১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে ১১ বছরের শিশু ছিলেন আজকের অভিনেতা ফারুক আহমেদ। ভাইবোনদের সঙ্গে হুল্লোড় করে সেদিনও ঘুমিয়ে পড়েন তাঁরা। ঘুমানোর কিছু সময় পরই হঠাৎ তাঁদের ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে প্রচণ্ড শব্দ। প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। সময় যত যায়, বাড়তে থাকে শব্দ। সময়টা যেন জীবনে দুঃস্বপ্ন হয়ে আসে। সেই দুঃসহ স্মৃতি যেন এখনো ভুলতে পারেননি এই অভিনেতা। শরীরে গুলি লাগার ভয়ে ঘরের চৌকির নিচে সেদিন জড়সড় হয়ে বসে ছিলেন তারা।
সেই কালো রাতের স্মৃতি স্মরণ করে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমরা বাড়িতে ভাইবোনেরা আড্ডা দিতাম, দুষ্টুমি করতাম। খেলাধুলা করতাম। বয়সটা তো তেমনই। আমরা তখন পুরান ঢাকার কাগজীটোলায় আমার চাচাতো ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। সময়টা ভালোই কাটছিল। অন্যদিনের মতোই সকাল সকাল উঠতে হবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়ি। ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছি। ১২টার কিছুক্ষণ পর তীব্র গোলাগুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। আমরা তখন বুঝতে পারছিলাম না। ঘটনা কী? কেন এত গোলাগুলির শব্দ! বাসার সবাই ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে রইলাম।’
রাত যত গভীর হয়, ততই আতঙ্ক বাড়তে থাকে। হারিয়ে যায় ঘুম। সারাক্ষণ মনে হয়, গুলি এসে গায়ে লাগবে। চারপাশে শুধু গুলির শব্দ; বাইরে বের হওয়ার মতো উপায় নেই। ‘গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর থেকে অনবরত গুলির শব্দ চলতে থাকে। আমাদের কান বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কানে কিছু শুনতে পাচ্ছি না। আমাদের বেশি ভয় লাগছিল। কারণ, আমরা যে বাসায় ছিলাম সেটা ছিল টিনের ঘর। একবার এদিকে গুলি এলেই আমাদের শরীর ভেদ করবে। যে কারণে ভয় আরও বেড়ে গেল। কোন দিক থেকে টিন ভেদ করে আমাদের শরীরে এসে গুলি লাগে, এই ভয়ে আমার মা আমাদের চার ভাইবোনকে চৌকির নিচে বসিয়ে রাখলেন,’ বলেন ফারুক আহমেদ।
সাধারণ মানুষ, শিশু–কিশোরেরা তখনো বুঝতে পারেনি এত গোলাগুলির কারণ কী? কারাই বা অতর্কিতে হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু একটা সময় এটা আর বুঝতে বাকি থাকে না যে পাকিস্তানিরা এই বর্বর হামলা চালিয়েছে। নির্বিচার মানুষ খুন করছে। ফারুক আহমেদ বলেন, ‘তখন তো আমি অনেক ছোট। পরে ভোরের দিকে জানতে পারলাম যে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাত ১২টা থেকে ঢাকা শহরে আক্রমণ শুরু করেছে। তখনো আমরা আতঙ্কে আছি। কিন্তু কেন হামলা, সেটার আমরা কিছুই জানি না।’
এই অভিনেতা আরও বলেন, ‘আমরা সকালে এক ব্যক্তির মাধ্যমে প্রথমে জানতে পারলাম যে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নির্বিচার নিরীহ মানুষ হত্যা করছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ঢুকে গুলি চালিয়ে ছাত্রছাত্রীদের হত্যা করছে। রাস্তাঘাটে যাকে পাচ্ছে, তাকেই হত্যা করছে। ঢাকার রাজপথ রক্তে ভেসে গেছে। লোকটার কথা শুনে বাসার সবাই হতভম্ব হয়ে যাই। লোকটি একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে আবার দৌড়ে চলে যায়।’
তখনো ভয়ে চৌকির নিচেই ছিলেন। সকালে সামান্য নাশতা করেন। পরে আবার ভয়ে চৌকির নিচেই নিচু হয়ে বসে থাকেন ফারুক আহমেদরা। গোলাগুলির শব্দ তখন আরও তীব্র হয়েছে। ফারুক আহমেদ বলেন, ‘পাশাপাশি বসেও একজনের কথা আরেকজন শুনতে পাচ্ছিলাম না। সারা দিন ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে কেটেছে। আজও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, ভয়াল কালরাত্রি আমার চেখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি বুকের মধ্যে এক তীব্র বেদনা অনুভব করি।’
সকাল থেকে এই অভিনেতাকে শুনতে হচ্ছে ‘শুভ জন্মদিন’। কারণ, আজ ২৫ মার্চ এই অভিনেতার জন্মদিন। কিন্তু এই দিনে তিনি কখনোই জন্মদিন পালন করেন না। অন্যান্য দিনের মতোই দিনটি কাটিয়ে দেন। ফারুক আহমেদ জানান, যাঁরা তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান, তাঁদের অভিনন্দন। কিন্তু তিনি দিনটি উদযাপন করেন না। দিনটি তাঁকে ২৫ মার্চের কালো রাতে নিয়ে যায়, যে আতঙ্কে এখনো তাঁর ঘুম ভাঙে।