আমার জন্ম এক নিভৃত পাড়াগাঁয়ে। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার কামারহাট গ্রামে। আমি যখন কলেজে পড়ি, সে সময় আমাদের গ্রামে প্রথম ইলেকট্রিসিটি গেল। আট ভাই-বোনের ভেতর আমি সবার ছোট। সনাতন ধর্মে একটা কথা আছে, ‘অষ্টম গর্ভে শ্রীকৃষ্ণ’। তাই ধারণা করা হয়, অষ্টম গর্ভে যে জন্মায়, সে সৌভাগ্য নিয়ে আসে। আমার বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ঘুম থেকে উঠে দেখতাম, বাবা কলপাড়ে হাত-মুখ ধুচ্ছেন অথবা বাজারের ব্যাগ হাতে বেরোচ্ছেন। বারান্দায়, উঠোনে মাদুর পাতা, সেখানে বিভিন্ন বয়সের ছাত্রছাত্রীরা বসে। বাবা ওদের পড়াতেন। কারও নির্দিষ্ট কোনো বেতন ছিল না। যাদের যতটুকু সামর্থ্য ছিল, ততটুকু দিত। না পারলে দিত না।
বাড়ি থেকে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই পদ্মা। আমার ছেলেবেলার স্মৃতিতে বয়ে চলেছে প্রমত্ত পদ্মা। সাঁতরে সাঁতরে একেক দিন একেক চরে গিয়ে উঠতাম। সেখানে বালুতে মাখামাখি হয়ে সারা দুপুর খেলতাম। আবার বিকেলে সাঁতরে ফিরে আসতাম। আমি সবার ছোট ছিলাম বলে একটা সুবিধা ছিল, আমাকে অতটা পারিবারিক দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি।
প্রমত্ত পদ্মা ছাড়াও ছেলেবেলার আরেক আকর্ষণ ছিল পোদ্দারবাড়ির বড় পুকুর। পোদ্দারবাড়ি আমাদের দূর সম্পর্কের মামাবাড়ি। মামারা শহরে থাকতেন। উৎসব উপলক্ষে বছরে দু-একবার গ্রামের বাড়ি আসতেন। সেই পুকুরেই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ গোসল করত।
আরেকটি বিশেষ আকর্ষণের কারণেও আমি ওই পুকুরে গোসল করতে যেতাম। পোদ্দারবাড়ির ভেতর থেকে সারা দিন ক্যাসেট প্লেয়ারে গান ভেসে আসত। রবীন্দ্রসংগীত আর নজরুলসংগীত তো ছিলই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকার গানও চলত। আমি পুকুরপাড়ে বসে মুগ্ধ হয়ে সেসব শুনতাম। এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত। গান শুনতে শুনতে যখন অন্য জগতে বিচরণ করছি, মাঝেমধ্যে সংবিত ফিরলে দেখতাম, কে যেন কান ধরে টানছে। তাকিয়ে দেখতাম বাবা অথবা মা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
পোদ্দারবাড়িতে ছিল অনেক বড় আমবাগান আর ফুলের বাগান। আমের মৌসুমে প্রচুর আম ধরত। আমরা যারা দুষ্টু ছেলের দল, তাদের সবার পকেটে থাকত আম কাটার চাকু আর লবণ-মরিচের গুঁড়োর ছোট্ট কাগজের পোঁটলা। আমরা কেউ একজন গাছে উঠে অথবা ঢিল মেরে আম পেড়ে খুব মজা করে খেতাম।
দুই
শৈশবের স্মৃতিতে এখনো জেগে আছে গ্রামের স্কুলমাঠের সেই যাত্রাপালা। যে স্কুলের মাঠে শীতের কনকনে ঠান্ডার বছরে দুই-তিন রাত যাত্রাপালা হতো, আমার বাবা ছিলেন ওই স্কুলেরই শিক্ষক। আমাদের বাড়ির উঠোনেই ছিল সেই স্কুল। যাত্রাপালায় স্থানীয়রাই অভিনয় করত। কয়েক দিনের জন্য নারী অভিনেত্রী ও বাদ্যযন্ত্রীদের ভাড়া করে আনা হতো। আর যাত্রাপালার পুরো আয়োজনটাই করতেন বাবা।
আমার জীবনের প্রথম অভিনয় ওই যাত্রাপালা থেকেই শুরু। কোনো এক সামাজিক যাত্রাপালায় এক আনির চরিত্রে নায়িকার কোলে উঠে প্রথম যাত্রামঞ্চে প্রবেশ আমার। সেই সঙ্গে কেঁদে কেঁদে গান গাওয়া, ‘একটি পয়সা দাও গো বাবু, একটি পয়সা দাও’। আর এই গান শুনে যাত্রার সমস্ত দর্শক আবেগপ্রবণ হয়ে এক টাকা, দুই টাকা করে মঞ্চে ছুড়ে দিল। অভিনয় শেষে গোছানোর পর দেখা গেল অনেক টাকা। যাত্রার মঞ্চে কুড়িয়ে পাওয়া সেই টাকাগুলোই ছিল অভিনয় করে আমার প্রথম উপার্জন।
