বিটিভির মাথায় একাধিক ডায়মন্ড মুকুট আছে। এক নম্বর হলো, এটি এই উপমহাদেশের প্রথম টেলিভিশন চ্যানেল। দুই. পৃথিবীর মধ্যে প্রথম বাংলা চ্যানেল বিটিভি। এ কারণে বিটিভির আলাদা একটা মর্যাদা আছে, যা সব সময় মনে করি। প্রথমে যখন টেলিভিশন এল, ১৯৬৪ সালে, আমরা তখন ছাত্র। টেলিভিশনে গান ও নাটক দেখলাম। তখন থেকেই মনে একটা অনুপ্রেরণা জাগল, আমি যদি টিভিতে অভিনয় করতে পারতাম, তাহলে ভালো হতো। তখন আমরা পড়াশোনার মধ্যেও অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। ১৯৬৬ সালে ফোর্থ ইয়ারে যখন পড়ি, তখন বিটিভিতে অডিশন দিলাম। সেবার অডিশনে পাস করতে পারলাম না। এটা নিয়ে একটা ক্ষোভ ছিল, কষ্ট ছিল। ১৯৬৭ সালে যখন পাস করে বের হলাম, তারপর গ্রুপ থিয়েটার দিয়েই প্রথম টেলিভিশনে যাত্রা শুরু। প্রথম নাটক ছিল ‘ইডিপাস’। তখন টেলিভিশনের সঙ্গে যে একটা যোগসূত্র তৈরি হলো, তা এখনো আছে। দীর্ঘ ৫৮ বছর।
বাংলাদেশ টেলিভিশন হচ্ছে এখনকার যে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে, সেটার আঁতুড়ঘর। বিটিভি থেকে ভালো ভালো সব অনুষ্ঠান হয়েছে। সেসব অনুষ্ঠান অনুসরণ করে বা দেখে–শিখে সেখান থেকে প্রাইভেট চ্যানেলগুলো অনেক অনুষ্ঠান বানায়, প্রচার করে। সেই হিসেবে বলব, বিটিভি গর্ব করতেই পারে। আজকে নানা ধরনের অনুষ্ঠান, টক শো, নাটক—এসবের জনক বাংলাদেশ টেলিভিশন। বর্তমানে প্রাইভেট যেসব চ্যানেল আছে, তার বেশির ভাগ জুড়ে শীর্ষস্থানে যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই কোনো না কোনো সময় বিটিভিতে ছিলেন। তাঁদের সেই অভিজ্ঞতায় বেসরকারি অনেক চ্যানেল সমৃদ্ধ হয়েছে।
আমাদের নামকরা প্রযোজক, যাঁরা বিটিভি থেকে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুন, আতিকুল হক চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান, মোস্তফা কামাল সৈয়দ, নওয়াজিশ আলী খান, বরকতউল্লাহসহ প্রত্যেক মানুষ টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে যে অবদান রেখেছেন এবং এখনো কেউ কেউ রেখে চলছেন, তা সত্যিই আনন্দ ও গর্বের। বিটিভি থেকে এসেই তো তাঁরা প্রাইভেট চ্যানেলের বিকাশে অবদান রেখে চলছেন। সেই কৃতিত্ব বিটিভিকে দিতেই হবে। তাঁদের হাত দিয়ে নাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, পরিচালক, সংগীতশিল্পী, উপস্থাপকসহ যাঁরাই এসেছেন, মিডিয়ার আকাশে আজও তাঁরা উজ্জ্বল তারকা হয়ে জ্বলজ্বল করছেন। আজকে দুঃখ লাগে, হীরকজয়ন্তীতে এসে আমরা কোনো অনুষ্ঠান নিয়ে আর গর্ব করতে পারি না। অথচ আমরা একটা সময় পর্যন্ত বিটিভি নিয়ে গর্ব করতে পারতাম।
টেলিভিশনে সরকারি দখলটা যখন প্রকট হয়ে উঠল, তখন থেকে এর গ্রহণযোগ্যতা কমতে শুরু করল। তখন থেকেই দেখেছি, সরকারি লোকদের অভিনয় করতে হবে, গান গাইতে হবে, তাঁদেরই সবকিছুই করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানের অনুমোদন নিতে হবে। অনুষ্ঠান কি যাচ্ছে, দলের লোকেরা সেই অনুষ্ঠানে আছে কি না, অন্য দলের লোক নেওয়া যাবে না—এসব যখন চলতে শুরু করল, তখন থেকে মান নষ্ট হতে শুরু হলো। যখনই বিটিভির অনুষ্ঠানের মান নিম্নমুখী হতে লাগল, মানুষও বিমুখ হয়ে গেল বিটিভি থেকে। একটা সময় তো মানুষ বিটিভি দেখা বন্ধই করে দিল। বাধ্য হয়ে যেখানে দেখত, সেখানে আসলে অন্য কোনো চ্যানেল দেখার সুযোগ ছিল না। স্যাটেলাইটও ছিল না।
