একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনয়শিল্পী, নাট্যকার মাসুম আজিজ। ছবি: সংগৃহীত
একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনয়শিল্পী, নাট্যকার মাসুম আজিজ। ছবি: সংগৃহীত

সেদিন মাসুম আজিজকে না পেয়ে হারানো বিজ্ঞপ্তির মাইকিং করা হয়েছিল

তরুণ মাসুম আজিজ তখন নিজেকে গানের মানুষ বলে পরিচয় দিতেন। কিশোর বয়স থেকেই তাঁর গান নিয়ে নানা পরিকল্পনা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার আগে থেকেই গান নিয়ে থাকতেন। গান গাওয়া ও বাদ্যযন্ত্র বাজানোতে তিনি ছিলেন দক্ষ। গান থেকে একসময় তিনি অভিনয়ের প্রেমে পড়েন। একসময় অভিনয় ঘিরেই ঘুরতে থাকে জীবন। গান, অভিনয় সব ফেলে গেল বছর এই দিনে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে তাঁকে স্মরণ করছেন অনেকেই।

অভিনেতা ছাড়া মাসুম আজিজ চিত্রনাট্যকার ও নাট্য নির্মাতা হিসেবেও পরিচিত। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের খ্যাতি রয়েছে তাঁর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি থিয়েটারে কাজের মাধ্যমে অভিনয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর ১৯৮৫ সালে তিনি প্রথম টিভি নাটকে অভিনয় করেন। হুমায়ূন আহমেদের ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’, সালাহউদ্দিন লাভলুর ‘তিন গ্যাদা’সহ অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি।

যেভাবে অভিনেতা হলেন
মাসুম আজিজ তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে সময় আন্তবিশ্ববিদ্যালয় হল নাটক প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। মাসুম আজিজকে হল থেকে বলা হয়, একটি নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করতে। সে সময় ক্যাসেট দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তৈরি করা হতো। এ প্রসঙ্গে মাসুম আজিজ এর আগে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করব। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকতাম। নাটকের প্রধান চরিত্রের অভিনেতা শফিক কামাল নামের একজন ছিলেন। যথারীতি রিহার্সাল হচ্ছে, কিন্তু কামাল ভাই আসেন না। হলে প্রভোস্ট স্যার তো কিছুটা বিরক্ত। তখন প্রভোস্ট স্যার আমাকে বললেন, “মাসুম, তুমি প্রক্সি দাও।” প্রথম আমি অভিনয়ের প্রক্সি দিলাম।’

মাসুম আজিজ

এভাবে সাত দিন প্রক্সি দিতে হয় মাসুম আজিজকে। সে সময় অভিনয়ে প্রক্সি দিলেও অভিনয় নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা ছিল না। এদিকে নাটকের অভিনেতা কামাল জানিয়ে দেন, তিনি নাটকটি করছেন না। এমন কথায় বিপদে পড়ে যায় আলাওল হল কর্তৃপক্ষ। সে সময় কোনো উপায় না পেয়ে হলের প্রভোস্ট শফিক হায়দার চৌধুরী মাসুম আজিজকে বলেন নাটকের শফিকের চরিত্রটিতে অভিনয় করতে।

মাসুম আজিজ এ প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, ‘স্যার বলায় আমি অভিনয় করলাম। একসময় কম্পিটিশনে আমি সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেলাম। এরপর চট্টগ্রামের থিয়েটারে যাওয়া–আসা শুরু হলো। অভিনয় করতে গিয়ে বসে থাকতাম। পরের বছর আবার ইন্টার হল ড্রামা কম্পিটিশনে আমার ওপর হল থেকে দায়িত্ব দেওয়া হলো নাটক নির্মাণের।’ সেই প্রথম ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘জ্বালা’ নাটকটি পরিচালনা করেন। নাটকটি মঞ্চায়ন হলে দর্শকদের প্রশংসা পায়। এই নাটকের জন্যও আন্তবিশ্ববিদ্যালয় হলের সেরা নির্দেশক হয়েছিলেন মাসুম আজিজ।

