‘আপনার একটি ছবি তুলি?’ অনুমতি নিয়ে জানতে চাই মাসুদ আলী খানের কাছে। তিনি মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান। এরপর বলেন, ‘সবাই তুলছে, তুমিও তোলো।’ গত মে মাসের ২৪ তারিখে মেরিল-প্রথম আলোর আয়োজনে এসেছিলেন মাসুদ আলী খান। ইউনাইটেড কনভেনশন সেন্টারের দ্য গ্রেস মিলনায়তনে শেষ দেখা। দীর্ঘদিন পর অভিনয় অঙ্গনের প্রিয় মানুষদের পেয়ে তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন। কৌতূহল নিয়ে সবাইকে দেখছিলেন।
অনুষ্ঠান শেষে অনেকেই এসেছিলেন এই প্রবীণ অভিনেতার সঙ্গে দেখা করতে। পাশে ছিলেন খুরশীদ আলম, সৈয়দ আবদুল হাদী, ফজলুর রহমান বাবুসহ অনেকে। তরুণেরা কেউ কেউ সালাম করছিলেন মাসুদ আলী খানকে। এর ফাঁকে দীর্ঘদিন পরে চেনা অঙ্গনের মানুষদের পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই আড্ডা জমে ওঠে। শারীরিক অবস্থা, কার বাসা এখন কোথায়—এসব কথাই হয়।
‘মামা’ সম্বোধন করে খুরশীদ আলম বিদায় নেন। একে একে সবাই বিদায় নিতে থাকেন। হলরুম থেকে একজনের সহায়তায় হুইলচেয়ারে বের হন এই গুণী অভিনেতা। তাঁর সঙ্গে শেষবার কথা হয়। তিনি জানান, মেরিল-প্রথম আলোর আজীবন সম্মাননা তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন। এবার সেটা পেয়ে খুশি। তিনি যতই এগিয়ে চলেন, অভিনয়শিল্পীরা তাঁকে ঘিরে ধরেন, একসঙ্গে ফ্রেমবন্দী হন।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ, একা চলতে পারতেন না। বাসায় ঘোরাঘুরি করলেও হুইলচেয়ার দরকার হতো। এর সঙ্গে শারীরিক অসুস্থতা তো ছিলই। নিয়মিত চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকতে হতো। নিয়ম করে ওষুধ খাওয়া, ঘুমানো ছিল রোজকার রুটিন। সেই দৈনন্দিন রুটিনে বৃহস্পতিবারও দুপুরে খেয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। রুমে তাঁর দেখাশোনা করতেন স্ত্রী। তিনি একসময় বুঝতে পারেন, মানুষটা নড়েন না, কোনো কথা বলেন না কেন? কাছে গিয়ে দেখেন সব শেষ। প্রিয় মানুষকে হারিয়ে বাক্রুদ্ধ হন। কাউকে ফোন দেওয়ার মতো কোনো শক্তি ছিল না। মাসুদ আলী খানের ভাগনে বউ শারমীনা আহমেদ জানালেন, তাঁর মামিশাশুড়ি একেবারেই ভেঙে পড়েছেন। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
শারমীনার সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, তাঁর মামাশ্বশুর আনুমানিক ৪টা ২০ মিনিটের দিকে মারা যান। তিন সপ্তাহ আগেই মামাকে সর্বশেষ দেখে গিয়েছিলেন। প্রবীণ এ অভিনেতা কেমন ছিলেন শেষ দিনগুলোতে? শারমীনা জানালেন, নিয়ম করে ফোনে খবর নিতেন। এমনিতে ব্যক্তিজীবনে আমুদে মানুষ ছিলেন মাসুদ আলী খান। শেষ জন্মদিন ৬ অক্টোবরও পরিবারের সবাইকে নিয়ে দিনটি কাটিয়েছেন। বিশেষ দিনটি পেরোনোর দুই দিন পরে পারিবারিকভাবে সবার উপস্থিতিতে দিনটা উদ্যাপন করা হয়। সেখানে আত্মীয়স্বজন সবাই এসেছিলেন। ৯৫ বছর বয়সেও আনন্দে আত্মহারা ছিলেন তিনি। শিশুর মতো খুশি হয়েছিলেন তিনি।