ছোটবেলায় স্কুলের বইয়ের লেখার চেয়ে ছবিগুলোই টানত বেশি। ছবিগুলোর ওপর ট্রেসিং পেপার বসিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আঁকতাম। ঘরে টানানো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, স্বামী বিবেকানন্দ, সুকান্ত ভট্টাচার্য—এ রকম অনেক মনীষীর ছবি দেখে দেখে আমার ছবি আঁকার শুরু। কখনো মানুষের ছবি, কখনো গ্রামের নিসর্গচিত্র—এভাবেই চলতে থাকল বেশ কিছুদিন। বিজ্ঞান বিভাগের অনেক এসএসসি পরীক্ষার্থীর প্র্যাকটিক্যাল খাতাতেও ছবি এঁকে দিতাম বিনা পারিশ্রমিকে।
গ্রামের বিয়েবাড়ির গেটে ‘শুভ বিবাহ’ থেকে ‘গায়েহলুদ’ লেখা, বিয়ের স্টেজ সাজানো—এসব কাজ খুব মজা করে করতাম। বিনিময়ে টাকাপয়সা কিছু পাওয়া যেত না, তবে একটু আদর আর ভালো খাওয়াদাওয়া মিলত। তাতেই মহাখুশি। আবার বাংলা বছরের শুরুতে দোকানে দোকানে যখন হালখাতা হতো, সেসব দোকানে ‘শুভ হালখাতা’ লেখা, দোকান সাজানো এই কাজগুলো করে দিলেই মিলত পেটভর্তি রসগোল্লা, জিলাপি আর শিঙাড়া!
তিন
আমরা প্রায় সব কটি ভাইবোনই পড়াশোনার একটা পর্যায়ে বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে থাকতাম। আমার বড় বোনের বাড়ি রাজবাড়ী জেলার বেলগাছিতে। এসএসসি পরীক্ষার আগে আমি বেলগাছিতে চলে যাই। আমার বড় জামাইবাবু পীযূষকান্তি সাহা ছিলেন বেলগাছি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক।
পড়ালেখার চেয়ে দুষ্টুমিটাই করতাম বেশি। আমি যাতে এসএসসি পরীক্ষার চূড়ান্ত প্রস্তুতি ভালোভাবে নিতে পারি, সে জন্য বাবা আমাকে বড় দুলাভাইয়ের তত্ত্বাবধানে বড় বোনের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। আমার বড় বোনের শ্বশুর আর আমি একই ঘরে থাকতাম। একই ঘরে পাশাপাশি খাটে ঘুমাতাম। ডায়াবেটিসের কারণে তিনি অনেক আগেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিল রেডিও। রেডিওর খবর শোনা, গান শোনা—এভাবেই কাটত তাঁর দিন। তাঁর সঙ্গে গল্প করা, হাত ধরে হাঁটতে নিয়ে যাওয়া, সবকিছুতেই তাঁর পাশে থাকা—পড়াশোনার পাশাপাশি এটি ছিল আমার বাড়তি দায়িত্ব। সে দায়িত্ব আমি গভীর নিষ্ঠায় পালন করতাম।
রাতের বেলা দৃশ্য পাল্টে যেত। যখন তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন, তখন তাঁর রেডিওটা চুরি করে আমার কাছে এনে দশ টাকায় কেনা হেডফোন লাগিয়ে ‘গানের ডালি’, ‘দুর্বার’, ‘ছায়াছন্দ’—এসব অনুষ্ঠানের গান শুনতাম।
সেই পোদ্দারবাড়ির পুকুরের ঘাটে বসে গান শোনা আর বোনের শ্বশুরের রেডিও চুরি করে গান শোনা—এভাবেই আমার গুনগুন করে গান গাওয়ার শুরু। আমার বোনের ছেলেমেয়েরা আমাকে ডাকত মানিক মামা। আমার বোনের শ্বশুরও মানিক মামা বলেই ডাকতেন। একদিন তিনি ডেকে বললেন, ‘মানিক মামা, মাঝেমধ্যে রাতে আমার রেডিওটা কোথায় উধাও হয়ে যায়, সেটি আমি ভালোভাবেই জানি। আবার তুমি যে গুনগুন করে গানও করো, সেটাও কিন্তু আমার শুনতে ভালোই লাগে।’ ধরা খেয়ে যাওয়ার পর থেকে মাঝেমধ্যেই তাঁকে আমার গান গেয়ে শোনাতে হতো।
আমার জামাইবাবুর ছোট ভাই অপূর্বকান্তি পেশায় ছিলেন পল্লিচিকিৎসক। রাতে বাড়িতে ফিরে তিনি আমাকে সঙ্গে করে কাচারিঘরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে যেতেন। আমি তাঁকে ডাকতাম মনিদা বলে। মনিদা বাজাতেন আর আমি গাইতাম। এভাবেই আমার গানের চর্চা শুরু।
এসএসসি পরীক্ষার পর আমি ভর্তি হই রাজবাড়ী কলেজে। বোনের বাসায় আরও দুই বছর থাকি। এভাবেই আমার জীবনের বর্ণিল সময় পার করেছি বড় বোনের বাড়িতে।
আমি যখন রাজবাড়ী কলেজে, তখন আমার বড় ভাই অচিন্ত্য চৌধুরী রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র। বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল তাঁদের এক ছেলে যেহেতু ডাক্তার, আমি যেন ইঞ্জিনিয়ার হই। কিন্তু ওর কোনো কিছু হওয়ারই ইচ্ছা আমার ছিল না। আমাকে টানত ছবি আঁকা আর গান। অনেক কষ্ট করেই পরিবারকে রাজি করিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম চারুকলায়।
