শহর থেকে গ্রাম–পাড়া–মহল্লায় সিনেমা নিয়ে হাজির হচ্ছে লাল ট্রাক। মুহূর্তেই মাঠ থেকে হাটবাজার হয়ে যাচ্ছে মুভি থিয়েটার। এএফপি
শহর থেকে গ্রাম–পাড়া–মহল্লায় সিনেমা নিয়ে হাজির হচ্ছে লাল ট্রাক। মুহূর্তেই মাঠ থেকে হাটবাজার হয়ে যাচ্ছে মুভি থিয়েটার। এএফপি

লাল ট্রাক দেখলেই জড়ো হতে থাকেন শত শত মানুষ

তিউনিসিয়ার উত্তর-পূর্বের মোনাস্তির রাজ্যের শহর জেম্মাল। অবকাঠামোর দিক থেকে অনেক পিছিয়ে শহরটি। জেম্মালের ২৩ বছর বয়সী তরুণ আমিন ইলহানি। বড় পর্দায় সিনেমা দেখার স্বপ্ন থাকলেও দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে হল না থাকায় তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আমিনের মতো আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকের স্বপ্নের সারথি হয়ে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি দাতাদের অর্থায়নে সাংস্কৃতিক নেটওয়ার্ক আগোরা ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফোকাস গেবস। উত্তর আফ্রিকার অনুন্নত বিভিন্ন শহরে ভ্রাম্যমাণ থিয়েটারের ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠান দুটি। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিনেমাটিডর’ বা ‘চলন্ত সিনেমা’। শহর থেকে গ্রাম–পাড়া–মহল্লায় সিনেমা নিয়ে হাজির হচ্ছে লাল ট্রাক। মুহূর্তেই মাঠ থেকে হাটবাজার হয়ে যাচ্ছে মুভি থিয়েটার।

তিউনিসিয়ায় হাতে গোনা মাত্র ১৫টি হল আছে। সেগুলোও মূলত প্রধান শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। তাই দেশটির বেশির ভাগ মানুষের কাছে বড় পর্দা মানে বিশাল কিছু। লাল ট্রাকটি যখন জেম্মালের কেন্দ্রে থামে, তা দেখতে কয়েক মুহূর্তেই অবাক দৃষ্টিতে জড়ো হতে থাকেন শত শত মানুষ। কয়েক ডজন শ্রমিক ট্রাকটি থেকে বিভিন্ন জিনিস নামাতে থাকেন। সহজে পরিবহনযোগ্য জিনিসপত্রের সংযোগ ঘটিয়ে মুহূর্তেই তৈরি হয়ে যায় ১০০ আসনসহ সজ্জিত আউটডোর মুভি থিয়েটার। জেম্মালের প্রথমবার বড় পর্দায় সিনেমা দেখে বেশ আপ্লুত আমিন ইলহানি।

তিউনিসিয়ায় হাতে গোনা মাত্র ১৫টি হল আছে। সেগুলোও মূলত প্রধান শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। তাই দেশটির বেশির ভাগ মানুষের কাছে বড় পর্দা মানে বিশাল কিছু। লাল ট্রাকটি যখন জেম্মালের কেন্দ্রে থামে, তা দেখতে কয়েক মুহূর্তেই অবাক দৃষ্টিতে জড়ো হতে থাকেন শত শত মানুষ।

ভ্রাম্যমাণ থিয়েটারের এ উদ্যোক্তাদের প্রতি জানিয়েছেন কৃতজ্ঞতা। বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিউনিসিয়ার এ তরুণ বলেন, ‘পর্দাটি বিশাল, আর সাউন্ড ইফেক্ট আমাকে বেশ অবাক করেছে।’ এখন পর্যন্ত শুধু ফোন বা কম্পিউটারে চলচ্চিত্র দেখা এ তরুণ আরও বলেন, ‘কখনো সিনেমা হলে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। বন্ধুদের সঙ্গে এটি ছিল একটি দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা।’
প্রকল্পটির পরিচালক ঘোফরানে হেরাঘি এএফপিকে বলেন, ‘অল্প সময়ে এবং সীমিত বাজেটে যতটা সম্ভব দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর একটি উপায় খুঁজছিলাম, তাঁদের একটি খাঁটি সিনেমাটিক অভিজ্ঞতা দেওয়ার লক্ষ্য ছিল আমাদের। বিশ্বের অন্যান্য দেশে অনেক আগে থেকেই ভ্রাম্যমাণ সিনেমা হল থাকলেও, ট্রাকে ভ্রাম্যমাণ প্রেক্ষাগৃহ—এমনটা আগে দেখা যায়নি।

