জামালউদ্দিন হোসেনের সঙ্গে ৭৭ বছরের বন্ধুত্ব অভিনেতা আবুল হায়াতের
জামালউদ্দিন হোসেনের সঙ্গে ৭৭ বছরের বন্ধুত্ব অভিনেতা আবুল হায়াতের

মিন্টু-রবির ৭৭ বছরের বন্ধুতা

চলে গেলেন মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পী জামালউদ্দিন হোসেন। তিন সপ্তাহের বেশি কানাডার ক্যালগ্যারির একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ১১ অক্টোবর সন্ধ্যায় মারা যান এই অভিনেতা। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে গেছেন। গতকাল বাদ জোহর তাঁকে ক্যালগ্যারিতেই সমাহিত করা হয়েছে, জানালেন ছেলে তাশফিন হোসেন। ১৯৪৩ সালে ভারতের চব্বিশ পরগনায় জন্মগ্রহণ করলেও বাবার চাকরি সূত্রে চট্টগ্রামেই কেটেছে এই অভিনয়শিল্পীর ছোটবেলা। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে মঞ্চনাটকে অভিনয় শুরু করেন জামালউদ্দিন হোসেন। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের এই সদস্য পরে টেলিভিশন নাটক এবং চলচ্চিত্রেও কাজ করেন। একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। জামালউদ্দিন হোসেনের সঙ্গে ৭৭ বছরের বন্ধুত্ব অভিনেতা আবুল হায়াতের। বন্ধুর চলে যাওয়ার খবরে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন আবুল হায়াত

একদম ছোটবেলায়, তিন-চার বছর বয়সে, বলা যায় জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। একই পাড়ায় থাকতাম। চট্টগ্রামের টাইগারপাস পাহাড়ের নিচেই ছিল আমাদের কলোনি। আমাদের বাসার ঠিক পেছনেই ওরা থাকত। আমার আব্বা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। তিনি চট্টগ্রাম রেলওয়ে ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ওখানে নিয়মিত নাটক হতো। জামালের আব্বা সিদ্দিক হোসেন মাঝেমধ্যে নাটকে টুকটাক অভিনয় করতেন। আমি ও জামাল ছোটবেলা থেকেই তাই নাটক দেখতাম।

জামালের ডাক নাম ছিল মিন্টু। আমার রবি। জামাল আমার চেয়ে বয়সে এক বছরের বড়; কিন্তু ওটা কোনো দিনই বাধা ছিল না। ওই পাড়ায় একটি কথা চালু ছিল, ‘মিন্টু-রবি লিচু খায়!’ মা–বাবার একমাত্র সন্তান ছিল জামাল। খুব শান্ত, সুশীল। একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণেই হয়তো সব সময় ওকে চোখে চোখে রাখতেন ওর মা। সারা দিন দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন, ছেলে কখন আসবে, কখন যাবে। আমার বাড়িতে আমরাও খুব অন্য রকম ছিলাম, তাই আমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্বটা দারুণ ছিল। মিন্টু খুব বই পড়ত। স্বপন কুমারের গোয়েন্দা সিরিজ। আমি শুকতারা নামের একটা ম্যাগাজিন পড়তাম। ভারত থেকে বের হতো। আমাদের মধ্যে বইপত্র লেনদেন হতো। স্কুলে থাকতেই সে একবার গল্প লিখে ফেলল।

অভিনয়শিল্পী জামাল উদ্দিন হোসেন ও রওশন আরা হোসেন

আমরা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম নাটক করব। আমার এক মামা ছিলেন। আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। তিনি বললেন, টিপু সুলতান করো। জামাল যেহেতু লম্বা আছে, সে টিপু সুলতান চরিত্রটা করুক।

বই কিনে আমাদের রিহার্সাল দেওয়া শুরু করলেন মামা। আমরা নিজেরাই রিহার্সাল করলাম। বাসার সামনের খালি জায়গায় চৌকি দিয়ে মঞ্চ বানালাম। ওটাই ছিল আমাদের প্রথম নাটক।