হীরকজয়ন্তীতে আমাদের প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত, বিটিভিকে আবার তার পুরোনো গৌরবে ফিরিয়ে আনা। সরকারের যে প্রভাব, সেটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মন্ত্রণালয় থেকে লোক নিয়ে এসে এই প্রতিষ্ঠানকে সরকারি দপ্তর বানানো থেকে মুক্ত করতে হবে। এটা হতে হবে একটা সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান। টেলিভিশন কখনো দাপ্তরিক অফিস নয় যে ফাইল চলবে আর নাটক বানানো হবে। ফাইল চলবে গান হবে। নো...এমনটা চলতে পারে না।
বিটিভিতে যাঁরাই থাকবেন, তাঁদের সৃজনশীল হতে হবে। আমরা যাঁদের দেখেছি টেলিভিশনে—রামপুরায় বা ডিআইটি ভবনে, তাঁরা কিন্তু চাকরি করতেন না। তাঁরা সৃষ্টির নেশায় মেতে থাকতেন। সৃষ্টির মধ্যে তাঁরা আনন্দ খুঁজতেন। তাঁরা রাজনীতিসচেতন হলেও তাঁদের মধ্যে রাজনীতি বলতে কিছুই ছিল না। তাঁরা সৃষ্টিশীল কাজ করতেন। এখন তো সৃজনশীল সেই অবস্থা নেই। সবাই চাকরি করেন। কে কয়টা নাটক-অনুষ্ঠান বানাচ্ছেন মাসে, সেটাই তাঁর চাকরি। এই চাকরির গণ্ডি থেকে বিটিভিকে বের করে আনতে হবে।
টেলিভিশনের পুরোনো লোকদের মধ্যে যাঁরা বাইরে আছেন, তাঁদের ডেকে নিয়ে নতুনদের সেই অভিজ্ঞতা শোনাতে হবে। তাঁদের পরামর্শ নিতে হবে। এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান শুধু অবহেলার কারণে মানুষবিমুখ হয়েছে।
সংবাদের নামে যে কী হতো! শুধু গুণগান গাওয়া আর গুণগান গাওয়া। এখন আবার সেই চেষ্টা চলছে গুণগান গাওয়ার।
এদিকে কারা গান গাইছেন, তাঁদের অনেকে চিনিও না। বিষয়টা এমন না যে তাঁরা ভালো গাইছেন না, তা নয়। সেসবের একটা নিয়মমাফিক শিডিউল থাকা দরকার। যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদের অনেককেও চিনি না। তাঁদের মান অনুযায়ী অনুষ্ঠান দেওয়া উচিত। টেলিভিশনের হারানো গৌরব যে ফিরিয়ে আনা হবে, এই অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমের সেই চেষ্টার লক্ষণও দেখছি না। তবে আশায় আছি, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে সেই চেষ্টা হয়তো করবে।
হীরকজয়ন্তীতে আমার আন্তরিক শুভকামনা। একটা দাবি করছি, দয়া করে টেলিভিশনে দাপ্তরিক কোনো কর্মকর্তা আনবেন না, সৃজনশীল কাউকে আনবেন।
বিটিভির দায়িত্বশীলদের বলতে চাই, শিল্পীদের অবশ্যই শিল্পীর দৃষ্টিতে ও মর্যাদায় দেখতে হবে। কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের বিবেচনায় তাঁদের দেখা উচিত নয়। তবে এটাও ঠিক, কিছু শিল্পী দলদাস হয়ে পড়েন, তখন তাঁর মধ্যে শিল্পের প্রতি ভালোবাসা আর থাকে না। তাঁদের কারণে পুরো শিল্পীসমাজের সমস্যা হয়। আমার একটা মতাদর্শের প্রতি সমর্থন থাকতেই পারে, কিন্তু তার মানে এটা নয় যে আমি দলদাস হয়ে যাব। আমি অমুক দল সমর্থন করেছি বলে যে আরেক দলের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারব না, এটাও উচিত নয়। শিল্পীর ক্ষেত্রে এই দল ক্ষমতায় এসেছে বলে ওই দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী শিল্পীকে নেব না, তাঁকে নিয়ে কাজ করব না, এটা তো হতে পারে না। এই সব ধ্যানধারণা ও মানসিকতা থেকে বিটিভিকে বেরিয়ে আসতে হবে। আবার প্রকৃত শিল্পীদের আঁতুড়ঘর যেন হয় বিটিভি। আমি চাইব, বাংলাদেশের দর্শক বেসরকারি চ্যানেলের চেয়ে বিটিভির প্রতি যেন তাঁদের আকর্ষণ বাড়ে, সেই চেষ্টা বিটিভিকে করতে হবে।