এখন পর্যন্ত আমি যে অঙ্গনে কাজ করছি, সেখানে কাজ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সাহস এবং ভরসা জুগিয়েছিলেন আমার বড় জামাইবাবু পীযূষকান্তি সাহা। তাঁর উৎসাহেই অনেকগুলো বছর আমি বেশ দ্রুত এগিয়ে গিয়েছি।
চার
ডাক্তারি পড়া শেষ করে আমার ভাই ঢাকায় চলে এলেন। আমিও ১৯৯০–এর দশকে ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে ভাইয়ের কাঁধে চেপে বসি। শুরু হয় আমাদের দুই ভাইয়ের ঢাকা শহরে টিকে থাকার লড়াই। দ্বিতীয় মাস থেকে আমি প্রাইভেট টিউশনি শুরু করি। কেননা, বাবা যতটুকু মাসিক হাতখরচ পাঠাতেন, তা দিয়ে ঢাকা শহরে টিকে থাকা কঠিন ছিল। নারায়ণগঞ্জে থাকতেন আমার মেজো মামা। টিউশনির টাকা জমিয়ে জমিয়ে মামার কাছে রেখে আসতাম। আমার মায়ের একটা সোনার চেইনের খুব শখ ছিল। টিউশনির জমানো টাকা দিয়ে মাকে একটা সোনার চেইন কিনে দিয়েছিলাম।
চারুকলায় অজপাড়াগাঁ থেকে আসা আমাদের চার-পাঁচজনের ঘনিষ্ঠতা ছিল খুব বেশি। আমাদের চেহারা–সুরত, পোশাক-আশাক, চালচলন অন্য বন্ধুদের চেয়ে আলাদা ছিল বলেই ওদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সাহস পেতাম না। আমরা ওই চার-পাঁচজন সব সময় আলাদা আলাদাই থাকতাম। এখনো চারুকলার সেই বকুলতলা, পুকুরপাড়, উৎসবগুলো আমাকে একইভাবে টানে। এখনো অবসর পেলে বা কাজ থেকে ফেরার পথে চারুকলায় একবার ঢুঁ দিয়ে আসি।
পাঁচ
একটা সময় পর্যন্ত মঞ্চনাটক সম্পর্কে আমার সামান্যতম ধারণা ছিল না।
আমি তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার বন্ধু, এখন জনপ্রিয় গায়ক, রাহুল আনন্দের মাধ্যমে জানতে পারলাম, আরণ্যক নাট্যদলে নতুন নাট্যকর্মী নেওয়া হচ্ছে। বকুলতলায় আউটডোর স্কেচ করছিলাম। ওই খাতা থেকে একটা পৃষ্ঠা নিয়ে পেনসিল দিয়ে সদস্য হওয়ার আবেদনপত্র লিখলাম। মানিব্যাগে একটা সাদা-কালো ছবি ছিল। জুড়ে দিলাম আবেদনপত্রের সঙ্গে। রাহুলের হাত ধরে মঞ্চকর্মী হওয়ার স্বপ্ন পৌঁছে গেল আরণ্যকে।
এক বছর পর আরণ্যক থেকে এল ইন্টারভিউর ডাক। ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রশ্ন করা হলো, আরণ্যকে কেন যোগদান করতে চাই? উত্তরে শুধুই বলেছিলাম, আমি কিছুই জানি না। চারুকলায় পড়ালেখা করি। আপনারা আমাকে যেকোনো কাজের উপযুক্ত মনে করলে আমি সেটা করতে রাজি। এভাবেই যুক্ত হয়ে গেলাম আরণ্যকে।
প্রথম দিকে মঞ্চের পেছনের কাজগুলো করতাম। সেট ডিজাইন, কস্টিউম ডিজাইন, প্রপস ডিজাইন, মিউজিক এসব। একদম প্রথমে যে কাজ দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা হলো রিহার্সাল শুরুর আগে আরণ্যকের অফিসের যেটা রিহার্সাল রুম, সেটা ঝেড়ে–মুছে পরিষ্কার করা। আগের দিনের চায়ের কাপগুলো ধোয়া, বাথরুম পরিষ্কার করা। জুনিয়র সদস্য হিসেবে যা যা করণীয়, তার সবই করেছি। কাঁধে করে দলের অফিস থেকে বেইলি রোডের মঞ্চে সেট টেনে নেওয়া। আবার শো শেষে সেখান থেকে সেট দলের অফিসে পৌঁছে দেওয়া। এভাবেই কেটে গেছে দশটা বছর। এই দশ বছর কেবল মঞ্চের পেছনের কাজই করে গেছি।
মামুনুর রশীদের সংক্রান্তি নাটক দিয়েই বড় কোনো চরিত্রে প্রথম মঞ্চের দাঁড়ানো। আগের ১০ বছরের প্রস্তুতি আরণ্যকের ঘর পরিষ্কার করা, বাথরুম পরিষ্কার করা, কাপ-পিরিচ ধোয়া, দুই টাকা করে চাঁদা তুলে চা–শিঙাড়া খাওয়ানো, রিহার্সাল রুমে ফ্লোরে বসে বসে বছরের পর বছর রিহার্সাল দেখা—সবই ছিল আমার প্রথম মঞ্চে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। আরণ্যকের বিভিন্ন প্রযোজনা প্রদর্শনীর সঙ্গে শত শত রজনী পার করেছি অনেক মায়ায়, অনেক ভালোবাসায়। অভিনেতা হিসেবে আমি যদি কিছু অর্জন করে থাকি, সে জন্য আমি আরণ্যকের প্রতি, আমার নাট্যগুরু মামুনুর রশীদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
