দুই দিন আগেও হাসিখুশি নিশাত বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ফেসবুকে স্টোরি ভাগাভাগি করেছিলেন। জ্বর থেকে সেরে উঠে বন্ধুদের আড্ডায় যুক্ত হতে চেয়েছিলেন। আর চেয়েছিলেন অভিনয় করে স্বাবলম্বী হতে। ১৯ বছরের নিশাতের সেই ইচ্ছা পূরণ হলো না। ডেঙ্গুতে সব শেষ। এইচএসসি পরীক্ষার্থী তরুণ অভিনেত্রী নিশাত গতকাল বৃহস্পতিবার মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। গতকাল রাত ১০টায় এই তথ্য জানিয়েছেন তাঁর কাছের বন্ধু মোহম্মদ হৃদয়।
জানা গেছে, চার দিন আগে হঠাৎই জ্বরে আক্রান্ত হন নিশাত আরা আলভিদা। প্রথমদিকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিলেও পরে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় চিকিৎসক হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। তাঁর প্লাটিলেট কমতে থাকে। অবশ্য এক দিনের মাথায় প্লাটিলেট আবার বাড়তে থাকে। কিছুটা সুস্থ বোধ করায় বাসায় চলে আসে উল্লেখ করে মোহম্মদ হৃদয় বলেন, ‘আমার সঙ্গে নিয়মিত কথা হয়েছে। গতকাল (বুধবার) রাতেও কথা হয়েছে। সে জ্বরকে সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছিল না, বলছিল ঠিক হয়ে যাবে। মনে করেছিল, ওষুধ খেলেই সেরে যাবে। পরে দুপুরে শুনি সে মারা গেছে। ওর ডে স্টোরি তখনো চলছিল। আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না।’
হৃদয় বলেন, ‘গত বুধবার সে হাসপাতাল থেকে বাসায় আসে। তখন সে অনেকটাই সুস্থ। অনেক সময় ধরে তাঁর সঙ্গে কথা হলো। তাঁর কিছুটা মন খারাপ ছিল। কারণ, আমরা একসঙ্গে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। ও ঢাকায়, আমি নাটোরে। সর্বশেষ সে অ্যাকাউন্টিং পরীক্ষা দিয়েছে। জানতে চেয়েছিলাম, পরীক্ষা কেমন হয়েছে? সে শুধু বলেছিল খারাপ হয়েছিল। পরীক্ষার পর মন খারাপ করে কেঁদেছিল। এরপর আর কোনো পরীক্ষা দিতে পারেনি। এর মধ্যে দুপুরের দিকে শুনি, সে মারা গিয়েছে।’
জানা যায়, গতকাল সকাল আটটায় নিশাত বাসাতেই মারা যান। তাঁর বেড়ে ওঠা নাটোর জেলায়। সেখান থেকে এসএসসি পাস করেন। নাটোরেই একটি কলেজে ভর্তি হয়ে পরে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। থাকতেন মায়ের সঙ্গে। হৃদয় বলেন, ‘নিশাতের মা–বাবা আলাদা থাকেন শুনেছি।’
ঢাকায় আসার পর নিশাত কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। মনেপ্রাণে অভিনেত্রী হতে চেয়েছিলেন। সেই পথেই হাঁটেন। একটু একটু করে চেষ্টা করেন অভিনয়ে কিছু করার। হৃদয় বলেন, ‘দুই বছরের মতো হবে, সে ক্যারিয়ার হিসেবে অভিনয় পছন্দ করে। সবকিছু ভুলে প্রায়ই বলত, “দেখিস, আমি একদিন বড় তারকা হব। অনেক বড় অভিনেত্রী হব। মডেল হব।” অভিনয় নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল। ইচ্ছা ছিল থিয়েটারে অভিনয় শেখার। কয়েক মাস আগে সে থিয়েটারিয়ান নামের একটি নাট্যদলে কর্মশালা করেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল, অভিনয় নিয়ে অনেক কিছু জানতে হয়। থিয়েটার শুরুর ইচ্ছা ছিল। আর কোনো জানার সুযোগ পেল না।’ জানা গেল, দীর্ঘ দুই বছরে সম্প্রতি নিশাত একটা নাটকে পুরো গল্পে ছিলেন। আগে দেখা যেত সাইড ক্যারেক্টারে। দুই বা তিনটি দৃশ্যে দেখা যেত। তাঁর জীবনসংগ্রামের কথা শুনে অনেকেই তাঁকে কিছুটা অভিনয়ের সুযোগ দিচ্ছিলেন।
গতকাল দুপুর থেকেই নিশাতের ফেসবুক প্রোফাইলজুড়ে শুধুই এক শোকের আবহ। বন্ধু–সহকর্মীরা অকালে চলে যাওয়া নিশাতের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। কেউ দুই দিন আগের, কেউ সপ্তাহখানেক আগের স্মৃতিগুলো ফেসবুকে লিখেছেন। সাজ্জাদ চৌধুরী নামের এক সহকর্মী লিখেছেন, ‘কদিন আগেই “সুপারভাইজার” নাটকে কাজ হলো সদা হাসিখুশি বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে। এখনো চেহারাটা চোখে ভাসছে।’ সুপ্তা নামের আরেকজন লিখেছেন, ‘মেয়েটার ডে স্টোরি এখনো চলছে, কিন্তু সে আর নাই। আমার একটা কাজের সেটে পরিচয় হয়েছিল। অনেক জুনিয়র একটা মেয়ে, চোখে অনেক স্বপ্ন।’
তরুণ অভিনেত্রী নিশা হক লিখেছেন, ‘তুমি চলে যাবা এত তাড়াতাড়ি ভাবি নাই, সেদিনও আমাদের দেখা করার কথা ছিল। যদি জানতাম শেষ দেখা হবে, একটাবার জড়ায় ধরতাম।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘কী লিখব বুঝতে পারছি না। কিছু বলার মতো খুঁজেও পাচ্ছি না। খবরটি শুনে আমি রীতিমতো থমকে গিয়েছি। আমার একটি নাটকের কাজে ওর সঙ্গে আমার একবারই দেখা হয়েছিল। মাত্র একটি দিন এবং একটি রাতে বুঝতে পেরেছি, মেয়েটা খুবই ভালো ছিল। কাজের সময় অনেকের সঙ্গে পরিচয় হলেও তার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার পর একটু ভালো সম্পর্ক হয়। তার সঙ্গে এক দিনের পরিচয় এবং তার এক দিনের কথায় আমার চোখে আজ পানি এনে দিয়েছে।’
মাত্র চার দিন আগে নিশাত তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘পরের জন্মে শালিক হব’। তখনো কি তিনি ভেবেছিলেন, চার দিনের মধ্যেই সত্যি সত্যি তিনি মারা যাবেন। চলে যাবেন পরপারে? ডেঙ্গু কেড়ে নেবে তাঁর ছোট্ট জীবন, তাঁর সব স্বপ্ন। এক দিন আগেও তিনি ফেসবুকে হাসপাতালে ভর্তির ছবি পোস্ট করেছিলেন। এসব মনে করেই বন্ধু–সহকর্মীরা শোক প্রকাশ করছেন। গতকালই নিশাতের মরদেহ নাটোরে নিয়ে যাওয়া হয়। নাটোর হাফ রাস্তা এলাকায় তাঁরা থাকতেন। সেখানেই একটি কবরস্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়েছে।