চিরায়ত রম্য

আজব বাজি

অলংকরণ: ফরিদুর রহমান

আজব এক বিষয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে অনেক দিনের বিবাদ। দুজনেরই বয়স হয়েছে। কেউই কারও চেয়ে কম যান না। অনেক যুক্তি-তর্কের পর একদিন তাঁরা ঠিক করলেন, বিবাদের মীমাংসা করবেন বাজি ধরে। যে জিতবে তাঁর কথাই মেনে নেবেন অপরজন। ইংরেজরা এমনই।

সে সময় ১০ লাখ পাউন্ডের দুটি ব্যাংক নোট চালু করে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। উদ্দেশ্য ছিল বৈদেশিক লেনদেন। একটা নোট খরচ করলেও অন্যটা ব্যাংকেই জমা ছিল। ঠিক সে সময় প্রথম ভাই দ্বিতীয় ভাইকে বললেন, ‘লন্ডনে আসা কোনো ভিনদেশিকে এই ব্যাংক নোট দিলে সে অনাহারে মারা যাবে।’ এটাই হলো বাজির বিষয়। সঙ্গে বললেন, ‘তবে শর্ত হলো লোকটাকে সৎ ও বুদ্ধিমান হতে হবে। সঙ্গে অন্য কোনো অর্থ থাকা যাবে না, লন্ডনে কোনো বন্ধু থাকাও চলবে না।’

দ্বিতীয় ভাই হুংকার দিয়ে বললেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না!’

প্রথম ভাই ব্যাখ্যা দিতে চাইলেন, ‘ব্যাংক কিংবা অন্য কোথাও এত বড় নোট ভাঙাতে গেলেই পুলিশ তাকে জেলে ঢোকাবে। সবাই ভাববে, সে নির্ঘাত নোটটা চুরি করেছে।’

এভাবেই তাঁদের বিতর্ক চলছিল। দিনের পর দিন। অবশেষে দ্বিতীয় ভাই সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে বাজির প্রস্তাব দিয়ে বললেন, ‘৩০ দিনের মধ্যে ব্যাংক নোটসহ সেই ভিনদেশি যদি জেলে না যায় তাহলে আমি ২০ হাজার পাউন্ড দেব। উল্টোটা হলে আমাকে দিতে হবে।’

প্রথম ভাই রাজি হয়ে গেলেন। ব্যাংকে গিয়ে ১০ লাখ পাউন্ডের নোটটি কিনে ফেললেন তিনি। বাড়ি ফিরেই বাজির বিষয়বস্তু উল্লেখ করে একটা চিঠি লিখলেন। তারপর অপেক্ষার পালা। দুই ভাই গিয়ে বসলেন জানালার সামনে।

রাস্তা দিয়ে মানুষ আসে, মানুষ যায়। তবে বাজির সব শর্ত পূরণ করে এমন মানুষ তাঁদের চোখে আর পড়ে না। কেউ দেখতে সৎ তবে চেহারায় যথেষ্ট বুদ্ধির ছাপ নেই। কাউকে বুদ্ধিমান মনে হলেও তারা ঠিক গরিব না। পথচারীদের অনেকে সৎ, বুদ্ধিমান ও গরিবও ছিল, তবে তারা অপরিচিত নয়।

ছুটে গেলাম রেস্তোরাঁর খোঁজে। সামনে যা পেলাম, সমানে গিললাম। যেন অনেক দিন কিছু খাইনি। বিল মেটানোর জন্য সবশেষে সেই খাম বের করলাম। নোটের দিকে ঠিকমতো তাকাতেই আমার মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা। দশ লাখ পাউন্ডের নোট!

