বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন ইরফান সাজ্জাদ। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় তেমন একটা সুবিধা করতে পারলেন না। শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেন। কিন্তু বিষয় পছন্দ না হওয়ায় পরে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে ভর্তি হলেন। কলেজের নবীনবরণের দিন মাথায় লাল ক্যাপ পরে গিয়েছিলেন। চুল ছিল অনেক বড়। বিশাল এক রুম। সেদিন ক্লাসের এক শিক্ষক সবার সামনে তাঁকে কাছে ডেকে মাথার ক্যাপ ফেলে দেন আর চুল ছোট করতে বলেন। পুরো ঘটনাটা ক্লাসের ১৫০ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক দেখেছিলেন। সবাই তাঁকে দেখে হাসছিলেন। লজ্জায় এক পাশে গিয়ে বসেন ইরফান। কিন্তু এই হাসিই যে ইরফানের জীবনের সেরা পাওয়াকে সামনে আনবে, তা কি কেউ ভেবেছিলেন?
শিক্ষকের কথামতো নবীনবরণ শেষে ভদ্র ছেলের বেশে ক্লাসে উপস্থিত হলেন ইরফান সাজ্জাদ। তাঁকে দেখে এবার হাসাহাসি হলো আরও বেশি। সামনের সারিতে বসা কিছু নারী সহপাঠী তো হাসি থামাতেই পারছিলেন না। পেছনে বসতেন ইরফান। এদিকে বিজ্ঞান থেকে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে পড়ার কারণে তেমন কিছুই বুঝতে পারতেন না। অনেকটা একাকিত্ব পেয়ে বসে তাঁকে। বেশির ভাগ সময় একাই মন খারাপ করে বসে থাকতেন।
এ সময় ভালো লাগার মধ্যে ছিল শুধু একটি মেয়ের হাসি। পেছনে বসে এটা বেশ উপভোগ করতেন ইরফান। এক মেয়ে বেশ ঘন ঘন তাকাতেন। মেয়েটি দেখতে বেশ। এই চোখাচোখি থেকেই একসময় তাঁদের মধ্যে কথা বলা শুরু হয়। পেয়ে গেলেন বন্ধু। এভাবেই বন্ধুত্ব। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা বুঝতে পারেন একে অন্যের প্রতি দুর্বলতা। বন্ধুত্ব রূপ নেয় প্রেমে।
হিসাববিজ্ঞানের দুই শিক্ষার্থীর প্রেম ভালোই চলছিল। এর মধ্যেই বুঝতে পারেন ঝড়ের পূর্বাভাস। কারণ, প্রেমিকা শারমীনের বাসা থেকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। শারমীনকে কেউ কেউ দেখতে এসে পছন্দও করছেন। প্রেমিকার বিয়ের খবর শুনে দুজনই পরিবারের কাছে সময় চান। ফলে যা হওয়ার, তা–ই হলো। দুজনের পরিবার জেনে গেল তাঁদের পছন্দের কথা। দুই পরিবারই তাঁদের সম্পর্ক মানতে নারাজ।
ইরফান বলেন, ‘তখন আমরা সবে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। কিছুই করি না। এমন ছেলের সঙ্গে তো যেকোনো পরিবার চাইবে না মেয়ের বিয়ে দিতে। কারণ, মেয়ের ভবিষ্যৎ আছে। আবার আমার পরিবার আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এই বয়স ও সময়ে বিয়েতে রাজি নয়। আমাদের নিয়ে তাদের একটা স্বপ্ন আছে। আমরা বিয়ে করে কীভাবে চলব? আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেই প্রশ্ন সামনে আসে। কোনো পরিবার কি চায় তাদের ছেলেমেয়েরা অনিশ্চিত পথে পা বাড়াক? যে কারণে তারা রাজি হয় না। কিন্তু আমি ও শারমীন সব সময় রাজি ছিলাম।’
পরের ঘটনা যেন সিনেমার মতো। দুজনই দুই পরিবারে কথা বলেন। দুই পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে বসানোর চেষ্টা করা হয়। সেখানেও কেউ কেউ এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কারণ, দুজনের ভবিষ্যৎ। এদিকে প্রেমিকার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। সেসব বিয়েও ভাঙতে হয় ইরফানকে। এমন ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর একসময় শারমীনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁকে ইরফানের উপহার দেওয়া ফোনটি পরিবারের লোকেরা কেড়ে নেন।