জামাল সেন্ট প্ল্যাসিড স্কুলে পড়ত, আমি কলেজিয়েট স্কুলে। ওরা পরে ট্রান্সফার হয়ে পোর্ট ট্রাস্টে চলে গেল, নদীর ধারে। দুজন দুই জায়গায় থাকলেও যোগাযোগ ঠিকই ছিল। খেলাধুলা হতো। আড্ডাও হতো। স্কুল শেষে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয় জামাল, আমিও। দুজনেই সায়েন্সে ছিলাম। কলেজ শেষে আমরা বুয়েটে ভর্তি হলাম। সে মেকানিক্যালে, আমি সিভিল। আমাদের মাথার মধ্যে নাটকটা কিন্তু রয়ে গিয়েছিল। বুয়েটেও একসঙ্গে নাটক করা শুরু করলাম। আমি, জামালউদ্দিন, আবুল কাশেম, গোলাম রাব্বানী, সিরাজুল মজিদ মামুন—বুয়েটে আমাদের এই পাঁচজনের একটা গ্রুপ ছিল। সব নাটকের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে আমরাই থাকতাম।

আবুল হায়াত

বুয়েট পাস করার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে করেছিল জামাল। মণি ভাবি (রওশন আরা হোসেন) তো আমাদের খুবই প্রিয় ভাবি, ভালো অভিনেত্রীও। চট্টগ্রামে একটা স্টিল মিলে চাকরি নিল জামাল। ওয়াসায় চাকরি নিয়ে আমি ঢাকায় থেকে গেলাম। যোগাযোগ ছিল। ঢাকায় থেকে নাগরিকে যোগ দিলাম। টেলিভিশন, মঞ্চ সবই করছি। সে যেহেতু ঢাকার বাইরে ছিল, এসব মিস করত। তারপর কুষ্টিয়ায় স্পিনিং মিলে চাকরি নিল। একসময় ঢাকায় বদলি হয়ে এলো। আস্তে আস্তে নাগরিকে ঢুকল। টেলিভিশনে নাটক করা শুরু করল। নাগরিকে একসঙ্গে বহু বছর কাজ করেছি আমরা। পারিবারিকভাবেও আমরা যুক্ত ছিলাম।

১৫ বছর ধরে অভিনয়ে একেবারে অনিয়মিত জামাল। এই সময়টায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া-আসার মধ্যে ছিল। মাঝেমধ্যে যখন দেশে ফিরত, টুকটাক অভিনয় করত। সাত–আট বছর ধরে একেবারে অভিনয়ে নেই, থাকে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়।

কানাডা থেকে ছেলে তপু (তাশফিন হোসেন) আমাকে লিখেছিল, আমরা ভেন্টিলেটরটা খুলে দেব, তারপর আল্লাহ ভরসা। কালকে (শুক্রবার) শুনতে পেলাম, ভেন্টিলেশনটা খুলে দিয়েছে। এরপর থেকেই মনটা খারাপ। শনিবার সকালে খবর পেলাম, জামাল আর নেই। ভেন্টিলেটর খোলার পর কিছুক্ষণ ভালো ছিল।

রওশন আরা হোসেন ও জামালউদ্দিন হোসেন

গত বছর আমেরিকায় গিয়েছিলাম। যাওয়ার খবর শুনে ফোন করেছিল। আমেরিকায় থাকা অবস্থায় আমার সঙ্গে জামালের দুই-তিন দিন কথা হয়েছে। ভাবিও তখন অসুস্থ। ভালো করে কথা বলতে পারছিলেন না। তার পরও জোর করে কথা বলেছিলেন। আসার পরও একবার কথা হয়েছিল।

মানুষ হিসেবে জামাল দুর্দান্ত ভালো। বন্ধুবৎসল। জামালের মতো বন্ধু হারানোর কষ্টটা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। একসঙ্গে লম্বা একটা জীবন কাটিয়েছি। অনেক কাছাকাছি, অনেক ঘনিষ্ঠভাবে কাটিয়েছি। ৭৭ বছরের বন্ধুত্ব। সবচেয়ে বড় কথা, জামালের মতো অভিনেতা হারানো সবচেয়ে কষ্টের। ওর বৈচিত্র্যময় অভিনয়, বিভিন্ন চরিত্রে যেভাবে অভিনয় করত, সত্যিই তা অতুলনীয়। ভিলেন থেকে শুরু করে নায়ক—সব ধরনের চরিত্র সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারত। অনেক বয়স্ক, অল্প বয়স্ক এবং কমেডি চরিত্রেও দারুণ মানিয়ে যেত। রোমান্টিক নায়কেও করেছে এক সময়। অভিনয়গুণে সে প্রতিটি চরিত্র হয়ে উঠত। কণ্ঠ ভালো। হাইট ভালো। একজন পরিপূর্ণ শিল্পী বলতে যা, জামাল আসলে তা–ই ছিল।