ঠিক সে সময় জানালা দিয়ে তাঁরা আমাকে দেখলেন। তাঁদের দেখে মনে হলো, আমাকেই যেন তাঁরা খুঁজছেন। ভেতরে ডেকে হাজারো প্রশ্ন করে জেনে নিলেন আমার সব কথা। তারপরই ঠিক করলেন, তাঁদের বাজির জন্য আমার চেয়ে উপযুক্ত মানুষ আর হয় না।

আমি তখন বাজির কিছুই জানতাম না। তাঁদের অদ্ভুত কথাবার্তা মোটামুটি বিরক্তিকর ঠেকল। ব্যাখ্যা চাইলাম। দুই ভদ্রলোকের একজন আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন। আমি খুলতে চাইলাম। বাধা দিয়ে বললেন, ‘এখন না খুলে হোটেলে পৌঁছানো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তারপর সময় নিয়ে সযত্নে পড়বেন।’

কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বিষয়টি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাইলাম। তাঁরা কোনো উত্তর দিলেন না। আমি কি তাঁদের কৌতুকের বিষয়? খুব রাগ হলো। তাঁদের ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম। কিছুটা দূরে এসে খুলে ফেললাম খামটি। কী আশ্চর্য! ভেতরে টাকা! ২৪ ঘণ্টা ধরে অভুক্ত আমি, আর তর সইছিল না। চিঠি আর কে পড়ে!

ছুটে গেলাম রেস্তোরাঁর খোঁজে। সামনে যা পেলাম, সমানে গিললাম। যেন অনেক দিন কিছু খাইনি। বিল মেটানোর জন্য সবশেষে সেই খাম বের করলাম। নোটের দিকে ঠিকমতো তাকাতেই আমার মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা। দশ লাখ পাউন্ডের নোট!

হতবাক হয়ে সে নোটের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওই দুই ভদ্রলোক নিশ্চয়ই কোনো ভুল করেছেন। তাঁরা সম্ভবত আমাকে ১ পাউন্ডের নোট দিতে চেয়েছিলেন।

পেছন ফিরে দেখি, রেস্তোরাঁর মালিকও নোটটার দিকে তাকিয়ে আছেন। দুজনেরই হতবুদ্ধি হওয়ার দশা। বুঝতে পারছিলাম না কী বলা বা করা উচিত। সরল মনে সেই নোট রেস্তোরাঁর মালিকের হাতে দিয়ে বললাম, ‘দাম রেখে বাকিটা ফেরত দিন।’

রেস্তোরাঁর মালিক বললেন, ‘আপনার যখন ইচ্ছা তখন খাবারের দাম পরিশোধ করবেন। আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি খুবই ধনী মানুষ। সাধারণ পোশাক পরে মানুষের সঙ্গে কৌতুক করতে পছন্দ করেন...’

মালিক বারবার করে মাফ চাইলেন, ‘আমি খুবই দুঃখিত। নোটটা ভাঙিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।’

আমি জানালাম আমার কাছে আর নোট নেই। হাতের নোটটাই ভাঙিয়ে দিতে অনুরোধ করলাম। রেস্তোরাঁর মালিক বললেন, ‘আপনার যখন ইচ্ছা তখন খাবারের দাম পরিশোধ করবেন। আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি খুবই ধনী মানুষ। সাধারণ পোশাক পরে মানুষের সঙ্গে কৌতুক করতে পছন্দ করেন। আপনার যখন ইচ্ছা এখানে আসতে পারেন, যা ইচ্ছা, যত ইচ্ছা খেতে পারেন। পরে সুবিধামতো কোনো একসময় না হয় বিলটা পরিশোধ করবেন।’

অনুবাদ: মেহেদী হাসান

সূত্র: ‘দ্য মিলিয়ন পাউন্ড ব্যাংক নোট’ ছোটগল্পের দ্বিতীয় অধ্যায় (অ্যান আনইউজুয়াল বেট) থেকে [ঈষৎ সম্পাদিত]

মার্ক টোয়েন: বিশ্বখ্যাত মার্কিন সাহিত্যিক। অ্যাভেঞ্চারস অব হাকলবেরি ফিন এবং দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব টম সয়্যার তাঁর বিখ্যাত দুই উপন্যাস। মার্ক টোয়েনের জন্ম ১৮৩৫ সালে, মারা গেছেন ১৯১০ সালে।