ইরফান বলেন, ‘আমার ও শারমীনের জীবনটা সিনেমার মতো। তখন আমি ঢাকায় “সুপার হিরো সুপার হিরোইন” প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। ১৫তম অবস্থানে আছি। এর মধ্যে শুনলাম, ঢাকার এক ছেলের সঙ্গে শারমীনের বিয়ের কথা হচ্ছে। সেই ছেলের নম্বর নিয়ে তাঁদের বাসায় গিয়ে দেখা করলাম। আমাদের সম্পর্কের কথা খুলে বললাম। বিয়ে না করতে অনুরোধ করলাম। আর বললাম আমার আসার কথা শারমীনের পরিবারের কাউকে না জানাতে। পরে তাঁরা শারমীনের পরিবারের কাছে আমার সব কথা জানিয়ে দেন। শারমীনের সঙ্গে আমার কথা বলাই প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পরে সে লুকিয়ে অন্যের ফোন দিয়ে কথা বলত। এভাবেই চলছিল। কিন্তু বিয়ে ভেঙে দেওয়ার খবরে তাঁরা একটু রাগান্বিত হয়েছিলেন।’
এর মধ্যে আবারও প্রেমিকার বিয়ের আলাপ শুরু হয়। বিয়ে ভেঙে দেওয়াকে তাঁরা অন্যভাবে নিয়েছেন। ইরফান বিয়ের জন্য তাঁর মা-বাবাকে রাজি করান। শারমীনের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করেন। দুই পরিবার বসে। বিয়ে নিয়ে অনেক কথা হয়। কিন্তু বিয়ে হবে কি না, এমন সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। দুই পরিবার তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। এ ছাড়া বেশ কিছু বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। দেখা যায়, এক পরিবারের একজন রাজি, তো অন্যজন রাজি নন।
পরে ইরফান পরিবারের সদস্যদের বলে দেন যে তিনি যেভাবেই হোক শারমীনকে বিয়ে করবেন। এতে তাঁর ভাই পরিবারের সম্মানের কথা চিন্তা করে, পালিয়ে বিয়ে করতে নিষেধ করেন। তাঁর মা-বাবা তখনো কিছু বলেননি। ইরফান বলেন, ‘যেহেতু রাজি করাতে পারছিলাম না, তখন নিজেরাই চিন্তা করি বিয়ে করার। শারমীন রাজি হয়ে যায়। অনেকেই রাজি ছিলেন না। আমি বাড়ি থেকে টি-শার্ট পরে বের হয়ে যাই। শারমীনের পরনে যা ছিল, সেভাবেই কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করি। তখন আমার হাতে ছিল মাত্র দেড় হাজার টাকা। টাকাটা আমাকে বাবা দিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে দুলাভাই ও পরিচালক হাবীব শাকিল ভাই ছিলেন। বিয়ে হয়ে গেল। সাদামাটাভাবে আমাদের দু–একটি ছবি তোলা হলো। কিন্তু পরে আমাদের আরও অনেক বেশি জটিলতায় পড়তে হয়।’
সম্প্রতি এই অভিনেতা সেই বিয়ের দিনের স্মৃতি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। অনেকেই ভেবেছেন, দিনটা তাঁদের বিবাহবার্ষিকীর। ইরফান জানান, তাঁরা ডিসেম্বরে বিয়ে করেছিলেন। কয়েক দিন আগে বাড়িতে গিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন আগের সেই সব স্মৃতির ফ্রেম সামনে নিয়ে আসেন তাঁর বাবা। তিনিই ছেলের বিয়ের ছবিগুলো যত্নে রেখেছেন। শেষে ইরফান জানান, ‘সবার সিদ্ধান্তই ঠিক ছিল। কিন্তু প্রেম তো কোনো কিছুই মানে না। ভালোবাসার মানুষকে কেউ হারাতে চায় বলেন? আমরাও চাইনি। পরবর্তী সময়ে শারমীনের সাত বছর লেগেছে আমার পরিবারের সবার সঙ্গে মানিয়ে নিতে। আমার লেগেছে ১৫ বছর। আমাদের জীবনটা আসলে সব সময় সিনেমার মতো। এখন সবাইকে নিয়ে ভালো আছি, এটাই শুকরিয়া,’ বলেন ইরফান।