ছয়
২০০৫ সালের দিকের ঘটনা। তখনো আমি কেবলই একজন মঞ্চকর্মী। একদিন আমাকে ফোন করলেন গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকায় এক টেলিভিশন চ্যানেল অফিসের নিচের রাস্তার ফুটপাতে দেখা হলো তাঁর সঙ্গে। ছোট্ট একটা গল্প শোনালেন। মা আর ছেলের গল্প। আবেগের গল্প। গল্পটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ ছলছল করে উঠল। এ যেন আমারই গল্প, আমার মায়েরই গল্প।
এটিই মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর গ্রামীণফোনের সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপন, মায়ের জন্য মোবাইল। বিজ্ঞাপনে যেভাবে ছেলেটাকে দেখা যায়, তার মায়ের জন্য মোবাইল কিনে বাড়িতে ফেরা, বারবার আবেগ আপ্লুত হয়ে চোখ মোছা, ছেলে যখন শহরের দিকে পা বাড়ায় তখন বারবার ফিরে তাকানো আর যত দূর মেঠোপথ দেখা যায় মায়ের ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে থাকা—এর সবকিছুই যেন আমার নিজের জীবনের গল্প। আমি সে কথাই বলেছিলাম ফারুকী ভাইকে। শুরু হলো বিজ্ঞাপনের শুটিং।
ঢাকা থেকে লঞ্চ ছাড়ল। বরিশালের উদ্দেশে। যেখানে গিয়ে রাত হয়, সেখানে আমরা নোঙর করে যাত্রি যাপন করি। আবার পরদিন শুরু হয় শুটিং। এভাবে তিন দিন ধরে শুটিং করতে করতে আমরা গন্তব্যে পৌঁছাই। বিজ্ঞাপনের শুটিং শেষে ফিরে আসি ঢাকায়।
বিজ্ঞাপনটির মিউজিকের কাজ করেছিলেন খ্যাতনামা সংগীত পরিচালক আইয়ুব বাচ্চু। মগবাজারে তাঁর স্টুডিও এবি কিচেনে গেলাম ডাবিং করতে। বিজ্ঞাপনের ডাবিং আর ভয়েস ওভার দেওয়ার জন্য। গিয়ে দেখি, কয়েকটি ছেলেমেয়ে একটা গানের মহড়া দিচ্ছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গান, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা কোলে তব/ মা গো বলো কবে শীতল হব।/ কত দূর, আর কত দূর, বলো মা।’ বাচ্চু ভাই গানটি ব্যবহার করবেন এই বিজ্ঞাপনে। ছোটবেলা থেকে রেডিওতে–ক্যাসেটে কতশতবার যে এই গানটি শুনেছি, কোনো ইয়ত্তা নেই। শুধু শোনা নয়, গুনগুন করে গেয়েছিও।
আমি ফারুকী ভাইয়ের কাছে গিয়ে অনুরোধ করলাম, একবার কি আমাকে এই গানটি গাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া যায়? ফারুকী ভাই বাচ্চু ভাইকে বললেন, চঞ্চল ভাই, একবার এক গানটা গেয়ে দেখতে চায়।
বাচ্চু ভাই একবার আমার দিকে তাকালেন। বললেন, শুরু করেন। আইয়ুব বাচ্চুর মতো শিল্পীর সামনে দাঁড়িয়ে আমি গান গাইছি, এখনো ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। উনি ট্র্যাক ছাড়লেন, আমি এক নিশ্বাসে গানটির প্রথম মুখটা গেয়ে ফেললাম। আমার চোখ দুটো তখন সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। পা কাঁপছিল ঠকঠক করে। গান শেষ করে তাকিয়ে দেখি, বাচ্চু ভাই সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। সে চোখ আমাকে সাহস জুগিয়েছিল।
তাঁকে ভয় না করে আরেকবার আমাকে গাইতে বললেন। আমি দ্বিতীয়বারের মতো গানটি গাইলাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে, আপনি যান। এবারও গাওয়ার সময় আমার চোখ বন্ধ হয়ে ছিল। সে কারণে আমি কেমন গাইলাম, সেটা বাচ্চু ভাই বা ফারুকী ভাইয়ের চোখ দেখে বুঝতে পারিনি। একবার মনে হচ্ছিল, বোধ হয় গানটা গাইতে চেয়ে বেয়াদবি করে ফেলেছি। যা-ই হোক, কাজ শেষ করে যত দ্রুত ওখান থেকে চলে যাওয়া যায়, ততই মঙ্গল। বিদায় নিলাম ফারুকী ভাই এবং বাচ্চু ভাইয়ের কাছ থেকে। সপ্তাহখানেক আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।
