জীবনে মানুষ তো কম দেখিনি। আদর্শের হাত ধরে শুরু করেন, সময় পাল্টে গেলে হাত ঝেড়ে ফেলেন। মৃণাল সেনের মধ্যে ছিল আদর্শের এক অটলতা। কাজটা করতে করতে যতই মৃণাল সেনের চরিত্রের গভীরে ঢুকেছি, ততই দেখেছি মানুষ হিসেবে তাঁর উচ্চতা। ব্যক্তি মৃণাল সেন যেন পরিচালক মৃণাল সেনকে ছাপিয়ে গেছেন বহু বহুদূর।
বাংলাদেশের ফরিদপুরে মৃণাল সেন জন্মেছিলেন ১৯২৩ সালের এই দিনে, ঠিক ১০০ বছর আগে। কলকাতায় গিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নন্দিত চলচ্চিত্রকার। ভুবন সোম, আকালের সন্ধানে, একদিন প্রতিদিন বা খণ্ডহর–এর মতো ছবি করে তাঁর ঠাঁই হয়েছিল সত্যজিৎ–ঋত্বিক–মৃণাল এই বিখ্যাত ত্রয়ীতে; চোখ কেড়ে নিয়েছিলেন সারা দুনিয়ার। আর এত বছর পরে আমি কলকাতায় গেলাম, পর্দায় সেই মৃণাল সেনের চরিত্রটির রূপ দেব বলে।
বায়োপিক আমি কোনো দিন করতে চাইনি। মৌলিক চরিত্র করার ঝুঁকি কম। পর্দায় বাস্তব মানুষটার ৮০ ভাগ হয়ে উঠতে পারলেও দর্শক সমালোচনা করবেন যে ২০ ভাগ আমি হয়ে উঠতে পারিনি সেটা নিয়েই। বিখ্যাত চরিত্রগুলোর কথার ভঙ্গি, শরীরের ভাষা, মুদ্রাদোষ সবই তো অতিচেনা। মৃণাল সেনের মতো মহিরুহ চরিত্রের তো আরও।
কলকাতার পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় একদিন ফোন করে জানালেন, মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে একটি বায়োপিক বানাবেন। নাম পদাতিক। মৃণাল সেনের ১৯৭২ সালের একটি ছবি থেকেই ধার নেওয়া। পদাতিক–এ আমাকে মৃণাল সেন হতে হবে। সৃজিত যে আমার কথা ভেবেছেন, তাতে খুশিই হলাম। পরিচালকেরা কত কিছু ভাবেন।
সবই কি আর ঘটে! তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি’ ওয়েব সিরিজেও আমার থাকার কথা ছিল। ভেস্তে দিয়েছিল মহামারি। কারাগার–এ আমার অভিনয় তাঁর ভালো লেগেছে। তাই হয়তো বলেছেন।
কিন্তু সৃজিতের কচ্ছপের কামড়। কিছুদিন পর আবার তাঁর ফোন। এপ্রিল ২০২৩–এর মধ্যেই ছবিটা শেষ করতে চান। মৃণাল সেনের জন্মশতবার্ষিকীতেই কয়েকটা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠাবেন। দ্রুত প্রস্তুতি নিতে হবে। এবার ভড়কেই গেলাম। ছয় মাস সময় চাইলাম প্রস্তুতির। শুটিং শুরু হয়ে গেল নির্ধারিত সময়ের আগেই।
