ধারাবাহিক নাটকের কথা বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নব্বইয়ের দশকের ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘আজ রবিবার’সহ অনেক নাটকের নাম। ২০০০ সালের পর দর্শকদের মন জয় করেছিল ‘বন্ধন’, ‘৫১বর্তী’, ‘রঙের মানুষ’, ‘ভবের হাট’, ‘৪২০’, ‘হাউসফুল’, ‘সাকিন সারিসুরি’, ‘আলতা সুন্দরী’সহ বেশ কিছু নাটক। এসব নাটক দেখতে টিভি সেটের সামনে ভিড় করতেন দর্শক। কেবল দর্শক কেন, শিল্পী, কলাকুশলীদেরও আলাদা আগ্রহ থাকত নাটকগুলো নিয়ে। কিন্তু একসময়ের তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া ধারাবাহিক নাটক এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ধারাবাহিক নিয়ে কেবল যে দর্শকের আগ্রহ কমেছে, তা–ই নয়, দেশের প্রথম সারির বেশির ভাগ তারকাই ধারাবাহিকে অভিনয় করেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গল্পে বৈচিত্র্য না থাকা, পরিকল্পনা ও বাজেটের অভাবই এর মূল কারণ। তাঁদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে ধারাবাহিক নাটক পুরোনো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করতে পারবে না।
এই প্রজন্মের দর্শকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একক নাটক, ওয়েব সিরিজ, ঢালিউড সিনেমা নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করেন। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে ঢুঁ মেরেও ধারাবাহিক নিয়ে তেমন কথাবার্তা শোনা যায় না। অথচ প্রতিদিন গড়ে বিভিন্ন চ্যানেলে ২০টি ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হয়।
গত দুই বছরে ধারাবাহিক নাটকের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ফ্যামিলি ক্রাইসিস ও ব্যাচেলর পয়েন্ট। এ ছাড়া ‘হাউস নম্বর ৯’৬, ‘পরের মেয়ে’, ‘মাশরাফি জুনিয়র’সহ কিছু ধারাবাহিক দর্শক মোটামুটি গ্রহণ করেছেন। বাকি ধারাবাহিকগুলো টিভির পর ইউটিউবে প্রচারিত হলেও তেমন ভিউ নেই। এমনকি শততম পর্বও পার হতে পারছে না অনেক নাটক।
এ প্রসঙ্গে ‘রঙের মানুষ’, ‘ভবের হাট’সহ একাধিক দর্শকপ্রিয় নাটকের পরিচালক সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘আগে নাটকের গল্পে পরিবার থাকত। দর্শকেরা গল্পের সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারতেন। তখন সিরিয়ালে অভিনয়ের জন্য নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী পাওয়া যেত। যাঁরা থিয়েটার করে এসেছেন, ভালোবেসে অভিনয় করতেন। নির্মাতারাও দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কাজ করতেন। এখন অভিনয়, পরিচালনা, চিত্রনাট্য—কোথাও সেই যত্নের ছোঁয়া নেই। তবে একক নাটক ভালো হচ্ছে। কিন্তু দেড় থেকে দুই বছর ধরে শুটিং করতে গিয়ে ধারাবাহিকের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয় না। আমি নিজেও এক সিরিয়াল করতে গিয়ে প্রতি মাসে কোনো না কোনো শিল্পীর শিডিউল নিয়ে ঝামেলায় থাকি। এসব কারণেই নির্মাণে ছাড় দিতে হয়। কাজের মান পড়ে যায়।’
আগে ধারাবাহিকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে প্রবল জনপ্রিয়তা পেতেন শিল্পীরা। সেটা এতটাই যে অনেককে সেই চরিত্রের নামেই ডাকা হতো। যেমন কানকাটা রমজান, বাকের ভাই, হুরমতি, ফরিদ মামা, আনিস, মতি মিয়া, রমিজ, মন্টু, জাপান ডাক্তারসহ একাধিক ধারাবাহিকের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন হুমায়ুন ফরীদি, আসাদুজ্জামান নূর, ফেরদৌসী মজুমদার, আলী যাকের, জাহিদ হাসান, ফারুক আহমেদ, প্রাণ রায়, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরীরা। অনেক দর্শকের অভিযোগ, বর্তমান সময়ের ধারাবাহিকের কোনো চরিত্রকে আলাদা করা যায় না। আজ রবিবার নাটকে আনিস চরিত্রের অভিনেতা জাহিদ হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘একটি চরিত্রকে দর্শক আপন করে নিলেই তিনি দর্শকদের একজন হবেন। এ জন্য কাজটির প্রতি সৎ থাকতে হবে। শুধু শিল্পী হলেই চলবে, বিষয়টি এমন নয়। নির্মাতা, চিত্রনাট্য, চ্যানেল কর্তৃপক্ষ সবাইকেই ভালো কাজের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। মন চাইল আর পর্ব বাড়িয়ে গেলাম, এভাবে দর্শক ধরে রাখা যাবে না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন অভিনেতা বলেন, ‘আমাকে এখনো অনেকে নব্বইয়ের দশকের একটি নাটকের চরিত্রের নামে ডাকেন। কিন্তু এখন শুটিংয়ে গেলে ভিউ বাড়াতে ভাঁড়ামি করতে হয়। পরিচালক আগেই বলে দেয়, উচ্চ শব্দে কথা বলার সঙ্গে অযথা হাত–পা–মাথা নাড়াতে হবে। চিত্রনাট্য থাকে এক মিনিটের কিন্তু সেটাকে বাজেটের কারণে ইচ্ছেমতো পাঁচ থেকে সাত মিনিটে টেনে নিয়ে যেতে হয়। ধারাবাহিক থেকে অর্থ ছাড়া আর কিছু পাওয়ার নেই।’
করোনার সময়ে ‘ফ্যামিলি ক্রাইসিস’ জনপ্রিয় হলে পরে পারিবারিক গল্প নিয়ে পরিবার, হইচই পরিবারসহ ১০টির বেশি নাটকের প্রচার শুরু হয়। সেগুলো গল্পে, নির্মাণে, উপস্থাপনায় নেই তেমন বৈচিত্র্য। যে কারণে বেশির ভাগ ধারাবাহিক ১০৪ পর্বের স্লট পেরোতে পারছে না।
আজ জয়েন্ট ফ্যামিলি নাটকের ১০০ পর্ব প্রচারিত হবে এনটিভিতে। ধারাবাহিকগুলো কেন শত পর্ব ছাড়াতে পারছে না, এমন প্রশ্নে মামুনুর রশীদ বলেন, ‘ধারাবাহিক নাটককে প্রযোজক, পরিচালক, চ্যানেল কর্তৃপক্ষ কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। ধারাবাহিক সামগ্রিকভাবে অবহেলিত। এ কারণে অনেক অভিনেতা ধারাবাহিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এটা এখন অর্থ উপার্জনের জন্য তৈরি হচ্ছে। চ্যানেল, পরিচালক, শিল্পীদের অবহেলার কারণে দিন দিন আরও অধঃপতন হচ্ছে, ধারাবাহিক নাটকের ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে গেছে। এখান থেকে ফিরে আসা খুব কঠিন।’