এরপর হঠাৎ এক বন্ধু ফোন করে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, টিভিতে তো তোর বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে। গানটাও কি তোর গাওয়া? এদিকে আমি যে বিজ্ঞাপনটা দেখব, তার উপায় নেই। কেননা, আমার বাসায় তো টেলিভিশন নেই। আমার বাসার পাশেই একজন টিভির কারিগরের দোকান ছিল। সেখানে পুরোনো টিভি মেরামত করা হতো। তখন আমি নাটকের ছোটখাটো চরিত্র পেতাম, পাসিং ক্যারেক্টার। আমি টিউশনি করে, আরণ্যক থেকে ফেরার সময় মাঝেমধ্যে সেখানে দাঁড়িয়ে টেলিভিশন দেখতাম। সেভাবেই গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনটা দেখলাম। মুগ্ধ হলাম। অবশ্য এই বিজ্ঞাপনে কাজ করার যোগসূত্র ছিল ফারুকী ভাইয়ের সঙ্গে আগে করা দুটি নাটকের কাজ। তালপাতার সেপাই আর নিখোঁজ সংবাদ।
ফারুকী ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম কাজ নিখোঁজ সংবাদ নাটকে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের অগ্রজ অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু ভাই। গ্রামীণফোনের এই বিজ্ঞাপন প্রচারের কয়েক মাস পর শুরু হলো বিশ্বকাপ ফুটবল। তখন কিছুক্ষণ পরপর সেই বিজ্ঞাপনটা দেখাত। টিভি খুললেই ওই বিজ্ঞাপন! এই বিজ্ঞাপনটা হয়ে গেল বাংলাদেশের মানুষের আবেগের একটা অংশ। রাস্তাঘাটে বের হলেই আমাকে সবাই চিনে ফেলত। কত মানুষ যে তাঁদের নিজের মায়ের আবেগ নিয়ে কত কথা বলত! মুহূর্তেই আমি হয়ে গেলাম সবার খুব কাছের আপনজন।
এর কিছুদিন পরই আমি, আমার ভাই আর ভাইয়ের বন্ধু ছোট একটা ভাড়া বাসায় উঠলাম। তিনজনের জমানো টাকা দিয়ে সেই বাসাতে কেনা হলো ১৪ ইঞ্চি ছোট্ট একটা সাদা-কালো টেলিভিশন আর একটা ক্যাসেট প্লেয়ার।
এরপর থেকে আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে টেলিভিশন দেখতে হয়নি।
সাত
মঞ্চ থেকে বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপন থেকে টেলিভিশন, টেলিভিশন থেকে বড় পর্দা। টেলিভিশনের কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠার পেছনে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনের একটা বড় ভূমিকা ছিল। হঠাৎই একদিন আমাকে ফোন করলেন জনপ্রিয় অভিনেতা ও নির্মাতা তৌকীর আহমেদ। তাঁর রূপকথার গল্প সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। শুরু হলো আমার সিনেমাযাত্রা।
মনপুরার পরিচালক গিয়াসউদ্দীন সেলিমের সঙ্গেও আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু ভাই। মনপুরা চলচ্চিত্রটির আগে আমি, গিয়াসউদ্দীন সেলিম ভাই, বাবু ভাই একসঙ্গে অনেক নাটকে অভিনয় করেছি। আমি যে বছর গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপন করি, সে বছর থেকেই সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার কাজ শুরু। সেলিম ভাইয়ের নাটকে অভিনয় মানে অন্য রকম ফুর্তি। মজা করে কাজ করা, আড্ডা, গল্প, বড় বড় শিল্পীকে সহশিল্পী হিসেবে পাওয়া। সেলিম ভাইয়ের নাটকের সুবাদে এ টি এম শামসুজ্জামান বা হুমায়ুন ফরীদির মতো অভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ ঘটল।
আমরা নাটকের শুটিং শেষে রাতের আড্ডায় বসতাম। সবাই মিলে গলা ছেড়ে গাইতাম, ‘নিথুয়া পাথারে, নেমেছি বন্ধুরে,/ ধরো বন্ধু আমার কেহ নাই’। এই গানটা আমাদের দলীয় সংগীতে পরিণত হয়েছিল। সেলিম ভাইয়ের ইচ্ছা ছিল, গানটি তিনি তাঁর সিনেমায় ব্যবহার করবেন। আমি সেলিম ভাইকে অনুরোধ করেছিলাম, তিনি যেন অভিনয়ে না হোক, অন্তত সিনেমায় আমাকে দিয়ে এই গানটি গাওয়ান। সত্যি সত্যি যখন উনি মনপুরা সিনেমার কাজ শুরু করলেন, তার আগে একদিন ফোন করে আমাকে বললেন, ‘মনপুরাতে যদি সোনাই চরিত্রে তোকে নিই, করতে পারবি না’? আমি বললাম, ‘অবশ্যই পারব।’ তিনি বললেন, চরিত্রের মতো ওজন কমাতে হবে, চুল বড় রাখতে হবে। শুরু হলো বড় পর্দার সোনাই হওয়ার প্রস্তুতি।
