স্ত্রী তালাক দিলেও দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে

পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

মিতি সানজানা
মিতি সানজানা

প্রশ্ন: ২০১৯ সালে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে স্ত্রী আমার সঙ্গে ঝগড়া করে তার বাবার বাড়িতে চলে যায় এবং আমাকে একটি তালাক নোটিশ পাঠায়।

আমি ও আমার পরিবার তাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি, যাতে সে ফিরে এসে আবার সংসারে মন দেয়। কিন্তু সে কোনো অবস্থাতেই ফিরে আসেনি। সে অনেক জেদি ও মেজাজি। সব সময় টাকাপয়সার জন্য চাপ দিত। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। ছোট একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। সব সময় তার অযৌক্তিক দাবি আমার পক্ষে মেটানো সম্ভব হতো না।

গত মাসে আমার স্ত্রী আমাকে এসএমএস পাঠিয়ে কাবিনের টাকা পরিশোধ করে দিতে বলে। আমাদের কাবিন ছিল ৫ লাখ টাকা। কিন্তু এখন সে বলছে ১০ লাখ টাকা কাবিন। আমাকে সে কাবিননামার ফটোকপির ছবি পাঠিয়েছে, যেখানে ১০ লাখ টাকা লেখা আছে। আমাদের আসল কাবিনে ৫ লাখ লেখা, গয়না বাবদ ২ লাখ টাকা উশুল দেখানো হয়েছে। আমি কোনো তালাকনামাতে সই করিনি। আমার কয়েকটি প্রশ্ন আছে।

১. আমাদের তালাক হয়েছে কি? কারণ, আমি কোথাও কোনো সই করিনি।

২. যদি স্ত্রী তালাক দেয়, তাহলে কি কাবিনের টাকা আমাকে দিতে হবে?

৩. সে আমার কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করছে। কিন্তু আমাদের কাবিনে টাকার পরিমাণ ৫ লাখ। তাকে কত টাকা দিতে হবে?

রিমন, ঢাকা

উত্তর: যদি কোনো স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ চান, তাহলে তাঁর সেই অধিকার রয়েছে। কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামটিতে যদি আপনার স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়ে থাকে, তাহলে তিনি সরাসরি আপনাকে তালাক দিতে পারেন। আর ১৮ নম্বর কলামে যদি কোনো ক্ষমতা না দেওয়া থাকে, তাহলে আদালতে যেতে হয়। স্ত্রীর তালাকের ক্ষমতা না থাকলে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে তালাকের ডিক্রি নিতে হয়।

আপনার স্ত্রী যেহেতু আপনাকে ইতিমধ্যে তালাকের নোটিশ প্রদান করেছেন, কাজেই ধরে নিচ্ছি কাবিননামাতে দেওয়া ক্ষমতাবলেই তিনি নোটিশটি দিয়েছেন।

তালাক দেওয়ার বিষয়ে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে, তালাক দিতে চাইলে যেকোনো পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর অন্য পক্ষ যে এলাকায় বসবাস করছেন, সে এলাকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/ পৌরসভার মেয়র/ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে। সেই সঙ্গে তালাকগ্রহীতাকে ওই নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে।

চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে যে তারিখে নোটিশ পৌঁছাবে, সেদিন থেকে ৯০ দিন পর বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক কার্যকর হয়ে থাকে। এ নোটিশ পাওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে সালিসি পরিষদ গঠন করে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে। আপনার চিঠি থেকে মনে হচ্ছে, নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে মীমাংসার কোনো উদ্যোগ হয়নি এবং ইতিমধ্যে অনেক সময় পার হয়ে গেছে। কাজেই আপনার স্ত্রীর দেওয়া তালাক কার্যকর বলে গণ্য করা হবে।

আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলতে চাই, অনেকের মধ্যে একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় কিংবা আগে তালাকের নোটিশ পাঠান, তাহলে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে না। এই ধারণা সঠিক না। স্ত্রী তালাক দিলেও তাঁর মোহরানা পরিশোধ করতে হবে।

আপনার শেষ প্রশ্নে আপনি জানতে চেয়েছেন, তাঁকে দেনমোহর বাবদ কত টাকা দিতে হবে বা তিনি আপনার কাছ থেকে ভরণপোষণ বাবদ কত টাকা পাবেন। কাবিননামা অনুযায়ী তাঁর যা প্রাপ্য, সেই টাকাই তিনি পাবেন। আপনি বলেছেন, কাবিননামায় দেনমোহরের পরিমাণ ৫ লাখ টাকা উল্লেখ করা আছে এবং এর মধ্যে গয়না বাবদ ২ লাখ টাকা উশুলের কথা উল্লেখ আছে। সে ক্ষেত্রে তিনি দেনমোহর বাবদ ৩ লাখ টাকা পাবেন। এ ছাড়া যদি স্ত্রীকে আগে কোনো ভরণপোষণ না দেওয়া হয়, এ বকেয়া ভরণপোষণসহ ইদ্দতকালীন (তালাকের নোটিশ প্রদান থেকে তালাক কার্যকর হওয়া পর্যন্ত সময়) ভরণপোষণও প্রদান করতে হবে।

যদি আপনার মনে হয়, কাবিননামা জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে জাল কাবিননামা তৈরির জন্য প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলা করতে পারবেন। যদি কেউ মিথ্যা ও অবৈধ অর্থ লাভের আশায় জাল নিকাহনামা তৈরি করেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে প্যানাল কোডের ৪৬৪/৪৬৫/৪৬৮/৪৭১/৩৪ ধারায় মামলা করা যাবে। দণ্ডবিধির ৪৬৫ ধারায় জালিয়াতির শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি জালিয়াতি করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডসহ উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

দণ্ডবিধির ৪৬৬ ধারা অনুযায়ী আদালতে নথি বা সরকারি রেজিস্টার ইত্যাদিতে জালিয়াতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বিচারালয়ের নথিপত্র বা মামলার বিবরণী-সংক্রান্ত কোনো দলিল বা জন্মনামকরণ, বিয়ে বা শবসংক্রান্ত রেজিস্টার হিসেবে গণ্য বা সরকারি সার্টিফিকেট জাল করেন, তাহলে দায়ী ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ অপরাধ জামিনযোগ্য নয়। ৪৬৭ ধারার অধীন দণ্ডনীয় অপরাধ জালিয়াতিতে সহায়তার কারণেও হতে পারে।

পাঠকের প্রশ্ন, বিশেষজ্ঞের উত্তর

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে।

ই–মেইল ঠিকানা: adhuna@prothomalo.com

(সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)

ডাক ঠিকানা: প্র অধুনা,

প্রথম আলো, ১৯ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’), ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA