হঠাৎ গভীর রাতে অভিনেতা ফারুক আহমেদের মুঠোফোনে রিং বাজতে শুরু করে। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এমন সময় ফোন পেয়ে কিছুটা কৌতূহলী এই অভিনেতা। তাঁকে ফোন দিয়েছেন আরেক অভিনেতা আবদুন নূর সজল। কথা বলার কিছুক্ষণ পরই ফারুক আহমেদের বাসায় হাজিরও হন সজল। গভীর রাতে সজলের আসার উদ্দেশ্য শুনে আপ্লুত হন ফারুক আহমেদ।
দুই প্রজন্মের এই অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে সম্পর্কটা দীর্ঘদিনের। পরিচয়ের পর থেকে ফারুক আহমেদ সজলকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করেন। একসঙ্গে অনেক নাটকে অভিনয় করলেও অনেক দিন তাঁদের দেখা হচ্ছিল না। একসঙ্গে শুটিংয়ে দেখাও হচ্ছিল না। ভালোবাসার টানেই সজল ছুটে যান ফারুক আহমেদের বাসায় দেখা করতে।
অভিনেতা ফারুক আহমেদ বলেন, ‘এখন তো স্বার্থ ছাড়া অনেকেই অনেকের সঙ্গে কথাও বলে না। সেখানে সজল যখন ফোন দিয়ে বলল, ‘ভাই, অনেক দিন আপনার সঙ্গে দেখা হয় না, দেখার ইচ্ছা করছে।’ পরে ওকে সঙ্গে সঙ্গে আসতে বলি। ১০ মিনিটের মধ্যে ও বাসায় আসে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এত রাতে তুমি এলে। কোন সমস্যা? সে বলল, ‘‘কোনো সমস্যাও না, কোনো কাজও না। দুই দিন ধরে তোমার কথা মনে পড়ছিল। তাই তোমাকে দেখতে এলাম।’’ এটা শুনে বেশ ভালো লাগল।’
অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে দিন দিন সম্পর্কের জায়গায় দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এমনও শোনা যায় অনেক অভিনয়শিল্পী একে অন্যের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেন না। সেখানে সজলের সঙ্গে দেখা হওয়াটা খুশির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফারুক আহমেদ বলেন, ‘খুশিতে আমার মন ভরে গেল। আমরা বেশ কিছু সময় কথা বললাম, তাঁকে আমার লেখা বই উপহার দিলাম। তারপর কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেল। আমি জানি না ভালোবাসা আসলে কী? সজলের ভালোবাসাটা বোঝা যায়। এখানে কোনো স্বার্থ নেই। কিন্তু খারাপ লাগল, গভীর রাতে সজলকে কিছুই খাওয়াতে পারিনি, তোমাদের ভাবি ঘুমিয়ে গিয়েছিল। শুধু কোক খেয়েছে।’
পরিচয় হওয়ার অনেক আগে থেকেই ফারুক আহমেদকে চেনেন সজল। এই অভিনেতার ভাষায়, ‘ফারুক ভাইকে কে না চেনে। সেই স্কুল, কলেজে থেকেই চিনি। কিন্তু পরিচয় অভিনয় করতে গিয়ে। ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বারবার শুধু এটাই মনে হয়েছে, এমন ভালো মানুষের সংস্পর্শ পাওয়া আশীর্বাদ। তিনি যেমন গুণী তেমনি মিশুক।’
তাঁদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক হওয়ার পেছনে আরেকটা কারণ তাঁরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সূত্রে সব সময় আলাদা স্নেহ পেয়েছেন সজল। সেই স্নেহ এখনো আগের মতোই আছে। একবার শুটিংয়ের একটি ঘটনা ভাগাভাগি করে সজল বলেন, ‘শুটিংয়ে ফারুক ভাই ব্লু রঙের অনেক সুন্দর একটি জিনস পরে এসেছিল। আমি সেটার প্রশংসা করেছিলাম। দুই দিন পরই দেখি ভাই আমাকে একই রকমের একটি জিনস গিফট করছে। এই ভালোবাসা বলার মতো।’
সজল দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অভিনয় অঙ্গনের সবচেয়ে বেশি শিখেছেন সিনিয়র
অভিনয়শিল্পীদের কাছ থেকে। তিনি মনে করেন, সিনিয়র অভিনয়শিল্পীরা অনেক বিষয়ে ভালো জানেন। তাঁদের কাছ থেকে সব সময় ভালো পরামর্শ পাওয়া যায়। যে কারণে শুটিংয়ে নিজ থেকেই সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলতেন, আড্ডা জমাতেন। গড়ে উঠত বন্ধুত্ব।
সজল বলেন, ‘সিনিয়র–জুনিয়র বন্ধন সব প্রজন্মের অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে থাকা উচিত। এটি জুনিয়রদের তৈরি করে নিতে হবে। তাদের সিনিয়রের সঙ্গে আগেই কথা বলতে হবে। সম্মান জানাতে হবে। টেকসই কোনো কিছুর জন্য এই বন্ডিংটা জরুরি। যখন তরুণেরা এটা বুঝতে পারবে, তখন তাদের জানার পরিধি অনেক বাড়বে। একটা গাইড লাইন পাবে। আমি যা শিখেছি, সবই সিনিয়রদের কাছ থেকে।’
বর্তমান সময়ে সিনিয়র অভিনয়শিল্পীরা শুটিং ইউনিটে অনেকটাই অবহেলায় থাকেন। এমন খবর বেশ কয়বার গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এ নিয়ে নাটকের সংগঠনগুলোও মিটমাট করতে বসেছে। সিনিয়ররাও অনেক সময় অভিযোগ করেন, যে সম্মানের জন্য অভিনয় করেন, সেই সম্মান তরুণেরা অনেকেই করেন না। তবে এসব নিয়ে বর্তমান সময়ের তরুণ অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না সজল। তিনি মনে করেন, নিজেদের মধ্যে সম্পর্কটা ভালো হলে এটা নিজেদের জন্য শক্তি।
সজল বলেন, ‘এমন অনেক সময় গেছে যখন কোনো একটি দৃশ্য বা গল্প নিয়ে দোটানায় রয়েছি। তখন সেটা নিয়ে সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলেছি। একবার পাভেল (আজাদ আবুল কালাম) ভাইকে ফোন দিলাম, তিনি অনেক সময় নিয়ে সুন্দর করে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। আবার বন্যা মির্জা আপা, শহীদুল আলম সাচ্চু ভাইসহ এমন অনেকের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছি। একবার একটি দৃশ্যের প্রয়োজনে সাচ্চু ভাইকে ফোন করলাম তিনি শুটিং থেকে এসে আমাকে বুঝিয়ে তাঁর শুটিংয়ে গেলেন। এটা সম্ভব হয়েছে সম্পর্কের কারণে। আমাদের মধ্যে সেই সম্পর্কটা তৈরি করতে হবে।’
সজল আরও বলেন, ‘আমার সঙ্গে শুটিংয়ে ফারুক ভাইয়ের অনেক বিষয় নিয়ে গল্প হতো। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়টা দেখেছেন। সেই গল্প করতেন। অজানা অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে পারতাম। তখন ভাইকে বলেছিলাম, ঘটনাগুলো বই হিসেবে লিখতে বলি। সেই বই সেদিন রাতে উপহার দিল ভাই। যার অনেক ঘটনাই আমার জানা। পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়েই ভাই বই লিখেছেন। সেই বই থেকেও অজানা অনেক কিছু জানার আছে। তাঁর কাছ থেকে এমন দুটি বই পাওয়া আমার জন্য সৌভাগ্যের।’