এরপরের গল্পটা সবার জানা। মনপুরা হয়ে গেল ইতিহাস। এক যুগের বেশি সময় পরও এখনো মনপুরার গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তারপর এক এক করে গৌতম ঘোষের মনের মানুষ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর টেলিভিশন, অমিতাভ রেজা চৌধুরীর আয়নাবাজি, অনম বিশ্বাসের দেবী, গিয়াসউদ্দীন সেলিমের পাপ–পুণ্য এবং সর্বশেষ মেজবাউর রহমান সুমনের হাওয়া। এই হচ্ছে দেড় যুগে আমার সিনেমা পর্দায় আনাগোনা। বরাবরই আমার সিনেমাগুলোতে কাকতালীয়ভাবে হলেও শিল্প এবং বাণিজ্যের সম্মিলন ঘটেছে।
আট
কোভিড আমাদের জীবনে যে স্থবিরতা এনে দিয়েছিল, তা থেকে মুক্তির পর আমরা একটা নতুন পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছি। তার সবটুকুই যে ভালো, তা নয়। তবে কিছু কিছু বিষয় আমাদের জীবনযাপনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। সারা বিশ্বের মানুষ বন্দিদশায় থাকাকালে ওয়েব দুনিয়ায় নতুন এক প্ল্যাটফর্ম হাজির হলো। যাকে বলা হচ্ছে, ওভার দ্য টপ বা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। আধুনিক এই দুনিয়াতে ওটিটি একটা প্রচলিত শব্দে পরিণত হয়েছে। দেশি–বিদেশি প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে ওটিটি কনটেন্টগুলো।
ওয়েব-দুনিয়ায় আমার প্রথম কাজ ছিল তাকদীর। নির্মাতা ছিলেন সৈয়দ আহমেদ শাওকী। দুই বাংলায় আলোচিত ও সমাদৃত হওয়া এই তাকদীর আমার ওয়েব-দুনিয়ার যাত্রাকে অনেকটাই উৎসাহিত করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় আমিও বেশ কিছু ওয়েব সিরিজে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। কনট্রাক্ট, মুন্সিগিরি, কারাগার, বলী, ঊনলৌকিক, জাগো বাহে, ষ, দুই দিনের দুনিয়া, ওভারট্রাম্প—এসব ওয়েব কনটেন্ট আমাকে অভিনেতা হিসেবে দর্শকের আরও কাছে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সিনেমাতে কাজ করার সুযোগ এখন খুবই কম। তার বিকল্প হিসেবে ওটিটির কাজগুলো আমাদের কিছুটা হলেও ক্ষুধা মেটাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য কম প্রাপ্তি নয়।
তবে সিনেমা হোক বা ওয়েব কনটেন্ট—এখনো কিন্তু আমরা পেশাদারির জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীদের ব্যক্তিগত ছাড় দেওয়ার মাধ্যমেই এখনো মোটামুটিভাবে টিকে আছে আমাদের সিনেমা আর ওয়েব সিরিজ। তবে এই দুটো মাধ্যমেই আমরা পুরোপুরি পেশাদারত্ব দেখতে চাই।
এতক্ষণ যে সিনেমা বা ওয়েব কনটেন্টের কথা বললাম, এগুলো প্রায় সব কটিই দর্শকমহলে সমাদৃত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অনেকে আমাকে ভাগ্যবানও বলে থাকেন। আমি কিন্তু কখনোই ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম না। এই কাজগুলোকেও আমি ভাগ্য বলে মনে করি না। কোনো ভালো কাজের সুযোগ পেলে জীবন দিয়ে হলেও আমি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করায় বিশ্বাসী। সেটিই আমি করে এসেছি। এই কাজগুলোর নির্মাতা আর পুরো দলের প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা।
আরেকটি কথা না বললেই নয়, কোনো কিছুতে প্রভাবিত না হয়ে সঠিক কাজটি সৎভাবে নির্বাচন করা খুব জরুরি। বরাবর সেই কাজটিই আমি করে এসেছি। একসময় খাদ্যের জন্য অনেক ক্ষুধা ছিল। সেই ক্ষুধা আর নেই। এখন কাজের প্রতি ক্ষুধাটা বেড়েছে। এখন বুঝতে পারি, পেটের খিদের চেয়ে মনের খিদে মেটানো আরও কঠিন, আরও জরুরি। তাতে তৃপ্তিও বেশি। কারণ, আমরা যে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করি, খুব বেশি ভালো কাজের পরিবেশ এখনো আমরা তৈরি করতে পারিনি। তারপরও কিছু মানুষের মেধা, শ্রম, ঘামের ফসল আমাদের এই বিনোদন অঙ্গন।
