‘একা একা খেতে চাও, দরজা বন্ধ করে খাও’ সেই বিজ্ঞাপন নির্মাণের পেছনের অজানা গল্প

মডেল সাদ। সেই বিজ্ঞাপনের দৃশ্যে। ছবি: ফেসবুক
মডেল সাদ। সেই বিজ্ঞাপনের দৃশ্যে। ছবি: ফেসবুক

নব্বই দশকের শেষের দিকের কথা। সেই সময় একটি বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েই আলোচনায় আসেন মোহাম্মদ সাদ হোসাইন। তাঁর মুখের সংলাপ তাঁকে পরিচিত করে তুলেছিল। সে সময় হাসিখুশি দুষ্টুমাখা কিশোরটির মুখে শোনা যায় ‘একা একা খেতে চাও, দরজা বন্ধ করে খাও’ সংলাপ। সংলাপটিই তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। সেই মডেল ১৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে মারা গিয়েছেন। বিজ্ঞাপনটি প্রচারের দীর্ঘ ২৫ বছর পর দর্শকেরা যেন চমকে উঠেছেন। কারণ, দীর্ঘ এই সময় তিনি আড়ালেই ছিলেন। কিন্তু জনপ্রিয় হওয়া সেই বিজ্ঞাপন কীভাবে তৈরি হয়েছিল, কীভাবে সাদকে পাওয়া গিয়েছিল, কে এর নির্মাতা—সেগুলো অজানাই থেকে গেছে।

জনপ্রিয় এই বিজ্ঞাপন কে নির্মাণ করেছেন, সেই প্রশ্নের উত্তর দুই দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল না। এই প্রশ্নের উত্তর জানতে গতকাল রোববার পিপলু আর খান, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, আদনান আল রাজিবসহ প্রায় ১০ জন বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে কথা হয়। কিন্তু কেউ বলতে পারছিলেন না এই বিজ্ঞাপন কে নির্মাণ করেছেন। পরে কথা হয় অভিনেতা তারিক আনাম খানের সঙ্গে। দীর্ঘদিন থেকেই তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি নিয়মিত বিজ্ঞাপন নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। কিছুটা সময় নিয়ে তিনি জানালেন, দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে এই বিজ্ঞাপনের নির্মাতার ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যেতে পারে, তার মধ্যে একটি ছিল বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইন্টারস্পিড।

ইন্টারস্পিডের বর্তমান প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আদনান করিম। গতকাল তাঁকে ফোন করে পাওয়া গেল না। আজ সোমবার সকালে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানালেন, চিপসের সেই বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেছিলেন তাঁর বাবা প্রয়াত নির্মাতা এনায়েতুল করিম। তিনিই খুঁজে বের করেছিলেন সাদের মতো মডেল। ১৯৯৮ সালের দিকে সেই বিজ্ঞাপনের শুটিং হয়। সেই শুটিংয়ে পুরো সময় পাশে ছিলেন নারায়ণ চন্দ্র দাস। তিনি প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে ইন্টারস্পিডে ৪৫ বছর ধরে কাজ করছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিলেন আদনান করিম।

এনায়েতুল করিম। ছবি: ছেলে আদনান করিমের সৌজন্যে

কথার শুরুতেই নারায়ণ বলেন, ‘সাদকে খুঁজে বের করাটা ছিল অনেক কঠিন। বিজ্ঞাপনের জন্য তখন এনায়েত স্যার শিশু চরিত্রের অভিনেতা খুঁজছিলেন। তখন হাতে গোনা দুই থেকে তিনটি এজেন্সি ছিল। একটা এজেন্সি থেকে সাদের ছবি পাওয়া যায়। তখন স্যার সাদকে দেখেন। পরে সাদ আমাদের অফিসে আসে। স্যার কথা বলে প্রথম দেখায়ই সাদকে পছন্দ করেন। কারণ, ছেলেটা ছিল চঞ্চল। একদমই দুরন্ত। স্যার দেখার অনেকটা সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, “শিশুটিকে দিয়ে হবে।” তারপর শুরু হলো নির্মাণপ্রক্রিয়া।’