পরপর দুবার হল থেকে সফল হয়ে মাসুম আজিজের মনে হয়, তাঁকে দিয়ে অভিনয় হতে পারে। তত দিনে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে। কিন্তু মনে একটাই ভাবনা, অভিনয় করলে তাঁকে ঢাকায় যেতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় আসেন। বিভিন্ন সময় চাকরি করলেও ১৫ দিনের মাথায় ছেড়ে দেন। তখনো অভিনয়ের নেশায় নিয়ম করে বাসায় রেওয়াজ করতেন। আর প্রিন্টিং সরবরাহের ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
প্রিন্টিং সরবরাহের ব্যবসার মধ্যেই একদিন ঢাকা পদাতিকের এস এম সোলায়মানের সঙ্গে পরিচয় হয়। এস এম সোলায়মান তাঁকে জামিল আহমেদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মাসুম আজিজের হারমোনিয়াম দিয়ে, তাঁরই বাসায় চলত অনুশীলন। মাসুম আজিজ দূর থেকে দেখতেন সেগুলো। এতেই তাঁর ভালো লাগত। সে সময় ‘ইন্সপেক্টর জেনারেল’ নাটকের ডিসি চরিত্রে অভিনয় করতেন মুকুল নামের একজন। এই অভিনেতা ফিল্মের ওপর একটি কোর্স করার কারণে শেষ মুহূর্তে নাটকটি থেকে সরে যান।

তখন নাটকটিতে অভিনয়ের সুযোগ পান মাসুম আজিজ। জড়িয়ে যান ঢাকা পদাতিকে। তখন অভিনয়ের জন্য ঢাকায় থাকতে অনেক সরকারি–বেসরকারি চাকরি করেননি এই অভিনেতা। সেই থেকেই অনেক বাধা পেরিয়ে অভিনয়ের জন্য ঢাকায় মাসুম আজিজ।

তিনি অভিনয়কে এতটাই ভালোবাসতেন যে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি যদি মঞ্চে অভিনয় করতে করতেই মারা যেতাম, তাহলে আমি হতাম ভাগ্যবান ব্যক্তি।’ দীর্ঘ প্রায় এক দশক মঞ্চে অভিনয় করে ১৯৮৫ সালে তিনি প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনে অভিনয় করেন।

সনাতন গল্প–এর দৃশে্য মাসুম আজিজ ও সহশিল্পীরা। ২০ বছর আগে ছবিটির কাজ শুরু হয়েছিল

শৈশবে দুরন্ত ছিলেন

শৈশবে দুরন্ত ছিলেন মাসুম আজিজ। সময় পেলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দে ছুট। দিনভর ছুটে চলতেন গ্রামে, কখনো শহরের আনাচ–কানাচ। ঝাঁপিয়ে পড়তেন নদীতে, কখনো মার্বেল, সিগারেটের প্যাকেটের কার্ড দিয়ে খেলা নিয়ে মেতে থাকতেন। এভাবে একদিন বের হয়ে আর ফিরে আসেননি এই অভিনেতা। সেবার চার দিন নিখোঁজ ছিলেন। তাঁকে না পেয়ে কুমিল্লা শহরে হারানো বিজ্ঞপ্তির মাইকিং করা হয়েছিল।
১০ ভাইবোনের মধ্যে মাসুম আজিজ ছিলেন সপ্তম। শৈশবে ছাত্র হিসেবে ভালো থাকলেও জীবনযাপন ছিল বাউণ্ডুলে। বাবার চাকরির সুবাদে দীর্ঘদিন কুমিল্লায় ছিলেন। প্রথমে কুমিল্লার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করেন। সে সময় পড়াশোনায় অমনোযোগী ছিলেন।

বন্ধুদের সঙ্গে সময়টা কেটেছে অনিয়মে। সারা দিন বাইরে ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরা ছিল রেওয়াজ। ফিরলেই বাবার হাতের পিটুনি ছিল নিয়মিত। এমন অবস্থায় একবার তিনি একাই চলে যান অনেক দূরে। বাড়ির কাউকে না জানিয়ে চার দিন ছিলেন অন্য এক এলাকায়।

এ প্রসঙ্গে মাসুম আজিজ এক সাক্ষাৎকারে জানান, শৈশব থেকে হিসাবের বাইরে জীবন যাপন করতেন। সুযোগ পেলে পালাতেন, ঘুরতে বের হতেন। অনিয়মই তাঁর কাছে ভালো লাগত। তিনি বলেন, ‘হিসাব করা জীবন আমি ভাবতে পারিনি। আমি সব সময় অগোছালো ছিলাম। এমনও হয়েছে, আমার জন্য পুরো কুমিল্লা শহরে নিখোঁজ সংবাদ দিয়ে মাইকিং করা হয়েছে। আমি চার দিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে পাহাড়তলীর এক বাড়িতে ছিলাম। সেখানে খাওয়াদাওয়া করছিলাম, ভালোই লাগছিল। সেখান থেকে চার দিন পর বাড়িতে ফিরেছিলাম।’
মঞ্চ ও টিভি নাটকের জ্যেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী মাসুম আজিজ ক্যানসারের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে হৃৎপিণ্ডের সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০১৭ সালে তাঁর হৃৎপিণ্ডে চারটি ব্লক ধরা পড়লে অস্ত্রোপচার করা হয়।