তেহরানের রাস্তায় ফুল বিক্রি করছে একটি ছোট মেয়ে। গাড়ির জানালায় টোকা দিল সে। ভেতরে থাকা মানুষটি ব্যস্ত মোবাইল ফোন নিয়ে। মেয়েটি কয়েকবার টোকা দেওয়ার পর, জানালার কাচ নিচে নামালেন ভদ্রলোক। অল্প ফাঁকা জায়গাটি দিয়ে ফুল বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি বলল, ‘পয়সা দিতে হবে না সাহেব; এটা আপনার ‘চিলড্রেন অব হেভেন’–এর জন্য।’ এই গল্পটি সামনাসামনি বসে, মাজিদ মাজিদির মুখ থেকে শোনার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।
২২তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মাস্টারক্লাসে ইরানের বিশ্বখ্যাত পরিচালক মাজিদ মাজিদি কথা বলেন প্রায় আড়াই ঘণ্টা। ওই দিনই তিনি নিজের সর্বাধিক পরিচিত ছবি ‘চিলড্রেন অব হেভেন’ প্রসঙ্গে গল্পটি শোনান। এ ছবিটিতে থাকা দুই ভাইবোনের গল্প নিজের জীবন থেকেই পেয়েছেন তিনি। শুধু গল্প পেয়ে ছবি বানিয়ে দিলেই তো আর হয়ে যায় না। তার ভেতর জারিত করতে হয় দার্শনিক চিন্তা। সেটা মাজিদি পেয়েছেন পারস্যের সুদীর্ঘ শিল্প–সংস্কৃতির আলোকে।
১৯৫৯ সালে জন্ম নেওয়া মাজিদি ১৪ বছর বয়সে অভিনয়ে নাম লেখান। বড় হওয়ার পর তেহরানের ইনস্টিটিউট অব ড্রামাটিক আর্টসে হাতে–কলমে অভিনয়কলা শিখতে শুরু করেন। এরপর ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে তাঁর। অভিনয় করতে শুরু করেন সিনেমায়। এর মধ্যে বিখ্যাত পরিচালক মোহসেন মাখমালবাফের বয়কট (১৯৮৫) ছবিটি উল্লেখযোগ্য। বড় পর্দার অভিনেতা থেকে নির্মাতা হয়ে ওঠা মাজিদি একে একে বানিয়ে ফেলেন ১০টি সিনেমা। এগুলোর মধ্যে তিনটি ছবি অসম্ভব রকম পরিচিতি পায় বিশ্বজুড়ে।
মাজিদি যখন চলচ্চিত্র বোনেন, তখন তাঁর মাথায় শুরুর দিকে হলিউড নির্মাতারাই বেশ প্রভাব বিস্তার করতেন। মাস্টারক্লাসে এটি নিয়ে আলাপ তুলতে তিনি বলেন, ‘এটি সত্য। শুরুতে এটা হয়েছে। তবে তিনি সত্যজিৎ রায়ের দ্বারাও দারুণভাবে প্রভাবিত। ভিত্তরিও ডি’সিকাও তাঁর অসম্ভব প্রিয়। আমি ভেবে দেখলাম, তাঁর নির্মিত ছবি ও পছন্দের নির্মাতাদের সৃষ্টির ভেতর একটা সাযুজ্য আছে। মাজিদি নিজে শিশুদের নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতে পছন্দ করেন। সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ আর ডি’সিকার ‘দ্য বাইসাইকেল থিভস’ প্রণিধানযোগ্য।
শুধু কি পরিচালক? ফারসি কবি হাফিজ, সাদি, রুমি, খৈয়াম—তাঁদের কোনো প্রভাব নেই আপনার কাজে? প্রথমে মাজিদি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইলেন না। বললেন, এটা সাহিত্য আলোচনায় চলে যেতে পারে। কিন্তু ইরানি চলচ্চিত্র কি ফারসি সাহিত্য ছাড়া আলোচনা করা সম্ভব? তিনি ঠিকই ঘুরেফিরে ফারসি সাহিত্যের আলাপে এলেন। বললেন তাঁর ‘চিলড্রেন অব হেভেন’ কতটুকু ফারসি কাব্য দ্বারা প্রভাবিত। এই ছবিতে সূক্ষ্ম বিষয়গুলো লক্ষ করলেই সেটা ধরা পড়ে। জুতোর দোকানে ছেলেটির ঘোরাঘুরি। পরিবারে সন্তানদের নৈতিকতার শিক্ষা। শেষ দৃশ্যে ছেলেটির পা দুটি ঘিরে রঙিন মাছের চক্রাকারে ঘোরা।
‘মুহাম্মদ: দ্য মেসেঞ্জার’ অব গড ছবিটিতেও এ রকম কাব্যময় দৃশ্যের অবতারণা করেছেন মাজিদি। তবে ছবিটি নিয়ে কম বাধার মুখে পড়েননি তিনি। জিজ্ঞেস করলাম, সামাল দিয়েছিলেন কীভাবে? কয়েকটি দেশের ধর্মগুরুরা চাননি ছবিটি মুক্তি পাক। মাজিদি বললেন, তাঁরা ধরতেই পারেননি ছবিটির মর্মার্থ। সারা বিশ্বে যেভাবে মুসলমান–বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছিল তখন, মাজিদি চেয়েছিলেন তার বিপরীতে গিয়ে ইসলাম যে শান্তির ধর্ম, সেই ভাবাদর্শটি দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু অনেকে ভুল বুঝলেন। অবশ্য অনেকে ছবিটিকে বেশ ভালোও বাসলেন।
একজন শিল্পী আসলে সবার মন জুগিয়ে চলতে পারেন না। শিল্পী সব সময় রাজনৈতিকভাবে সঠিক থাকতে পারেন না। কেউ যদি চেষ্টা করেনও, তো তাঁর শিল্পটি আদৌ কালোত্তীর্ণ হয় কি না, সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে। মাজিদ মাজিদিকে নিয়েও তর্ক আছে। তবে সেসব ছাপিয়ে তাঁর ‘চিলড্রেন অব হেভেন’, ‘কালার অব প্যারাডাইস’ ও ‘বারান’—এই তিনটি ছবি যে কালকে উতরে গেছে, সেটা কিন্তু তর্কাতীত।
মাস্টারক্লাসের বাইরেও মাঘ মাসের দুপুর-রাত-সন্ধ্যায় মাজিদির সঙ্গে বেশ কিছু মুহূর্ত কাটিয়েছি। অমূল্য। স্মরণীয়। ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল তাঁকে ওস্তাদ বলে সম্বোধন করেন। আমিও সেই সম্বোধন করে বলতে চাই: ভালো থাকুন ওস্তাদ। আপনার পরবর্তী চলচ্চিত্র আরও কোটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাক।