৯৫তম অস্কার

‘মা, আমি এইমাত্র অস্কার জিতেছি’

এবারের অস্কারে এশীয়দের জয়জয়কার। আবার প্রথমবার মনোনয়ন পেয়েই অস্কার পাওয়ার দিক থেকেও হয়েছে নতুন রেকর্ড।

একাডেমি অ্যাওয়ার্ডস বা অস্কারের এবারের আসরটি ছিল জমজমাট। অস্কার হাতে (বাঁ থেকে) সেরা পার্শ্ব অভিনেতা কে হুই কোয়ান, সেরা অভিনেত্রী মিশেল ইয়ো, সেরা অভিনেতা ব্রেন্ডন ফ্রেজার ও সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী জেমি লি কার্টিস। স্থানীয় সময় রোববার যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের হলিউডে
ছবি: রয়টার্স

ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য টেম্পল অব ডুম-এর সেই ‘শর্ট রাউন্ড’ চরিত্রে অভিনয় করা ১১ বছরের ছেলেটার কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। যে ইন্ডির (হ্যারিসন ফোর্ড) সঙ্গী হয়ে মোলা রামের (অমরেশ পুরী) আস্তানায় ঢুকে অশুভ পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছিল। ১৯৮৪ সালে সিনেমাটির পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ ৬০ হাজার ছেলের মধ্য থেকে শর্ট রাউন্ড চরিত্রটির জন্য বেছে নিয়েছিলেন কে হুই কোয়ানকে।

ভিয়েতনামে জন্ম নেওয়া সেই কোয়ান এবার সেরা সব অভিনেতার অস্কার জিতে নতুন ইতিহাসের অংশ হলেন। সজল চোখে পুরস্কারটি হাতে নিয়ে ৮৪ বছর বয়সী মায়ের উদ্দেশে বললেন, ‘মা, আমি এইমাত্র অস্কার জিতেছি।’

এবারের ৯৫তম অস্কারের (পোশাকি নাম একাডেমি অ্যাওয়ার্ড) আসরে অবশ্য মন জয় করে নেওয়ার তালিকা বেশ দীর্ঘ। আর সত্যিকার অর্থেই এবার অস্কারের ইতিহাসের অংশ হওয়ার তালিকাও যথেষ্ট লম্বা।

একদিকে ছিল এশিয়ার জয়জয়কার, অন্যদিকে প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়েই অস্কার জিতে নেওয়ার সংখ্যাও অনেক বেশি। এশিয়ার মধ্যেও আবার ভারতেই গেল প্রথমবারের মতো দুই অস্কার। এটাও এক নতুন রেকর্ড। তবে সবার মনেই একটা শঙ্কা ছিল, নতুন কী বিতর্ক সৃষ্টি হয়, তা নিয়ে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতিও কম ছিল না। তবে সব শঙ্কা উড়িয়ে তো দিয়েছেই, পাশাপাশি এ আসর ছিল নানা দিক থেকেই ব্যতিক্রম।

এশিয়ার জয়জয়কার

অস্কারের ৯৫ বছরের ইতিহাসে এর আগে কোনো এশিয়ান নারী সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পাননি। এশিয়ার জন্য সেই পথ খুলে দিয়েছেন ৬০ বছর বয়সী মালয়েশিয়ান অভিনেত্রী মিশেল ইয়ো। এভরিথিং এভরিহয়্যার অল অ্যাট ওয়ানস সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সেরা হয়েছেন। আর সেরা সহ–অভিনেতার কথা আগেই বলা হয়েছে। কে হুই কোয়ান জিতেছেন একই সিনেমার জন্য। এই সিনেমার জন্য সেরা পরিচালকের অস্কার পাওয়া দুই পরিচালকের একজন হলেন ড্যানিয়েল কোয়ান। তাঁরও যোগসূত্র আছে এশিয়ার সঙ্গে। কোয়ানের বাবা হংকংয়ের নাগরিক, মা তাইওয়ানের।