এরই মধ্যে ২০২২–এর ডিসেম্বরে বাবা ভর্তি হলেন হাসপাতালে। জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। কাজে মন দেওয়ার মানসিক অবস্থাই চলে গেল। ১৫ দিনের মাথায় বাবা চলে গেলেন। তার ঠিক দুদিন পর সোমনাথ কুণ্ডু ঢাকায় এলেন আমার লুক টেস্টের জন্য। প্রস্থেটিক মেকআপের শিল্পী হিসেবে ভারতে তাঁর বিরাট সুনাম। সকালের ফ্লাইটে এসে সন্ধ্যায় ফিরে গেলেন। এই সময়ের ভেতর ৩০ থেকে ৯৫ বছর নানা বয়সী মৃণাল সেনের ছয়টি লুকের ফটোশুট হলো। একেকটা লুক তৈরি হলো, আর আমি পিতৃবিয়োগের অপার ব্যথা থেকে ভেসে ভেসে উঠলাম। শক্তি জমা হতে লাগল বুকে।
বাবার শ্রাদ্ধের দিন এল। মৃণাল সেনের লম্বা চুল! মায়ের অনুমতি নিয়ে আমি তাই মাথা মুণ্ডন করিনি। ফোন ছিল সাইলেন্ট মোডে। আমার ছেলে জানাল, অসংখ্য কল এসেছে। প্রথম আলোর মনজুর কাদেরেরও মিসড কল ছিল। ও জানাল, অমিতাভ বচ্চন ছবিটির ফার্স্ট লুক শেয়ার করে শুভকামনা জানিয়েছেন। পোস্টে দেখি আমার আর সৃজিতের নাম। অমিতাভ বচ্চনেরও শুরু হয়েছিল মৃণাল সেনের হাত ধরে, ভুবন সোম ছবিতে কণ্ঠ দিয়ে।
কলকাতায় গেলাম শুটিংয়ে। হোটেল কক্ষ ভরে উঠতে লাগল মৃণাল সেনের বই, অডিও ভিজ্যুয়াল আর সাক্ষাৎকারে। যতই তাঁকে জানি, ততই বিস্ময়ে ভরে উঠি। বাম প্রগতিশীল সংগ্রাম, গণনাট্য সংঘের আন্দোলন, নবতরঙ্গ চলচ্চিত্রের লড়াই—এই তো তাঁর জীবন। স্বপ্ন শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার। কী দৃঢ় ব্যক্তিত্ব! কী জীবনদৃষ্টি! এমন মানুষকে ধরে ফেলা সহজ নয়। আমি শুধু বলতে পারি, নিজেকে নিংড়ে দিয়েছি। পরিচালক সৃজিতের ভূমিকাও ছিল অসামান্য।
বেশির ভাগ শুটিং হলো কলকাতায়। বাকিটা ইতালির ভেনিসে। শুটিংয়ের বহু আগেই মৃণাল সেনের মতো ভারী ফ্রেমের চশমা তুলে নিয়েছিলাম চোখে। ছয় মাস চুল কাটিনি। শুটিংয়ের সময়টাতে মৃণাল সেনের মতোই হয়ে রইলাম, হাঁটাচলা আর ওঠাবসায়। লোকেশনে তো মৃণাল সেন, বাদবাকি সময় শোকগ্রস্ত পিতৃহারা সন্তান। মৃণাল সেনই যেন সেই ব্যক্তিগত বেদনা থেকে আমাকে টেনে বের করলেন।
ভাষা ছিল এ ছবির প্রধান চ্যালেঞ্জ—প্রধান অংশ কলকাত্তাই বাংলা, বাকিটা হিন্দি আর ইংরেজি। ভাষার দিকে মন দিতে গেলে অভিনয় টাল খেয়ে যায়। পরিচালক বললেন, ভাষাটা ভুলে গিয়ে অভিনয় করে যেতে। ভাষা ডাবিংয়েই শুধরে নেওয়া যাবে।
জীবনে মানুষ তো কম দেখিনি। আদর্শের হাত ধরে শুরু করেন, সময় পাল্টে গেলে হাত ঝেড়ে ফেলেন। মৃণাল সেনের মধ্যে ছিল আদর্শের এক অটলতা। কাজটা করতে করতে যতই মৃণাল সেনের চরিত্রের গভীরে ঢুকেছি, ততই দেখেছি মানুষ হিসেবে তাঁর উচ্চতা। ব্যক্তি মৃণাল সেন যেন পরিচালক মৃণাল সেনকে ছাপিয়ে গেছেন বহু বহুদূর।
জন্মশতবর্ষে সব বাঙালির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি, উঁচু ওই চলচ্চিত্রকারকে, উঁচু এই মানুষটিকে।