। সে সময়ই ছাত্র ইউনিয়ন মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী—এই দুভাগ হয়ে যায়। তিনি যোগ দিলেন মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নে।
অনার্স শেষ হওয়ার পর একদিন দাদা বললেন, ‘করাচি যাবি?’
গেলেন করাচি। কিছুদিন থাকার পর দেখলেন টাকাপয়সা শেষ হয়ে যাচ্ছে। লিখলেন চিঠি, ‘পয়সা ফুরিয়ে গেছে।’ দাদার উত্তর, ‘দুই শ টাকা পাঠাচ্ছি, এরপর নিজে কিছু করে জোগাড় করো।’
সে সময়ই ডন পত্রিকায় দেখলেন এক চাকরির বিজ্ঞাপন। ডন ক্রফোর্ডস বলে ব্রিটিশ এজেন্সিতে ট্রেইনি এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ শুরু করলেন।
কত দিন আর ভালো লাগে! ফিরতে ইচ্ছা হলো ঢাকায়। সেই ডন–এই দেখলেন ফ্যান্সি গ্রুপের বিজ্ঞাপন। এশিয়াটিক বলে একটি কোম্পানির ঢাকা অফিসে লোক নেওয়া হবে। তাঁরা ছিলেন কমার্স ব্যাংক, আইপিএস, ক্রিসেন্ট জুট মিলসের মালিক। সেখানে ঢুকে ঢাকায় ফিরলেন।
১৯৬৭ সালে করাচি গিয়ে ১৯৬৯ সালে ঢাকায় ফিরলেন।
দেশে ফিরে এশিয়াটিকে চাকরি করছিলেন। সারা দেশ তখন উত্তাল। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গেলেন। প্রশিক্ষণ নিলেন। কলকাতায় দেখা হলো চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাংবাদিক আলমগীর কবিরের সঙ্গে। সৈয়দ আমির আলী অ্যাভিনিউয়ে। তিনিই বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ময়দানের যুদ্ধের মতোই জরুরি হলো প্রচারযুদ্ধ। বিশ্ববাসীকে বোঝাতে হবে আমরা ন্যায়যুদ্ধ করছি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটা ইংরেজি সার্ভিস শুরু করছে, লেগে যাও।’ সেখানেই ছিলেন যাকের। প্রচারণা চালিয়েছেন। হয়েছেন শব্দসংগ্রামী।
নাট্যজন মামুনুর রশীদের সঙ্গে ছিল ‘তুই’ সম্পর্ক। একদিন মামুনুর রশীদ বলছিলেন, ‘দেশে গিয়া কী করবি?’
আলী যাকের বলেছিলেন, ‘নাটক করুম।’
আত্মবিশ্বাস ছিল আলী যাকেরের। ঢাকায় এলেন। কাজ শুরু করলেন। দায়িত্ব নিলেন এশিয়াটিকের।
ঢাকায় আসার পর মামুনুর রশীদ একদিন বললেন, ‘তুই না কইসিলি নাটক করবি! ২১ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর কবর নাটক করুম।’
হ্যাঁ, আমরা যে আলী যাকেরকে নিয়ে কথা বলছি, তিনি হচ্ছেন নাটকের এই আলী যাকের। আরণ্যকের কবর নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমেই তিনি নাট্যচর্চায় নিজেকে নিবেদন করেন। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকে প্রথম অভিনয়। ২০ ফেব্রুয়ারি একটি আর ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ও সন্ধ্যায় দুটি শো হয়েছিল নাটকটির। সকালের শো সরাসরি প্রচার করেছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। সেটা দেখেছিলেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি জিয়া হায়দার আর সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান। তাঁরা সন্ধ্যায় এসে আলী যাকেরকে নাগরিকে যোগ দিতে বলেন।
মামুনুর রশীদের সঙ্গে কথা হয়। এ সময় আরণ্যেকর নতুন কিছু নেই, তাই মামুনুর রশীদও ‘না’ করেন না। ওই বছরেরই জুন মাসে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দেন আলী যাকের। তখন থেকে নাগরিকই তাঁর নাটকসংক্রান্ত ঠিকানা।
