রম্য গল্প

আমরা খুব চাপে আছি, ভাই

‘মানুষ চাকরি ছাড়ে না, ছাড়ে বস।’

কথাটা কে বলেছিলেন, এখন আর মনে পড়ে না। ইদানীং সবকিছুই ভুলে যাই। এই ভুলে যাওয়া রোগের পেছনে দায়ী আমার চাকরি। আরও নির্দিষ্ট করে বললে—দায়ী আমার বস। কথায় কথায় বকাঝকা করে তিনি অফিসের সবার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। আমাদের প্রত্যেকেরই নানা রকম শারীরিক ও মানসিক জটিলতা দেখা দিতে শুরু করেছে।

এই যেমন মিনহাজ ভাইয়ের কথাই ধরুন। ভাইটি আমাদের আইটি অফিসার। ভদ্রলোক নাকি সেদিন দোকানে ওষুধ কিনতে গেছেন। দোকানদার জিজ্ঞেস করেছেন, ‘কত এমজি দেব? ২৫০ এমজি না ৫০০ এমজি?’

মিনহাজ ভাই আনমনে বলে ফেলেছেন, ‘২৫৬ এমবি।’

আহারে বেচারা। লোকটা সারা দিন আমাদের ইন্টারনাল নেটওয়ার্ক দেখেশুনে রাখেন, অথচ ‘গ্রেট ওয়ার্ক’ বলে বস কখনো তাঁর পিঠ চাপড়ে দেন না।

জামশেদ ভাইয়ের অবস্থা আরও গুরুতর। বয়স্ক মানুষ। সেদিন বলছিলেন, ‘জানেন ভাই, অফিসে যাওয়া-আসার পথে বারবার আমাকে টিফিন ক্যারিয়ার খুলে দেখতে হয়।’

বললাম, ‘কেন?’

ভাই বিমর্ষ মুখে বললেন, ‘আর বলবেন না। মাঝেমধ্যেই ভুলে যাই—আমি কি অফিসে যাচ্ছি, না অফিস থেকে ফিরছি। সে জন্য টিফিন ক্যারিয়ার খুলে নিশ্চিত হই। খাবার আছে মানে অফিসে যাচ্ছি, খাবার নেই মানে বাসায় ফিরছি।’

আমি ভয়ে ভয়ে জামশেদ ভাইকে নতুন করে দেখলাম। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, তাঁর অবস্থানে যেতে আমার খুব বেশি দেরি নেই।

আমাদের সবারই এ রকম নানা সমস্যা লেগেই আছে। মুহিত সেদিন বলছিল, বাসায় গিয়ে সে নাকি কলিং বেল চাপার বদলে ভুল করে অফিসের দরজা খোলার কার্ড পাঞ্চ করার জায়গা খুঁজতে থাকে। সঞ্জয় ছেলেটা কিছুদিন আগে বিয়ে করল। বাসরঘরে ঢোকার সময় দরজা খুলে সে নববধূকে বলেছিল, ‘স্যার, আসব?’

বউ বলল, আমি নাকি সারা রাত ঘুমের মধ্যে একটু পরপর মাথা দোলাই আর ‘হু হু’ শব্দ করি। কী ভয়ানক! অনেক ভেবে বুঝলাম, সমস্যা অন্য জায়গায়।

আমাদের জীবনের মধ্যে অফিস নয়, অফিসের মধ্যে জীবন ঢুকে গেছে। কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যে এক কাপ চা খাব, সে উপায়ও নেই। অফিসে দুটি লোক সব সময় আমাদের ঝাড়ির ওপরে রাখে। একজন বস, আরেকজন আমাদের ক্যানটিন বয় মজনু। মজনুকে যতই মিহি গলায় বলি না কেন, ‘মজনু ভাইয়া, এক কাপ চা দেবে?’

সে দুম করে বলে দেয়, ‘এখন পারব না। খুব চাপে আছি।’

আমার অবশ্য শুনে ভালোই লাগে। অফিসের সবাই যে কথাটা চিৎকার করে বলতে চায়, অন্তত কেউ একজন তো সেটা মুখফুটে বলে!

সবই চুপচাপ সয়ে যাচ্ছিলাম। বিপত্তি বাধল কদিন আগে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি, বউ আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। বললাম, ‘কী হয়েছে?’

বউ বলল, আমি নাকি সারা রাত ঘুমের মধ্যে একটু পরপর মাথা দোলাই আর ‘হু হু’ শব্দ করি। কী ভয়ানক! অনেক ভেবে বুঝলাম, সমস্যা অন্য জায়গায়। কাজের চিন্তায় বাসায় রাতে ভালো ঘুম হয় না। অফিসে এসে বাকি ঘুমটুকু সেরে নিই। মিটিংয়ে বসে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও একটু পর পর ‘হু হু’ শব্দ করে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার এক অদ্ভুত কৌশল আমি রপ্ত করে নিয়েছি। এই অভ্যাসই কাল হয়েছে।

বউয়ের পরামর্শে ডাক্তারের কাছে গেলাম। সব শুনে ডাক্তার বললেন, ‘হুম। আজকাল অনেকেরই এমন হচ্ছে। এই তো আমার এক পেশেন্ট, বড় অফিসার। সেদিন চেম্বারে এসে হঠাৎই বিরাট চিৎকার–চেঁচামেচি শুরু করলেন।’

‘কেন?’

‘কারণটা খুব অদ্ভুত। কাজের চাপে তাঁর আজকাল কিছু মনে থাকে না। কোথায়, কেন, কী করছেন, হঠাৎ হঠাৎ ভুলে যান। তখন যেকোনো একটা বিষয় ধরে চেঁচামেচি শুরু করেন, আর ভেতরে-ভেতরে মনে করার চেষ্টা করেন...’

বলতে বলতেই ডাক্তার হঠাৎ আমার পেছনে কাকে দেখে যেন খুশি হয়ে উঠলেন, ‘আরে খসরু সাহেব যে! আসুন আসুন। আপনার কথাই বলছিলাম।’

ডাক্তারকে অবাক করে দিয়ে আমি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘বস! আপনি এখানে?’