কারলা সিমনের ছবিগুলোর গল্প যেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। গত বুধবার রাতে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে আলো ছড়ানো ছবির নাম ‘আলকারাশ’। আলকারাশ কী? এটি এক গ্রাম। স্পেনের কাতালুনিয়ার যে এলাকায় বেড়ে উঠেছেন সিমন, তার কাছেরই একটি গ্রাম আলকারাশ। সেই গ্রামের কৃষিজীবী মানুষের গল্প উঠে এসেছে এ ছবিতে। নগরায়ণের ‘হাঁ’ করা মুখে দিন দিন গ্রাস হচ্ছে কৃষিজমি। তারই এক বয়ান সিমনের এ ছবি।
কেন জীবন থেকে নেওয়া বলা হলো? ছবির গল্প এক কৃষক পরিবারকে ঘিরে। যারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম কৃষির সঙ্গে জড়িত। পিচ উৎপাদন যাদের নেশা। একদিন সেই পরিবার শুনল, তারা যে জমিতে কৃষিকাজ করে, সেখানে করা হবে সৌর প্যানেল প্রকল্প। কৃষি থেকে তাতে লাভ বেশি। জীবনধারণের আশঙ্কায় পড়ে গেল কৃষক পরিবারটি।
সিমনের এই গল্প কাল্পনিক নয়। এইডসে আক্রান্ত মা–বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর চাচার কাছে বড় হয়েছিলেন সিমন। তাঁর চাচা ছিলেন পিচ চাষি। তিনি দেখেছেন কীভাবে দিন দিন গায়েব হয়ে যাচ্ছে কৃষিকাজের মতো প্রাচীন পেশা। সিমনের আগের ছবিটিও যেন তাঁর জীবনকে আঁকে। এইডসে আক্রান্ত মৃত মা–বাবার ছয় বছরের সন্তানের তার চাচার কাছে বেড়ে ওঠার কাহিনি নিয়ে সিমন বানিয়েছিলেন ‘সামার ১৯৯৩’। এ ছবিও বার্লিনে ‘সেরা প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য’ পুরস্কার পেয়েছিল।
নিজের মাটির কথা বলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, বার্লিন মঞ্চে সেটি ঘোষণা করলেন সিমন। তিনি বলেন, ‘আমি এই পুরস্কার উৎসর্গ করছি সব কৃষিজীবী পরিবারকে। তারা প্রতিদিন জমিতে কৃষিকাজ করে বলেই আমাদের পাতে ফলফলাদি আসে।’ তিনি মনে করেন, এমন একটা বিশ্বকে এ ছবির মাধ্যমে তিনি চিত্রায়িত করতে চেয়েছেন, যা দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
আমি এই পুরস্কার উৎসর্গ করছি সব কৃষিজীবী পরিবারকে। তারা প্রতিদিন জমিতে কৃষিকাজ করে বলেই আমাদের পাতে ফলফলাদি আসে।কারলা সিমন, নির্মাতা
উৎসবের দ্বিতীয় সেরা ছবির পুরস্কার গেছে কোরিয়ান নির্মাতা হং সাং সুর কাছে। ‘দ্য নভেলিস্ট’স ফিল্ম’ পেয়েছে প্রধান বিচারকের রায়ে রৌপ্য ভালুক। মেক্সিকোর নির্মাতা নাটালিয়া লোপেজ তাঁর ‘রোব অব জেমস’ ছবির জন্য পেয়েছেন বিচারকদের রায়ে রৌপ্য ভালুক। সেরা পরিচালক হিসেবে রৌপ্য ভালুক পেয়েছেন ‘বোথ সাইড অব দ্য ব্লেড’ ছবির জন্য ফরাসি নির্মাতা ক্লেয়ার ডেনি।
বার্লিনে সেরা অভিনয়শিল্পী ও সেরা সহ–অভিনয়শিল্পী হয়েছেন দুজনই নারী। সেরা অভিনয়শিল্পীকে বাছাই করতে লিঙ্গসমতায় বিশ্বাস করে বার্লিন কর্তৃপক্ষ। পুরুষ-নারীর ভেদ নয়, সেরা অভিনয়শিল্পীকে বাছাই করেছে তারা। তবে এবারের উৎসবের সেরা পুরস্কারগুলো গেছে নারীদেরই হাতে। সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনয়শিল্পী ও সেরা সহ–অভিনয়শিল্পী—সবই নারী। প্রধান অভিনয়শিল্পী হিসেবে রৌপ্য ভালুক পেয়েছেন জার্মান–তার্কিশ অভিনেত্রী মেলটেম কাপটান। ‘রাবিয়ে কুনাজ গেগেন জর্জ ডব্লিউ বুশ’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয় তাঁকে এ পুরস্কার এনে দিয়েছে। সহ–অভিনয়শিল্পী হিসেবে রৌপ্য ভালুক গেছে ইন্দোনেশিয়ান অভিনেত্রী লাওরা বাসুকির কাছে। ইন্দোনেশিয়ার নির্মাতা কামিলা আনডিনির ‘বিফোর, নাউ অ্যান্ড দেন’ ছবিতে অভিনয় করেছেন লাওরা।
১০ ফেব্রুয়ারি শারীরিকভাবে দর্শক ও তারকাদের অংশগ্রহণে শুরু হয়েছিল ৭২তম বার্লিন চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক উৎসব ২০২২। ফ্রাঁসোয়া ওজোঁর ‘পিটার ভন কান্ট’ ছিল উদ্বোধনী ছবি। জার্মানিতে তখন করোনা সংক্রমণ বাড়ছিল। জার্মানির স্থানীয় পত্রিকাতে উৎসবটি নিয়ে তাই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ কারণে ২০ ফেব্রুয়ারি উৎসব শেষ হওয়ার কথা হলেও ১৬ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হয় বিজয়ীদের নাম। এবারের উৎসবে ফরাসি অভিনেত্রী ইজাবেল হুপাকে বিশেষ সম্মাননা হিসেবে স্বর্ণ ভালুক দেওয়া হয়। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার কারণে উৎসবে আসতে পারেননি তিনি। অনলাইনে অংশগ্রহণ করেন এই অভিনেত্রী।
এবারের উৎসবে ছিল বাংলাদেশের অংশগ্রহণও। বার্লিন যৌথ প্রযোজনার বাজারে উপস্থাপনের (পিচিং) জন্য নির্বাচিত হয় রুবাইয়াত হোসেনের প্রকল্প ‘দ্য ডিফিকাল্ট ব্রাইড’। যৌথ প্রযোজনার বাজারে এবার ৩৪টি দেশের ৩২টি প্রকল্প ডাক পেয়েছে।
বিজয়ীদের তালিকা
আন্তর্জাতিক বিচারকদের রায়ে বিজয়ী
সেরা ছবির জন্য স্বর্ণ ভালুক
‘আলকারাশ’, পরিচালক: কারলা সিমন
প্রধান বিচারকের রায়ে রৌপ্য ভালুক
‘দ্য নভেলিস্ট’স ফিল্ম’, পরিচালক: হং সাং সু
বিচারকদের রায়ে রৌপ্য ভালুক
‘রোব অব জেমস’, পরিচালক: নাতালিয়া লোপেজ
সেরা পরিচালকের জন্য রৌপ্য ভালুক
ক্লায়ার ডেনি, ছবি: ‘বোথ সাইড অব দ্য ব্লেড’
সেরা অভিনয়শিল্পীর জন্য রৌপ্য ভালুক
মেলটেম কাপটান, ছবি: ‘রাবিয়ে কুনাজ গেগেন জর্জ ডব্লিউ বুশ’
সেরা সহ–অভিনয়শিল্পীর জন্য রৌপ্য ভালুক
লাওরা বাসুকি, ছবি: ‘বিফোর, নাউ অ্যান্ড দেন’
চিত্রনাট্যের জন্য রৌপ্য ভালুক
লায়লা স্টিলা, ছবি: ‘রাবিয়ে কুনাজ গেগেন জর্জ ডব্লিউ বুশ’
অসাধারণ শৈল্পিক অবদানের জন্য রৌপ্য ভালুক
রিথি পান, ছবি: ‘এভরিথিং উইল বি ওকে’
বিশেষ পুরস্কার
‘আ পিস অব স্কাই’, পরিচালক: মিখায়েল কহ
এনকাউন্টারস বিচারকদের রায়ে বিজয়ী
সেরা ছবি
‘মুতসেনবাহা’, পরিচালক: গুথ বেকারমান
সেরা পরিচালক
সিরিল শাবলিন, ছবি: ‘আনরেস্ট’
বিশেষ বিচারক পুরস্কার
‘সি ইউ ফ্রাইডে রবিনসন’, পরিচালক: মিত্রা ফারাহানি
জিডব্লিউএফএফ সেরা প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য পুরস্কার
‘সোনে’, পরিচালক: কুর্ডুউইন আইয়ুব
বার্লিনালে প্রামাণ্যচিত্র পুরস্কার
‘দ্য মিয়ানমার ডায়েরিজ’, পরিচালনা: দ্য মিয়ানমার কালেকটিভ
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের বিচারকদের রায়ে বিজয়ী
সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য স্বর্ণ ভালুক
‘ট্র্যাপ’, পরিচালক: আনাস্তাসিয়া ভেবার
বিচারকদের রায়ে রৌপ্য ভালুক
‘সানডে মর্নিং’, পরিচালক: ব্রুনো রিবেরো