সরকারি তহবিল ব্যতীত, সিনেমার অধিকার, রক্ষণাবেক্ষণ ও কয়েকজন কর্মচারীর খরচ মেটানোর জন্য উদ্যোগটি বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করে।’

ঘোফরানে হেরাঘি এএফপিকে আরও জানান, প্রকল্পটির বার্ষিক পরিকল্পনা ব্যয় প্রায় পাঁচ লাখ তিউনিসিয়ান দিনার। যেখানে শুধু  কিস্তিতে ট্রাকটি কিনতেই গুনতে হয়েছে তিন লাখ ডলারের বেশি, যা তিউনিসিয়ার মুদ্রায় প্রায় ১০ লাখ দিনার।
জেম্মালের বিভিন্ন জায়গায় ১০ দিন বিনা মূল্যে সিনেমা দেখায় ট্রাকটি। এর জন্য সংস্থাটির পাশে দাঁড়ায় জার্মান গাড়ির যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারক ড্রেক্সলমায়ার, যাদের এ শহরে একটি কারখানা রয়েছে।

তিউনিসিয়ার ড্রেক্সলমায়ারের প্রতিনিধি জিহেন বেন আমোর এএফপিকে বলেন, ‘আমরা প্রত্যন্ত ও অনুন্নত অঞ্চলগুলোর উন্নয়নে অবদান রাখতে চাই। তাই এ উদ্যোগের পাশে দাঁড়িয়েছি।’

জেম্মালের পর দেশটির রাজধানী তিউনিসের একটি দরিদ্র পাড়া হে হেলেতে সিনেমাটিডর স্থাপন করা হয়েছিল। মুভি থিয়েটারটি দেখতে চারপাশে ভিড় করতে থাকে শিশু–কিশোরেরা। বড় পর্দায় প্রথম সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা এএফপির সঙ্গে ভাগ করে নেন ১১ বছর বয়সী কিশোরী ইয়োমনা ওয়ারহানি। জানান, বড় পর্দায় প্রথম সিনেমা দেখে বেশ রোমাঞ্চিত ছিলেন। তাঁর কথায়, ‘থিয়েটারের ভেতরটা কেমন, আর সেখানে কি দেখায়, এর অপেক্ষায় আমার তর সইছিল না।
৪৭ বছর বয়সী চার সন্তানের মা নেজিবা এল হাদজি বলেন, ‘বিশ্বাস করুন, এটি কেবল শিশুদেরই রোমাঞ্চিত করেনি, অন্ধকার পরিবেশে সিনেমা দেখা আমাদের জন্যও ছিল আনন্দের বিরল উৎস।’

হাদজি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে কিছুই নেই, কোনো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নেই এবং বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। মানুষ বলে, আমাদের বাচ্চারা বখে যাচ্ছে। কিন্তু এসব নিয়ে কারও কোনো পরিকল্পনা নেই, কেউ এটা নিয়ে কিছু করে না।’
হে হেলেতে টানা দুই সপ্তাহ সিনেমা প্রদর্শন করা হয়। যার অর্থায়ন করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মানসিক স্বাস্থ্য, ধূমপান এবং মাদকের অপব্যবহার এবং নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন বিষয়বস্তু সেখানে প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানগুলো অল্প বয়সী দর্শকদের পাশাপাশি শ্রবণ বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী দর্শকদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছিল।

এ বিষয়ে প্রকল্পের প্রধান হেরাঘি এএফফিকে বলেন, ‘যা আমাদের চালিত করে তা হলো সংস্কৃতির সামাজিক প্রভাব। আমরা স্টেরিওটাইপগুলো ভাঙতে চাই, মানসিকতা পরিবর্তন করতে চাই এবং সামাজিক সংহতি এবং সম্প্রদায়ের চেতনার মতো মূল্যবোধকে প্রচার করতে চাই।’ তবে তিনি মনে করেন, এর সুফল পেতে হলে এর ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘সারা দেশে এটি ছড়িয়ে দিতে আরও ট্রাকের প্রয়োজন। তবে এর জন্য দাতাদের এগিয়ে আসতে হবে।’ তবে প্রকল্পটি নিয়ে হেরাঘির আরও বড় আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, তিনি বলেন, ‘আমরা এটি আলজেরিয়া, লিবিয়াসহ আফ্রিকাজুড়ে নিয়ে যেতে চাই।’