নয়
অভিনয়ের জন্য দুটো জিনিস খুব জরুরি বলে আমি মনে করি। এক. পর্যবেক্ষণ; দুই. কল্পনাশক্তি। শুধু অভিনয়ই নয়, যেকোনো কাজের জন্য প্রথমে দরকার প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতিপর্বেই শেখা এবং চর্চা অনেক বেশি জরুরি। আমার কাছে অভিনয় শেখার সংজ্ঞাটা খুব সহজ মনে হয় না। শিল্পীর জন্ম হয়, তাকে তৈরি করা যায় না। শিল্পী আর শিল্পকে কেবল লালন করতে হয়। মনটাকে সব সময় ভেজা রাখতে হয়। কোনো কিছু সৃষ্টিতে সবার আগে প্রয়োজন সাধনা। অভিনয় যেহেতু একটা সৃষ্টিশীল কর্ম, সেখানে সততা ও সাধনার কোনো বিকল্প নেই।
আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি নিজেকে চরিত্রগুলোর উপযোগী করে তৈরি করতে। কখনো সোনাই, কখনো কালুয়া, কখনো সোলেমান, কখনো মিসির আলী, কখনো চান মাঝি বা কারাগারের রহস্যমানব—প্রতিটিই আলাদা আলাদা চরিত্র। এই চরিত্রগুলো হয়ে ওঠার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আমার পর্যবেক্ষণশক্তি ও কল্পনাশক্তি।
শিল্পীর চোখ আর দশজন মানুষের মতো নয়। শিল্পীর চোখ আলাদা। আর দশটা মানুষের দেখা আর তাঁর দেখা এক নয়। যখন কেউ কোনো চরিত্রে অভিনয় করে, তখন সেই অভিনেতাকে শিল্পীর চোখ দিয়ে চরিত্রটাকে দেখতে হয়। ওই চরিত্রের যে জগৎ, সেই জগতে যাতায়াত করতে হয়। তারপর ওই চরিত্রটা হয়ে উঠতে হয়।
যেকোনো চরিত্রে অভিনয়ের প্রথম চ্যালেঞ্জ নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাওয়া। আমি সব সময় সেই চেষ্টাটাই করি। নিজেকে ভুলে একেকটা চরিত্র হয়ে ওঠার চেষ্টা। নানা বর্ণের চরিত্র হয়ে ওঠার হাজারো চেষ্টা তখনই সফল হয়, যখন দর্শক চরিত্রটা সানন্দে বিশ্বাস করে এবং গ্রহণ করে।
আরেকটি বিষয় অতি জরুরি, তা হলো শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা। শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকলে কখনো শিল্পী হওয়া যায় না।
দশ
কোনো জীবনই সহজ নয়। অভিনেতা বা শিল্পীর জীবন সম্ভবত একটু বেশি অন্য রকম, একটু বেশিই কঠিন। সাধারণ মানুষের মতো গৎবাঁধা জীবন তাঁর নয়। সময়ে সময়ে তাঁর পাল্টে যাওয়ার জীবন, আর সেটা শিল্পের প্রয়োজনে। সবকিছুতে অভ্যস্ত হওয়া একজন শিল্পীর জন্য অপরিহার্য। অভিনয়ের প্রয়োজনে, চরিত্রায়ণের প্রয়োজনে একজন অভিনেতাকে তাঁর ব্যক্তিজীবনের অনেক আরাম–আয়েশ থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। কাজটা খুব সহজ নয়। কঠিন বাস্তবতাগুলোকে মোকাবিলা করতে হয় চরিত্রের সেই জায়গায় নেমে এসেই। জীবনযাপনের সব সুযোগ সব ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। আবার প্রতিটি চরিত্রের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিচার করে ওই চরিত্র হয়ে ওঠাটাও খুব কঠিন।
একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে একজন শিল্পীর ব্যক্তিজীবনেরও কিছু পার্থক্য রয়েছে। একজন শিল্পীর যেমন সমাজ, রাষ্ট্র আর দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা; তেমনি পরিবারের প্রতিও তাঁর বিশেষ দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেটা পালন করতে গিয়েও নানা ধরনের সংকটে পড়তে হয়। একজন শিল্পী বা অভিনেতার অধিকাংশ সময়ে চলাচল তাঁর নিজস্ব মনোজগতে। যে মনোজগৎটা তাঁর শিল্পসাধনার জন্য তৈরি। সেই জগৎ থেকে এসে বাস্তব জগতের ঘরসংসার, দায়দায়িত্বের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই শিল্পী ব্যর্থ হন। তাঁকে নানান অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়। আর যদি সেই মানুষটি হয় কিঞ্চিৎ বিখ্যাত কেউ, তাহলে তো কথাই নেই। পেশাগত কারণে একজন অভিনেতার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁর নিজের কাজের জগৎ, তারপর তাঁর ঘরসংসারে ফেরা আর সেখানকার দায়দায়িত্ব পালন করা, এটা সহজ নয়।
