‘আদিম’ ছবির পরিচালক যুবরাজ শামীম ও দেশের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী জয়া আহসান
‘আদিম’ ছবির পরিচালক যুবরাজ শামীম ও দেশের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী জয়া আহসান

‘আহারে আমরা কি জীবনে কোনো দিন এ রকম অভিনয় করতে পারব,’ আদিম দেখে জয়া

৪৪তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে নেটপ্যাক জুরি পুরস্কার জেতে বাংলাদেশের ‘আদিম’ ছবিটি। এরপর আরও কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হয়েছে। ছবিটির কথা পৌঁছে যায় দেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসানের কান পর্যন্ত। তিনিও ছবিটি দেখার উপায় খুঁজছিলেন। অবশেষে তিনি বুয়েট ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগে ‘চলতরঙ্গ’ শিরোনামে আয়োজিত চলচ্চিত্র উৎসবে দেখে ফেললেন ছবিটি। মুগ্ধতাও প্রকাশ করলেন। পাঁচ দিনব্যাপী সিনে সপ্তাহের বুধবার শেষ দিন।

২০১৮ সালে ‘আদিম’ ছবির নির্মাণকাজ শুরু করেন যুবরাজ শামীম। শুটিংয়ে নানা বাধাবিপত্তি পেরোতে হয়েছে। অর্থাভাবে কখনো শুটিং বন্ধও থেকেছে। শেয়ার বিক্রি করে অর্থ সংস্থান করে সিনেমার কাজ চালিয়ে গেছেন নির্মাতা। ৫৩ জন শেয়ার কিনে সিনেমার অর্থায়নে অবদান রেখেছেন। পরিচালক বললেন, ‘এখন কিছু মানুষ আমাকে চেনেন, তখন আমাকে কেউ চিনতেন না। না চিনেও আমার ওপর আস্থা রাখলেন, এটা আমার কাছে আশ্চর্য লাগে।’ গত ২৬ মে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘আদিম’।

‘আদিম’ ছবিটি দেখার পর জয়া আহসানের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। ছবিটি সম্পর্কে নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে মঙ্গলবার বিকেলে প্রথম আলোকে জয়া বললেন, ‘ভালো। খুব ভালো লাগল। অনেক দিন পর মনে হলো একটা ভালো ছবি দেখলাম। খুবই অরিজিনাল ছবি দেখলাম। বাংলাদেশের অসাধারণ একটা ছবি দেখলাম। আমি জাস্ট মুগ্ধ হয়ে গেছি।’

‘আদিম’ দেখা শেষে কথা বলছিলেন জয়া আহসান

২০১৭ সালে সিনেমাটি নির্মাণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন পরিচালক যুবরাজ শামীম। সিনেমার চরিত্রকে কাছে থেকে দেখতে দিনের পর দিন বস্তিতে কাটিয়েছেন তিনি। বস্তির বাসিন্দাদের মধ্য থেকেই সিনেমার শিল্পী খুঁজে নেন যুবরাজ। সিনেমার প্রধান চরিত্র ল্যাংড়ার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বাদশা। ৩৫ জনের মধ্যে থেকে তাঁকে বাছাই করা হয়। সিনেমার বাকি চরিত্রের মধ্যে সোহাগী খাতুন, দুলাল মিয়া, সাদেককেও বস্তিতেই খুঁজে পেয়েছেন নির্মাতা। নির্মাতা প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, ছবির প্রয়োজনেই বস্তির বাসিন্দাদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন, তাঁদের জীবনের গল্প তাঁরাই ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন।

জয়া আহসানের কথায় অপেশাদার অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে পরিচালকের ছবি বানানোর বিষয়টিও ওঠে আসে। বিষয়টি জয়া বললেন এভাবে, ‘নন–অ্যাক্টরদের এমন লেভেলের অভিনয় করিয়েছে পরিচালক, এটা তো অভিনয় করানো বলাটা ভুল। আমার কাছে মনে হয়েছে, বাস্তব জীবনের কোনো চিত্র দেখছি। আমরা তো সমাজের একটা উঁচুতলায় বাস করি। কিন্তু সমাজের এই তলার মানুষের দুঃখ, আবেগ, স্ট্রাগল, তাঁদের জীবনের আনন্দ, প্রেম, বিবাহ—এগুলো যেসব জায়গায় এক্সিস্ট করে, সেগুলোর এত চমৎকার রূপায়ণ অবাক করার মতো। ছবির দর্শনটা তো অদ্ভুত সুন্দর—যে কারণে নামটাও বুঝি “আদিম”।’