এশিয়ার বাকি দুই পুরস্কার পেয়েছেন ভারতীয়রা। স্বল্পদৈর্ঘ্যে তথ্যচিত্র বিভাগে তামিল ভাষায় নির্মিত ভারতীয় সিনেমা দ্য এলিফেন্ট হুইসপারস অস্কার জিতে নেয়। ৪১ মিনিটের এ তথ্যচিত্রে এক হাতির সঙ্গে আদিবাসী দম্পতির মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে যাওয়ার গল্প বলা হয়েছে। তথ্যচিত্রটির নির্মাতা কার্তিকী গঞ্জালভেস এবং প্রযোজনায় ছিলেন গুণীত মোঙ্গা। গোলাপি জামদানি পরে অস্কার মঞ্চে উঠেও নজর কেড়েছেন দ্য লাঞ্চবক্স, মাসান, পাগলায়িত, গ্যাংস অব ওয়াসিপুর-এর মতো সিনেমার প্রযোজক গুণীত মোঙ্গা।

তবে অস্কারের আসর এবার জমিয়ে দিয়েছে ‘নাটু নাটু’ গানটি। মঞ্চে তো গানটির সঙ্গে নাচ ছিলই, আবার সেরা মৌলিক গানেও অস্কার জিতে নেয় এটি। হারিয়ে দেয় লেডি গাগা ও রিয়ানাকে। ‘নাটু নাটু’র সুরকার এম এম কিরাভানি এবং গীতিকার চন্দ্রবোস মঞ্চে উঠে পুরস্কার গ্রহণ করেন। ঘোষণার সময় আরআরআর সিনেমার প্রায় পুরো দল উল্লাস তো করেছেই, লেডি গাগার উচ্ছ্বাসও ছিল চোখে পড়ার মতো। ভারতীয় সিনেমায় যেভাবে নাচ ও গান উপস্থাপন করা হয়, তা অনেক দিনই পশ্চিমাদের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

এ ধারা প্রথম ভেঙেছিলেন এ আর রাহমান, ‘জয় হো’ গানটি দিয়ে। যদিও স্ল্যামডগ মিলিয়নিয়ার সিনেমাটি ভারতীয়দের তৈরি করা ছিল না। কিন্তু ‘নাটু নাটু’ পুরোটাই ভারতীয়। এবারের আসরে আরেক আকর্ষণ ছিলেন দীপিকা পাড়ুকোন। তিনি নব্বই দশকের নায়িকার সাজে এসে ‘নাটু নাটু’ গানকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।

প্রথমবারেই বাজিমাত

কেবল অভিনয়ের জন্য এবার মনোনীত ছিলেন ২০ জন। এর মধ্যে ১৬ জনই প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়েছিলেন। মজার বিষয় হলো সেরা অভিনেতা, অভিনেত্রী এবং সেরা সহ–অভিনেতা ও সহ–অভিনেত্রীর অস্কার পাওয়া চারজনই প্রথম মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবারই জিতে নিয়েছেন। এর মধ্যে মিশেল ইয়ো এবং কে হুই কোয়ানের কথা আগেই বলা হয়েছে। অন্য দুজন হলেন দ্য হোয়েল সিনেমা থেকে সেরা অভিনেতার অস্কারজয়ী ব্রেন্ডন ফ্রেজার এবং এভরিথিং এভরিহয়্যার অল অ্যাট ওয়ানস থেকে সেরা সহ–অভিনেত্রীর অস্কার পাওয়া জেমি লি কার্টিস।