ঘরসংসারের সঙ্গে শিল্পের এই দ্বন্দ্বটা চিরন্তন। শিল্পের প্রতি দায়িত্বশীল হতে গিয়ে একজন শিল্পীকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারে দায়িত্বহীন মানুষ হিসেবে গণ্য হতে হয়। মা, বাবা, ভাই, বোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-পরিজন, এরা সবাই সাধারণ মানুষ হিসেবেই সব দায়িত্ব-কর্তব্য আশা করে থাকে। কিন্তু একজন অভিনেতা বা শিল্পী যখন তাঁদের সেই চাওয়াটুকু পূরণে ব্যর্থ হন, তখন তাঁকে সেই অভিযোগগুলো মাথায় নিয়েই সৃষ্টিশীল কাজে মনোযোগী হতে হয়। এ এক কঠিন বাস্তবতা। যা-ই হোক, শিল্পীর জীবনের ধরনটাই আসলে আলাদা। একজন শিল্পীকে ভীষণ কঠিন রাস্তায় হাঁটতে হয়। প্রথমত, এ তাঁর শিল্পের দায়। দ্বিতীয়ত, দর্শকের দায়। তৃতীয়ত, পরিবারের প্রতি দায়।
এগারো
লোভ সংবরণ করা প্রতিটি মানুষেরই কর্তব্য। কিন্তু শিল্পীর ক্ষেত্রে এই সংবরণটা আরও বেশি জরুরি। একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী কর্মস্থলে হাজিরা দিলেই মোটা অঙ্কের সম্মানী পেয়ে যান। সেটা পেতে পেতে একটা সময় লোভ তাঁকে গ্রাস করে। আস্তে আস্তে তিনি ভুলে যান, কোন কাজটি তাঁর করা উচিত, কোনটি নয়। শুধুই নিজের আরাম–আয়েশের জন্য একসময় শিল্পের প্রতি তাঁর দায় কমে আসে। লোভ যত বাড়তে থাকে, শিল্প ততই গুরুত্ব হারায়। সৃষ্টিশীল মানুষের মেধাকে কখনো অপব্যবহার করা উচিত নয়। সে জন্য একজন শিল্পীর লোভ সংবরণ করাটাকে খুবই জরুরি বলে মানি।
তা ছাড়া শিল্পীকে অবশ্যই মানবিকও হতে হবে। কেউ মানবিক না হলে, স্পর্শকাতর মানুষ না হলে সৃষ্টিশীল কাজ করাই তো সম্ভব নয়। আবেগ আর সততা শিল্পীর সবচেয়ে বড় সম্পদ। এক জীবনে মানুষের অঢেল ভালোবাসা আর সম্মানের থেকে আর কী বড় প্রাপ্তি হতে পারে?
আমি আমার ইন্ডাস্ট্রির কথা খুব ভাবি। আমাদের দেশের কাজ দেশের সীমানা পার হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ুক, এটিই আমার প্রথম চাওয়া। সেই কাজগুলো শুরু হয়ে গেছে। অনলাইন আর ওটিটির ভেতর দিয়ে আমাদের কাজগুলো পশ্চিমবঙ্গের দর্শকের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করে ভারতের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পীদের সঙ্গে একই মঞ্চে অবস্থান করে সম্মানিত হওয়ার যে আনন্দ, সেটা শুধু আমার একার নয়, এই আনন্দ আমার দেশের, এই আনন্দ এই ইন্ডাস্ট্রির সব মানুষের। অনলাইন বা ওটিটির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভালো কাজের সুবাদেই আমাদের এই প্রাপ্তি। কাজের গণ্ডি বড় হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে যত বাঙালি দর্শক আছে, তাঁদের কাছে তো বটেই, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আমাদের কাজ বিস্তৃতি পাক।
ব্যক্তিগতভাবে আমি সামান্য যোগ্যতার একজন মানুষ। সেই কামারহাট গ্রাম থেকে এসে যতটুকু অবস্থান তৈরি করতে পেরেছি। সে জন্য এই দীর্ঘ পরিক্রমায় যাঁদের হাত ধরে হেঁটেছি, তাঁদের সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। আমার জীবনের এই সামান্য অর্জনটুকু যদি কাউকে অনুপ্রাণিত করে থাকে, তাঁকে বলব, এখানে পৌঁছানোর রাস্তাটা খুব সহজ ছিল না। কঠোর পরিশ্রম, কষ্ট, সাধনা—সবকিছু সঙ্গী করেই যুদ্ধ করতে করতে আজকের এখানে পৌঁছানো। এভাবেই সাধারণ মানুষগুলো অসাধারণ হয়ে উঠুক।