দর্শকসারিতে বসে ‘আদিম’ উপভোগ করছিলেন জয়া আহসান, ডান পাশে পরিচালক যুবরাজ শামীম

কথায়–কথায় জয়া এ–ও বললেন, ‘আমার মনে হয়েছে, এই ছবি থেকে যাওয়ার মতোই ছবি। এত চুপচাপ থেকে একটা মানুষ এত সুন্দর একটা ছবি বানাতে পারে, ভাবা যায় না। অনেক দিন ধরে আমার ছবিটি দেখার ইচ্ছা ছিল। আমি পরিচালককে বলছিলামও, তারপরও বারবার মিস করে ফেলছিলাম। তখন জানানো হলো বুয়েটে এই উৎসবের কথা। যদিও হলটা খুব ছোট, অ্যামেচার ভঙ্গিতে প্রদর্শনীটা হয়েছে, তারপরও আমি দেখলাম।’

জয়া আহসান

‘আদিম’ দেখে এখন যেভাবে ভালো লাগাটা প্রকাশ করছেন, দেখার আগে কি এমনটা হবে ভেবেছিলেন, এমন প্রশ্নে জয়া আহসান বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম ভালো। কারণ, রাশিয়ার মতো একটা জায়গায় এত বড় ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নেটপ্যাক অ্যাওয়ার্ড এবং আরও কয়েকটা ইমপর্ট্যান্ট উৎসবে ঘুরে এসেছে ছবিটি। দেশের যাঁরা ক্রিটিক, তাঁরাও ছবিটির প্রশংসা করেছেন। তখনই ভেবেছিলাম, ছবিটার ভেতরে নিশ্চয় কিছু একটা আছে। আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগল যে বিষয়টা, আমরা যে ছবিগুলো দেখি, উৎসবে যায়, মনে হয় যে ফেস্টিভ্যালে দেখানোর কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়। কিন্তু এই ছবিটা না দর্শকের কথা মাথায় না রেখে বানিয়েছে পরিচালক। এই গল্পটা চাইলে কোনো ফর্মুলায় ফেলেও বানাতে পারত। কিন্তু পরিচালক এমনভাবে গল্পটা বলতে চেয়েছে, মনে হয়েছে, তারা এটাই বলতে চায়। চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে অনেস্টি থাকা জরুরি। যাঁদের আমরা সো–কল্ড বড় পরিচালক ধরি, তাঁরাও প্রথম ছবিটায়ও অনেস্ট থেকেছেন দেখেছি। শামীমও খুব অনেস্ট থেকেছে। মনে হয়েছে, “আমি এটাই বানাতে চেয়েছি, এটাই বানাব”।’

পরিচালক যুবরাজ শামীম

জয়া আহসান এ–ও বললেন, ‘অদ্ভুতভাবে, এই ছবির মধ্যে হিউমার ছিল, হলভর্তি লোক হাসছেন, রিঅ্যাক্ট করছেন। যেসব জায়গায় রিঅ্যাক্ট ও হাসার কথা, দুঃখ পাওয়ার কথা। ছোট ছোট আবেগ এত সুন্দরভাবে পরিচালক ধারণ করেছে, আমি তা অনেক দিন অনেক ছবিতেই দেখেনি। ভারতীয় অনেক ছবিতেও এমনটা দেখিনি। ইমোশনগুলো এত সুন্দরভাবে তৈরি করেছে, কোথাও সুর কাটেনি, তাল কাটেনি, এডিটিংও, আর মেকিং তো দারুণ। এমনিতে অভিনয় দেখে তো ছিটকে গেছি। আমার মনে হয়েছে, আহারে আমরা কি জীবনে কোনো দিন এ রকম অভিনয় করতে পারব। এই ছবিতে সবাই এত ভালো অভিনয় করেছে, আমি কোনো দিন তা পারব না। কী ইনোসেন্স, কী সুন্দর, কী নির্ভুল। অসাধারণ অসাধারণ!’

‘আদিম’ সিনেমায় রাস্তাঘাটে, স্টেশনে, ট্রেনে, বাসে, গলিতে, মোড়ে যেসব নামহীন মানুষ শহরের সঙ্গে অদৃশ্য সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, তাঁদের মধ্যে কেউ আছে মুঠোফোনচোর, কেউ মুদি দোকানের কর্মচারী

কথার একেবারে শেষে এসে পরিচালকের প্রতি একরকম আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন জয়া আহসান। তিনি বলেন, ‘পরিচালকের মধ্যে যে সততা আছে, শুদ্ধতা আছে—এটা যেন তার দ্বিতীয় ছবি এবং পরের ছবিগুলোতে থাকে। সাধারণত কোনো ফিল্ম মেকার যখন অনেক নাম পেয়ে যান, অনেক খ্যাতি পেয়ে যান, ছবিটার প্রশংসা যখন সবাই করতে থাকেন, তখন কিন্তু সেকেন্ড ছবিটা বানানোর সময় অনেক হিসাব কষে বানান। আমি অপেক্ষা করব যে শামীম যাতে পরের ছবিটার ক্ষেত্রেও একই রকম সততা ও শুদ্ধতা বজায় রেখে যেন বানায়।’