সম্পর্কটা প্রায় দেড় যুগের। এই সময়ে কখনো বড় ভাই, কখনো বন্ধুর মতো চঞ্চল চৌধুরীর পাশে থেকেছেন বৃন্দাবন দাস। চঞ্চল তাঁকে মেনেছেন অভিভাবক। পেশাগত জায়গা থেকে সম্পর্কটা ব্যক্তিগত জায়গায় পৌঁছেছে। বৃন্দাবন দাসের সঙ্গে আড্ডা না হলে পেটের ভাত হজম হয়নি চঞ্চলের। এমনও সময় গিয়েছে, বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬০ দিন তাঁদের দেখা হয়েছে। চঞ্চলের সেই প্রিয় মানুষের জন্মদিন আজ। তাঁকে নিয়ে চঞ্চল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন।’ কীভাবে তাঁরা এতটা আপন হলেন?
তখন ‘দ্য নিউ সবুজ অপেরা’ নাটকের শুটিং চলছিল। সেই নাটক লিখেছিলেন বৃন্দাবন দাস। সেখানে একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান আরণ্যক নাট্যদলের তরুণ কর্মী চঞ্চল। তখন চিনতেন না বৃন্দাবন দাস কে? শুধু জানতেন অভিনীত নাটকের চিত্রনাট্যকার বৃন্দাবন দাস। তখন হাই–হ্যালো হতো। পরবর্তী সময়ে বৃন্দাবন দাসের লেখা আরও বেশ কিছু নাটকে অভিনয়ের সুযোগ হয় চঞ্চলের। পাবনার ভাষায় চিত্রনাট্যে পাবনার তরুণ অভিনেতা চঞ্চল জনপ্রিয়তা পান। ক্রমেই পরিচালকদের ভরসা হয়ে ওঠেন তিনি।
চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘নাটকে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়েই পরিচয়। তার আগে চিনতাম না। ওই যে আমাদের পরিচয় হলো, একটা সম্পর্ক হলো; পরে তাঁর লেখা নাটকে নিয়মিত অভিনয় শুরু করলাম। দাদার লেখা সবচেয়ে বেশি নাটকে আমি অভিনয় করেছি। সিরিয়াল, একক যা–ই হোক, সবকিছুতেই। কাজ করতে গিয়েই আমাদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।’
একসময়ে বৃন্দাবন দাসের লেখা নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি একসঙ্গে সহ–অভিনেতা হিসেবে পান তাঁকে। ‘সার্ভিস হোল্ডার’, ‘পালবাড়ি’, ‘হাড়কিপটে’সহ অনেক নাটক ভক্তদের কাছে প্রশংসিত হয়।
চঞ্চলের ভাষায়, ‘আমরা আমাদের বেড়ে ওঠা খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমাদের কঠিন সময়গুলো আমাদের দেখা, চেনা। এভাবে আমাদের আন্তরিক সম্পর্কটা বেড়েছে। তাঁর দুই সন্তান, আমার এক সন্তান, তাদের বড় হওয়া কাছ থেকে দেখা। এখন আমরা দুই পরিবার বছরের বিভিন্ন সময়ে গ্রামের বাসায় যাওয়া–আসা হয়। বলা যায়, আমাদের মধ্যে অভিন্ন কিছু নেই।’
বাংলা নাটকের একটা সময়ে চঞ্চল চৌধুরী ও বৃন্দাবন দাস নামটি ছিল পরিপূরক। অনেক জনপ্রিয় নাটক আছে এই জুটির। ফেসবুকে নাটকের গ্রুপগুলোয় আলাদা মাত্রা পায় বৃন্দাবন দাসের লেখা ও চঞ্চল অভিনীত অনেক নাটকের কথা। যেগুলো পরিচালনা করেছেন সালাহউদ্দিন লাভলু।
চঞ্চল বলেন, ‘দাদার লেখা নাটক আর লাভলু ভাইয়ের পরিচালনা মানেই আমাদের একটা টিম। আ খ ম হাসান, শামীম জামান, শাহনাজ খুশি, মোশাররফ করিমসহ আরও অনেকেই ছিল। পরে তো সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল। আলাদা আলাদা কাজ শুরু করল। কিন্তু গল্প দিয়ে দর্শকদের আটকে রাখার ব্যাপারটা তখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে। যে কারণে বৃন্দাবন দাসের নাম সব সময়ই উচ্চারিত হবে।’
একসঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে নিয়মিত তাঁদের আড্ডা হয়। শত ব্যস্ততার মধ্যে কখনো যোগাযোগে ভাটা পড়েনি। এমনও হয়েছে, গভীর রাতে শুটিং শেষেই বৃন্দাবন দাসদের সঙ্গে দুই ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে তবেই বাসায় ফিরেছেন চঞ্চল।
দীর্ঘ এই সম্পর্কের যাত্রায় এমন কিছু কি আছে, যা কখনোই প্রিয় চিত্রনাট্যকারকে বলা হয়নি, যা আজ আমরা পাঠকদের জানাতে পারি? এমন প্রশ্নে চঞ্চল বলেন, ‘আমাদের সম্পর্কটাই এমন যে আমাদের না–বলা কোনো কথা বাকি নেই। আমি তাঁকে গার্ডিয়ান মনে করি। কাজ নিয়ে, পারিবারিক বিষয়—সব নিয়েই কথা হয়। আমাদের সম্পর্কটা এমন হয়ে গেছে যে কঠিনতম সময়ে পাশাপাশি থেকেছি, ভালো সময় কাটছে। সব নিয়েই কথা হয়েছে। এখন আমাদের মধ্যে আর গোপন কিছু নেই, সবই প্রকাশ্য।’
আজ বৃন্দাবন দাসের জন্মদিনে তাঁকে কোন কথাটা বলতে চান, এমন প্রশ্নে চঞ্চল বলেন, ‘আজ আমি একটা স্ট্যাটাস লিখেছি, “আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন”। আমার আপন বলতে তিনি হয়তো আমার মায়ের পেটের ভাই নন; কিন্তু আমার বাবা যত দিন বেঁচে ছিলেন, তাঁকে সন্তানের মতোই স্নেহ করেছেন। আমার মা তাঁকে পরিচয়ের পর থেকে সন্তানের মতোই স্নেহ করেন। এখনো মাকে যতবারই ফোন করি, ততবারই অন্য ভাইদের মতো বৃন্দাবনরা কেমন আছেন, জানতে চান। এখন আমাদের পরিবারের বাইরে তাঁদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও পরিচয় হয়ে গেছে। আমাদের এখন বৃহৎ পরিবার।’
একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেগুলো শুটিং সেটেই থেকেছে। এগুলো কখনোই ব্যক্তিজীবনে ঠাঁই পায়নি। সেগুলো আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করেছেন। দীর্ঘ এই পরিচয়ের পর একদিনের জন্যও তাঁরা নিজেদের মধ্যে মান–অভিমান করে থাকেননি।
চঞ্চল বলেন, ‘একটানা কাজ করতে গেলে মনোমালিন্য হওয়াই স্বাভাবিক। সেটা নিয়ে আলোচনা করি। এমন না যে কথা বলা বন্ধ করেছি। আগে যত রাতই হোক না কেন আমাদের বছরে ৩৬০ দিন দেখা হতো। সেখানে এখন কাজের চাপ বেড়েছে, পারিবারিক দায়দায়িত্ব বেড়েছে। সন্তান বড় হচ্ছে, তাকে সময় দিতে হচ্ছে—এসবের কারণে আগের চেয়ে কিছুটা কম দেখা হয়। কিন্তু দূরত্বের প্রশ্ন কখনোই আসেনি। আমাদের কখনোই গ্যাপ তৈরি হয়নি। সব আগের মতোই রয়েছে।’
দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বৃন্দাবন দাসের চিত্রনাট্যে অভিনয় করে চঞ্চলের দিন কেটেছে। দর্শকদের কাছে অভিনয় দিয়ে হয়ে উঠেছেন চঞ্চল চৌধুরী। এই জুটির অনেক নাটক দেখে এখনো দর্শকদের সময় কাটে। ‘আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, আজকের এই ক্যারিয়ারের পেছনে বৃন্দাবন দাসের কাছে কিছুটা হলেও ঋণী?’—এমন প্রশ্ন শুনে কিছুটা চুপ থাকেন চঞ্চল।
চঞ্চল বলতে থাকেন, ‘একটু না। একটু হবে কেন? আমার টেলিভিশন নাটকে তো ৮০ ভাগই বৃন্দাবন দাদার সঙ্গে করা। দাদার লেখা অনেক চরিত্র গল্পে কাজ করেছি। আমার টেলিভিশন ক্যারিয়ারের বিশাল অংশজুড়ে তাঁর নাটকে কাজ করা। তাঁর কাজগুলো করেই আমার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা পাওয়া। তাঁর কাছে আমি একটু না অনেক ঋণী। অনেক ঋণী।’