বাংলাদেশের দর্শক দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখবে, এ ধারণা আগে ছিল না। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবের একটা অংশ ছিল নাটক। দর্শনীর বিনিময়ে নাটকের চিন্তাটা কিন্তু প্রথম আসে আলী যাকেরের মাথায়। বাকী ইতিহাস নাটকটি ব্রিটিশ কাউন্সিলে তিন সন্ধ্যার জন্য বুকিং দেওয়া হয়। যাকের বললেন, পরের সপ্তাহেও বুকিং দিই। অনেকেই অমত করলেন, কিন্তু যাকের বন্ধের দিন রোববার পরপর আট সপ্তাহ বুকিং দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। প্রথম শোতে এসেছিলেন ৩৫ জন দর্শক। দ্বিতীয় শো থেকে হাউসফুল।
এর কারণও আছে। নাটকের দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনা হয়েছিল। বেল পড়ার পর আর পর্দা নামে না, একবারেই পুরোটা নাটক হয়ে যায়—এ অভিজ্ঞতা দর্শকের ছিল না আগে। বিচিত্রায় শাহাদত চৌধুরী প্রচ্ছদ করলেন আলী যাকের, আতাউর রহমান, সারা আর নায়লার ছবি দিয়ে। এরপর ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে তাঁদের মিলনায়তনে নাটক করতে নিষেধ করে দেওয়া হয়। তখন সারা আর নায়লা মিলে মহিলা সমিতি খুঁজে বের করলেন। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বোরবার সকালে ছয়টি শো করে ফেললেন তাঁরা, বাকী ইতিহাস নামদিয়েই। বাকিটা সত্যিই ইতিহাস।
১. কবর (নির্দেশক মামুনুর রশীদ), ২. বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ (নির্দেশক আতাউর রহমান), ৩. বাকী ইতিহাস (নির্দেশক আলী যাকের), ৪. বিদগ্ধ রমণী কুল (নির্দেশক আলী যাকের), ৫. তৈল সংকট (নির্দেশক আলী যাকের), ৬. এই নিষিদ্ধ পল্লীতে (নির্দেশক আলী যাকের), ৭. দেওয়ান গাজীর কিস্সা (নির্দেশক আসাদুজ্জামান নূর), ৮. সৎ মানুষের খোঁজে (নির্দেশক আলী যাকের), ৯. অচলায়তন (নির্দেশক আলী যাকের), ১০. কোপেনিকের ক্যাপ্টেন (নির্দেশক আলী যাকের), ১১. ম্যাকবেথ (নির্দেশক ক্রিস্টোফার স্যানফোর্ড), ১২. টেমপেস্ট (নির্দেশক ডেবোয়া ওয়ারনার), ১৩. নূরলদীনের সারাজীবন (নির্দেশক আলী যাকের), ১৪. কবর দিয়ে দাও (নির্দেশক আতাউর রহমান), ১৫. গ্যালিলিও (নির্দেশক আতাউর রহমান, নতুন করে শুরু হয় পান্থ শাহরিয়ারের নির্দেশনায়), ১৬. কাঁঠাল বাগান [চেরি অরচার্ড] (নির্দেশক আলী যাকের)
নিঃসন্দেহে ব্রেশটের সৎ মানুষের খোঁজে নাটকটি ছিল আলী যাকেরের জীবনের একটি বাঁক। নাগরিক রাজনীতির জন্য নাটক করেনি, নাটকের জন্যই নাটক করেছে। কিন্তু সে নাটকগুলো জীবনের স্পর্শবিহীন নয়। ব্রেশট কীভাবে যাকেরের কাছে এসেছিল? ব্রেশটের ওপর প্রথম বইটি তিনি পেয়েছিলেন মশিউদ্দিন শাকেরের কাছ থেকে। বইটিতে তিনি লিখে দিয়েছিলেন ‘যাকেরকে শাকের’। ব্রেশটের কাছাকাছি হয়ে আলী যাকেরের মনে হয়েছে, ব্রেশটকে রাজনৈতিক নাট্যকার হিসেবে ভাবার দরকার নেই. তিনি স্লোগানসর্বস্ব নন।
মজার ব্যাপার, কোপেনিকের ক্যাপটেন, গ্যালিলিও, নূরলদিনের সারা জীবন, অচলায়তন, রক্তকরবী, দেওয়ান গাজীর কিস্সা করার পরও নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়কে অনেকেই স্রোতের বিপরীতে চলা নাট্যদল বলে মনে করে। কারণ, নাগরিক সরাসরি রাজনীতির কথা আনে না।