১৯৯০ সাল থেকে হলিউডে অভিনয় করলেও ৫৪ বছর বয়সী ব্রেন্ডন ফ্রেজারকে সাধারণ দর্শকেরা চিনতেন দ মাম্মির মতো নানা ধরনের ফ্যান্টাসি ও কমেডি সিনেমার জন্য। আর জেমি লি কার্টিসের পরিচয় ছিল হরর সিনেমার ‘ভয়ের রানি’ হিসেবে। আবার অনেকে হয়তো মনে রেখেছেন ট্রু লাইস সিনেমার আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগারের স্ত্রীর চরিত্রটির জন্যও। তারকা পিতা টমি লি কার্টিস ও হিচককের সাইকো সিনেমাখ্যাত জেনেট লেই-এর কন্যা জেমি লি কার্টিস ৬৪ বছর বয়সে প্রথম মনোনয়ন পেয়েই বাজিমাত করলেন।

অস্কারে মাকে নিয়ে বক্তৃতা

অস্কারজয়ীরা পুরস্কার হাতে নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পান। কে কী বললেন, তা নিয়ে চর্চা চলে বহুদিন। এবারও অনেকের কথা মন ছুঁয়েছে। এর মধ্যে সবার ওপরে থাকবেন কে হুই কুয়ান।

প্রথম অস্কার হাতে নিয়ে কেঁদে ফেলেছেন তিনি। তারপর বলেছেন, ‘আমার মায়ের বয়স ৮৪ বছর। তিনি বাড়িতে বসে দেখছেন। মা, আমি এইমাত্র অস্কার জিতেছি।’ তিনি এরপর আরও বলেন, ‘আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল এক নৌকায়। এরপর এক বছর কেটেছে শরণার্থী ক্যাম্পে। সেখান থেকে হলিউডের সবচেয়ে বড় মঞ্চে। অনেকে বলেন এমন গল্প শুধু সিনেমাতেই সম্ভব। বিশ্বাস করতে পারছি না যে এমনটা আমার জীবনেও ঘটল।’

মাকে নিয়ে কথা বলেছেন মিশেল ইয়োও। পুরস্কার হাতে জানিয়েছেন, তাঁর ৮৪ বছর বয়সী মা মালয়েশিয়ায় বসে অস্কারের অনুষ্ঠানে মেয়েকে দেখছেন। মাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বললেন, ‘এই পুরস্কার পৃথিবীর সব মায়ের জন্য, কারণ তাঁরাই আসল সুপারহিরো। তাঁদের ছাড়া আজ রাতে আমরা কেউই এখানে থাকতে পারতাম না।’

গতবারের সেই চড়–কাণ্ড

অস্কার সঞ্চালক হিসেবে জিমি কিমেল এবার হ্যাটট্রিক করলেন। টপ গান: মেভেরিক সিনেমার সেই ফাইটার প্লেন থেকে লাফিয়ে মঞ্চে নামার অভিনয় করে শুরুতেই চমক দিয়েছেন। তারপর টানা প্রায় ১৪ মিনিট কথা বলে পুরো মঞ্চ মাতিয়ে রাখেন। ‘নাটু নাটু’ গানের নাচের শিল্পীরা যেভাবে তাঁকে মঞ্চছাড়া করেন, সেটিও ছিল চমকে ভরা। এর আগে মজার ছলেই তুলে এনেছিলেন গত আসরের চড়–কাণ্ডকে। গত বছর উইল স্মিথ মঞ্চে থাকা ক্রিস রককে সপাটে চড় মেরেছিলেন।

সেই ঘটনায় উইল স্মিথকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে অস্কার কর্তৃপক্ষ। জিমি কিমেল অবশ্য একবারও উইল স্মিথের নাম উচ্চারণ করেননি। নাম না নিয়েই তিনি একপর্যায়ে বললেন, ‘এই বছর পাঁচজন আইরিশ অভিনেতা মনোনীত হয়েছেন। তাই মঞ্চে মারধর হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতেই পারে।’ এরপর এ নিয়ে আরও বলেন, ‘এবার আমাদের নিয়ম কঠোর।