এই অভিনেতার কোনো অপ্রাপ্তি ছিল? এমন প্রশ্নে শারমীনা বলেন, ‘মামার সব সময় একটাই চাওয়া ছিল, আনন্দে থাকবেন, আনন্দে রাখবেন। তিনি সবাইকে নিয়ে থাকতে চাইতেন। আর বাসায় জনসমাগম পছন্দ করতেন। গ্যাদারিংয়ে থাকতে চাইতেন। যে কারণে প্রতিদিনই দেখা যেত চার-পাঁচজন মামার বাড়িতে এসে খোঁজখবর নিতেনই। আমরা নিয়ম করে মামাকে দেখতে আসতাম। আমরা সবাই যেন সব সময় মিলেমিশে থাকি, এটা তিনি চাইতেন। সেভাবেই আমাদের দেখে গিয়েছেন।’
বাংলাদেশের সবচেয়ে বয়স্ক অভিনেতা মাসুদ আলী খান। তাঁর সমসাময়িক অভিনয়শিল্পীরা সবাই আগেই বিদায় নিয়েছেন। তাঁর সময়ের, বয়সের কোনো বন্ধু ছিল না। কিন্তু সহজে সবাইকে তিনি আপন করে নিতে পারতেন।
‘পরিবারের সবাইকে তিনি স্নেহ করতেন। মামার মুখে কোনো দিন উচ্চ স্বরে কথা শুনিনি। আমরা সব সময় ছিলাম বন্ধুর মতো। পরিবারের যে ছোট সদস্য, তিনিও ছিলেন বন্ধুর মতো। তিনি সবার সঙ্গে মিশতেন, খোঁজখবর নিতেন। এখন যে অনেক পরিবারের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, এটা তিনি পছন্দ করতেন না। আমাদের একটা কথাই বেশি বলতেন, মিলেমিশে থাকতে। এক হয়ে থাকতে। জীবনটা যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই কাটিয়েছেন মামা’—কথাগুলো বলেন শারমীনা।
বয়সের ভার ও করোনার মধ্যে অভিনয় থেকে একেবারেই দূরে সরে যান। সেই দিনগুলোতে কথা হতো তাঁর সঙ্গে। সময় ভালো কাটলেও একসময় মন খারাপ করে বলতেন, কথা বলার মতো সমবয়সী কেউ নেই। এটা তাঁকে খুবই কষ্ট দেয়। কাছের প্রিয়জনেরা অনেকেই মারা গেছেন। ২০২১ সালের দিকে অভিনয় ক্যারিয়ার তাঁকে কষ্ট দিত। কারণ, কাছের যাঁরা বন্ধু-সহকর্মী ছিলেন, তাঁরা প্রায়ই তাঁকে বলতেন অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁর ‘একুশে পদক’ পাওয়া উচিত। কেউ বলতেন ‘মেরিল-প্রথম আলো’ আজীবন সম্মাননা পাওয়া উচিত। বোঝা যেত, ক্যারিয়ারে অপ্রাপ্তি নিয়ে তাঁর অভিমান রয়েছে। কিন্তু কখনোই সংশ্লিষ্ট কাউকে সে কথা বলতেন না।
পরিবারের লোকেরা এই অপ্রাপ্তি নিয়ে জানতেন। শারমীনা বলেন, ‘মামার একসময় আফসোস ছিল “একুশে পদক” আর “মেরিল-প্রথম আলো” আজীবন সম্মাননা পাওয়া নিয়ে। তিনি আশায় থাকতেন, শেষ পর্যন্ত এই সম্মাননাগুলো পাবেন। এগুলো পাওয়ার পরে মামার আর কোনো অপ্রাপ্তি ছিল না। তিনি খুবই খুশি ছিলেন।’
করোনা মহামারি সময়ের কথা। সেবার বেশ হতাশ হয়েছিলেন মাসুদ আলী খান। হঠাৎ জানতে পারেন, তাঁর নামে কে বা কারা ভুয়া ফেসবুক আইডি চালু করে। সেই ভুয়া আইডি থেকে তানভীন সুইটি, নির্মাতা কাউসার চৌধুরীসহ অনেকের কাছে ডকুমেন্ট চেয়েছে। এ নিয়ে মন খারাপ করেন মাসুদ আলী খান।
সেই সময়ে ‘নদী ও নারী’ সিনেমার নায়ক এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘আমার নামে কে বা কারা ভুয়া ফেসবুক আইডি চালু করেছেন। আমার নাম ব্যবহার করে কে, কেন এভাবে লোক ঠকানোর চেষ্টা করছে, বুঝতে পারছি না। শুনে আমি অবাক হয়েছি। যত দিন অভিনয় করেছি, কারও সঙ্গে কোনো দিন খারাপ সম্পর্ক বা বাড়তি দুই কথা হয়নি। এখন এই বয়সে কেন আমি মানুষকে ঠকাতে যাব। আমার নামে যদি সে কারও কাছে টাকা চেয়ে বসে, বিপদে ফেলে, তাহলে আমার মানসম্মান থাকবে?’