যাঁরা মঞ্চে আলী যাকেরের অভিনয় দেখেছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে স্বীকার করবেন নূরলদিন, দেওয়ান গাজী আরগ্যালিলিও চরিত্রে তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের কথা। এই তিনটি চরিত্রই আলী যাকেরের প্রিয় চরিত্র। আরও একটি চরিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু করা হয়ে ওঠেনি এখনো। সেটা হলো, শেক্সপিয়ারের কিং লিয়ার।
কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক বছর জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এরপর আবার যুক্ত হয়েছেন মঞ্চনাটকের সঙ্গে। ব্যবসায়ী হিসেবে সফল, এই সত্তরোর্ধ্ব বয়সে আবার কেন মঞ্চে আসা? হেসে বললেন আলী যাকের, ‘ব্যবসা তো পেটের খিদে মেটায়, বুকের খিদে মেটাতে হবে না?’ সেই খিদে মেটানোর চেষ্টায় আছেন বলেই আমরা আবার মঞ্চে তাঁকে দেখতে পাচ্ছি।
নামগুলো দেখুন। নাগরিকের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন জিয়া হায়দার, সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান। দলে যোগ দেন আলী যাকের, সারা আমিন (পরে সারা যাকের), নায়লা আজাদ, আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, ইনামুল হক, লাকী ইনাম। এরপর আরও দেখুন, খালেদ খান, নিমা রহমান, বিপাশা হায়াত, শিরিন বকুল, পান্থ শাহরিয়ার, অপি করিম, শামীমা নাজনীন। এ রকম তারকাবহুল নাট্যদল খুব কমই আছে বাংলাদেশে। শুরু থেকে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখনো তাঁদের নাট্যপ্রীতির স্বাক্ষর রাখছেন মঞ্চে।
মঞ্চের পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। আলী যাকের যে একজন অসাধারণ শক্তিমান অভিনেতা, তার প্রকাশ তিনি রেখেছেন মঞ্চে, টেলিভিশনে এবং সিনেমায়। টেলিভিশনে আজ রবিবার, বহুব্রীহি, তথাপি পাথর দেয়ালসহ অসংখ্য নাটকে অভিনয় করে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ৫০টির বেশি বেতার নাটক করেছেন। বেশ কিছু চলচ্চিত্রেও করেছেন অভিনয়। টেলিভিশনের জন্য মৌলিক নাটক লিখেছেন। সমসাময়িক বিষয়ে পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখিও করেন। বের হয়েছে বই, যার মধ্যে আছে সেই অরুণোদয় থেকে, নির্মল জ্যোতির জয়সহ অনেক বই। একজন শৌখিন আলোকচিত্রীও তিনি।
স্ত্রী স্বনামধন্য অভিনয়শিল্পী সারা যাকের। ১৯৭৩ সালে সারা যোগ দেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে। কিন্তু তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কিছু করে ওঠেননি। একজন অভিনয়শিল্পী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সে চরিত্রটি তুলে নিয়ে অভিনয় করেন সারা। আলী যাকেরই তাঁকে তৈরি করে নেন। এরপর সারা যাকের হয়ে ওঠেন মঞ্চের তুখোড় অভিনয়শিল্পী। আলী যাকের ও সারা যাকের বিয়ে করেন ১৯৭৭ সালে। এই পরিবারে দুই সন্তান। পুত্র ইরেশ যাকের অভিনয় করে সাফল্য পেয়েছেন। কন্যা শ্রিয়া সর্বজয়াও অভিনয় করছেন। পুরোপুরি নাট্য পরিবার এটি।
বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি গ্রুপের চেয়ারম্যান তিনি। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি। যুক্তরাজ্যের রয়েল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির পূর্ণ সদস্য। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ অনেক পুরস্কার। এবার পেলেন মেরিল–প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০১৯।