অন্য বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ের আগে মহড়া করা হলেও এই বিজ্ঞাপন নির্মাণের আগে কোনো মহড়া করা হয়নি। প্রধান চরিত্রের মডেল ছিলেন সাদ হোসাইন। কেন মহড়া করা হয়নি, সেই প্রসঙ্গে নারায়ণ বলেন, ‘স্যার (এনায়েত করিম) মনে করেছিলেন, ছেলেটি যেভাবে কথা বলছিল, সেটাই পর্দায় তুলে ধরবেন। কোনো অতি অভিনয়ের প্রয়োজন নেই। যে কারণে স্যার চেয়েছিলেন, তার সহপাঠী বা সাদ যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলের শিশুদের দিয়েই অন্য চরিত্রের অভিনয় করাবেন। এতে সাদ আরও ভালো করবে। পরে তা-ই হয়।’

মডেল সাদ হোসাইন। ছবি: ফেসবুক

সাদ পড়তেন সেন্ট যোসেফ স্কুলে। সেই স্কুলেই শুটিং হয়। সেই স্কুল থেকে অন্য শিশু চরিত্রের অভিনয়শিল্পীদের দিয়ে অভিনয় করান প্রয়াত নির্মাতা এনায়েতুল করিম। হয়তো সেই কারণে অভিনয়ে কারও মধ্যেই কোনো জড়তা ছিল না। উঁকি দেওয়া, ক্লাস রুমে বসে চিপস খাওয়া এসব দৃশ্যের শুটিংয়ের সময় শিক্ষার্থীরা অনেকেই বুঝতে পারেনি শুটিং হয়ে গেছে। সেদিন শুটিং নিয়ে খুবই আগ্রহী ছিল সাদ। সিনেমার ক্যামেরাম্যান বিদেশ থেকে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গেও আড্ডা জমে। পুরো এক দিন ও পরের দিন দুপুর পর্যন্ত চলে শুটিং।

মডেল সাদ হোসাইন। ছবি: ফেসবুক

নারায়ণ আরও বলেন, ‘শুটিংয়ের দিন সাদ তার মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। সেদিন তার অভিনয়ের প্রশংসা করেছিলেন সবাই। পরে বোম্বাইতে পোস্টের বাকি কাজ করা হয়। তখন বাংলাদেশে এই কাজগুলোর সুযোগ কম ছিল। পরে বিজ্ঞাপন প্রচার হলে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। সাদও তারকা হয়ে যায়।’ সাদকে দিয়ে পরবর্তী সময় আর বিজ্ঞাপন তৈরি করা হয়নি কেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এখনকার মতো সেই সময় কোনো মডেল বারবার বিভিন্ন প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপনের মডেল হতে পারতেন না। যে কারণে একজন দিয়ে একটি বিজ্ঞাপনই তৈরি করার একটা চল ছিল, এটাই বেশি হতো। সাদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হতো, কথা হতো। পরবর্তী সময় অভিনয় করতে চায়—এমন আগ্রহ কম ছিল। যা বুঝেছি। কারণ, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার পরও কোনো দীর্ঘ সময় অভিনয় করার কথা বলেননি।’

ছেলের সঙ্গে মডেল সাদ হোসাইন। ছবি: ফেসবুক

বিজ্ঞাপনটি প্রচারের পর রাতারাতি দর্শকদের মুখে ছিল—‘একা একা খেতে চাও, দরজা বন্ধ করে খাও’। এই সংলাপ ছড়িয়ে পড়ে। কোটি দর্শকের মুখে শোভা পাওয়া সেই সংলাপনির্মাতা ও ইন্টারস্পিডের প্রধান এনায়েতুল করিম নিজেই মূল সংলাপ লিখেছিলেন। এ জন্য দীর্ঘ একটা সময় কেটে যায়। জানা যায়, তবে প্রথম দিকে ভাবনা একজন কপিরাইটারের সঙ্গে ভাগাভাগি করেন। সেখানে থেকে মূল সংলাপকে দাঁড় করিয়েছিলেন এনায়েতুল করিম।

সাদ দীর্ঘ ১০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তাঁর স্ত্রী ও এক সন্তান রয়েছে। সেখানে সাদের ব্যবসা ছিল। সেই ব্যবসা নিজেই দেখাশোনা করতেন। জানা যায়, তার বয়স হয়েছিল ৩৯ বছরের মতো। কয়েক বছর আগে তার লিভারের সমস্যা দেখা দেয়। পুরো নষ্ট হয়ে যায়। এটা নিয়েই অসুস্থ ছিল। দুই বছর আগে অপারেশন করা হয়। তার পর থেকে মোটামুটি ভালোই ছিল। মাঝেমধ্যে শারীরিক অবস্থা খারাপ হতো। এর মধ্যে হঠাৎ করে চার দিন আগে সাদ অসুস্থ হয়। পরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আইসিইউতে ছিল, গতকাল শনিবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।’