এখানে কোনো হিংসার ঘটনা ঘটলে তাঁকে সেরা অভিনেতার অস্কার দেওয়া হবে এবং একই সঙ্গে ১৯ মিনিট বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগও দেওয়া হবে।’ বলে রাখা ভালো উইল স্মিথ গত আসরে সেরা অভিনেতার অস্কার পেয়েছিলেন। সবশেষে জিমি কেমেল জানান, যেকোনো অঘটন ঠেকাতে এবার অনুষ্ঠানস্থলে একটি ক্রাইসিস টিম রাখা আছে।

ছিল রাশিয়া ও পুতিনের নামও

অস্কার মঞ্চে রাজনৈতিক প্রতিবাদ পরিহার করতেই সাধারণত বলা হয়। তারপরও অতীতে অনেকেরই বক্তব্যে ঠিকই রাজনীতি চলে এসেছিল। এ জন্য অস্কার মঞ্চে নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনাও আছে। আর এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলছে। সুতরাং বিষয়টি যে উঠে আসতে পারে, তা অনুমিতই ছিল।

এবার সেরা তথ্যচিত্রের পুরস্কার জিতে নিয়েছে নাভালনি। রাশিয়ার সমাজকর্মী অ্যালেক্সেই নাভালনি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনবিরোধী হিসেবে পরিচিত। ২০২০ সালে তাঁর ওপর বিষপ্রয়োগ এবং তাঁর বেঁচে যাওয়ার ঘটনাই এ তথ্যচিত্রের বিষয়। রাশিয়ার কারাগারে এখনো বন্দী নাভালনি। তথ্যচিত্রটির পরিচালক কানাডার ড্যানিয়েল রোহের পুরস্কার হাতে নিয়ে বলেন, ‘এ পুরস্কার আমি সারা বিশ্বের রাজনৈতিক বন্দীদের উৎসর্গ করলাম।’

এরপর তিনি ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলাকে ‘অনৈতিক যুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘একনায়ক মাথাচাড়া দিলে তার বিরোধিতা করতে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।’ পুরো দলের সঙ্গে মঞ্চে উঠেছিলেন নাভালনির স্ত্রী ইউলিয়া। তিনি এ সময় বলেন, ‘অ্যালেক্সেই, আমি সেই দিনের স্বপ্ন দেখছি, যেদিন তুমি মুক্ত হবে এবং সেই সঙ্গে আমাদের দেশও মুক্ত হবে।’

সব মিলিয়ে এবার ছিল এভরিথিং এভরিহয়্যার অল অ্যাট ওয়ানস-এরই বছর। সর্বোচ্চ ১১টি মনোনয়ন পেয়ে সাতটিতেই জিতেছে এ সিনেমা। এর মধ্যে সেরা চলচ্চিত্র ও সেরা পরিচালক তো আছেই। এ সিনেমার দুই পরিচালকের বয়স মাত্র ৩৫ বছর। ড্যানিয়েল কোয়ান ও ড্যানিয়েল শেইনার্টকে একসঙ্গে ডাকা হয় ড্যানিয়েলস নামে। আবার সেরা তথ্যচিত্র নাভালনির পরিচালকের নামও ড্যানিয়েল রোহের। সুতরাং বলাই যায় এবার ড্যানিয়েলদেরও জয়জয়কার।

অন্যদিকে জার্মানির সিনেমা অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট সাতটি মনোনয়ন থেকে জিতে নিয়েছে চারটি অস্কার। এর মধ্যে বিদেশি ভাষায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র রয়েছে। তবে দুর্ভাগ্য দ্য বানশিজ অব ইনিশেরিনর-এর। নয়টি মনোনয়ন পেয়ে একটিও জিততে পারেনি। সুতরাং কেবল উচ্ছ্বাস নয়, হতাশার খবরও আছে। কেননা এ সিনেমার পরিচালক মার্টিন ম্যাকডোনাগের ভক্ত সংখ্যা মোটেই কম নয়।