বিটিভি বরাবরই সরকারের পক্ষপাতিত্ব করে, প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ অভিযোগ। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারের দাবি উঠেছে, এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় এই গণমাধ্যমের সংস্কারের দাবিও আছে। কেমন হওয়া উচিত বিটিভি? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন মনজুর কাদের
আগামী ২৫ ডিসেম্বর পথচলার ৬০ বছর পূর্ণ করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। দীর্ঘ এই সময়েও নিজের স্বাধীন একটা ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারেনি এই গণমাধ্যম। নাট্যনির্মাতা ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাব্যবস্থাপক নওয়াজীশ আলী খান মনে করেন, গণমানুষকে সুশিক্ষা, সঠিক তথ্য ও সুস্থ বিনোদন দেওয়া বিটিভির কাজ। এটাই হওয়া উচিত, হতে পারত, হওয়া সম্ভবও, মনে করেন তিনি। বিটিভি সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন, বিটিভি সম্প্রচারের শুরুর পর থেকে পক্ষপাতমূলক সংবাদ প্রচার করেছে, সেই পাকিস্তান আমল থেকেই শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন কোনো দিন ভালো কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করেনি, যদিও চালুর সময় এটিই ছিল ১ নম্বর লক্ষ্য। সুস্থ বিনোদন দেওয়াও লক্ষ্য ছিল, এটা একটা সময় পর্যন্ত পেরেছে।
শিক্ষা, তথ্য ও বিনোদন—এ তিনটিই ছিল বিটিভির মূল লক্ষ্য। কিন্তু বিটিভি চাইলেও এই তিনের যথাযথ বাস্তবায়ন হবে না। সরকারে যাঁরা থাকেন, তাঁদের চাইতে হবে। কারণ, এটা সরকারি প্রতিষ্ঠান, নয়তো সরকারকে ছেড়ে দিতে হবে বিবিসির মতো, মনে করেন নওয়াজীশ আলী খান।
বিটিভির হওয়ার কথা ছিল পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টার; অর্থাৎ যা জনগণের সেবার জন্য সম্প্রচার করবে। দেশের জনগণ যাতে তথ্যসমৃদ্ধ নাগরিক হয়ে ওঠে এবং তাদের শিক্ষা ও বিনোদনের প্রয়োজন পূরণ হয়, এ জন্য কাজ করবে। এই লক্ষ্যে তৈরি হলেও বিটিভিকে মূলত গণমাধ্যম হতে না দিয়ে সরকারের ‘মাউথ পিস’ হিসেবে গড়ে তোলা হয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন। তিনি বলেন, ‘প্রথম যুগে যখন বিটিভি একমাত্র দৃশ্য সম্প্রচার মাধ্যম ছিল, তখনো নানা বয়সী দর্শকের জন্য নানা ধরনের সৃজনশীল অনুষ্ঠান তৈরি করার যে প্রচেষ্টা ছিল, পরে নানা টিভি চ্যানেল চালু হওয়ার পর এ প্রচেষ্টাও আর দৃশ্যমান থাকেনি। সরকারি প্রচারযন্ত্রের একটি কার্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়ার ফলে দর্শক সম্পৃক্ততা হারায় বিটিভি।’
টেলিভিশনটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রচারিত সংবাদ নিয়েই প্রশ্ন ওঠে, প্রতিষ্ঠানটির সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সুবর্ণস্মারক স্মরণিকায় এমনটা জানান টেলিভিশনের প্রথম মহাপরিচালক জামিল চৌধুরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে থেকে ডিআইটি ভবনের বিপরীতে পল্টন ময়দানে চলছিল ফাতেমা জিন্নাহর জনসভা। প্রেসিডেন্ট পদে আইয়ুব খানের বিপরীতে ভোটে লড়ছিলেন তিনি। সভার বক্তাদের মধ্যে ফাতেমা জিন্নাহ নিজেই ছিলেন। তখন ময়দানের চারপাশে প্রাচীর-জাতীয় কিছু ছিল না। জনসভার একাংশ এসে বাধা দিয়েছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। পরে তাদের শান্ত করা হয়েছিল। তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর টেলিভিশনে যে সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল, সেখানে ফাতেমা জিন্নাহর সেই বিশাল জনসভার সংবাদের নামগন্ধও ছিল না। জামিল চৌধুরী আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘রাত আটটায় প্রচারিত হলো বাংলা খবর। ডিআইটি ভবনের ঠিক উল্টো দিকের মাঠে মিস জিন্নাহর সভার কোনো উল্লেখ ছিল না খবরে। আর তখনই শুরু হলো গণমানুষের কাছে টেলিভিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর প্রক্রিয়া। আঁতুড়ঘরেই টেলিভিশন দর্শকদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।’ নওয়াজীশ আলী খানও মনে করেন, বিটিভির আস্থার সংকট বেশি তৈরি হয় সংবাদে।
নব্বই দশকে আবদুল্লাহ আল–মামুন, আতিকুল হক চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান, মোস্তফা কামাল সৈয়দ, বরকতউল্লাহর মতো ব্যক্তিত্ব বিটিভিতে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা গল্পে আবদুল্লাহ আল–মামুন নাটক বানিয়েছিলেন, যেখানে মঞ্চে সবাই ধুতি পরা ছিলেন। প্রশ্ন উঠেছিল শিল্পীদের পোশাক নিয়েও। নওয়াজীশ আলী খান বললেন, ‘তৎকালীন প্রশাসনিক পর্যায়ে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা বলতেন। অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে অন্যথায় আমরা তেমন কোনো বড় ধরনের সমস্যায় পড়িনি।’ তবে সংবাদে পরিবর্তন আনতে চাইলে যে পারত, সেটাও মনে করছেন এই টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। তাঁর মতে, ‘বিটিভি যে এটা পারত, তা বোঝা যেত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তখন সাংবাদিকতার আসল চেহারা বেরিয়ে আসত।’
সরকারের নিয়ন্ত্রণে বিটিভি বদলানো কঠিন
বিটিভিতে কাজ করেছেন এমন অনেকেই মনে করছেন, সরকার যদি বিটিভির ওপর নিয়ন্ত্রণ না ছাড়ে, এটার চেহারা বদলানো খুব কঠিন। নওয়াজীশ আলী খান বললেন, ‘আমরা যাঁরা টেলিভিশনে ক্যারিয়ার শুরু করেছি, তাঁদের থেকে কেউ কোনো দিন ডিজি (মহাব্যবস্থাপক) হননি, হয়েছেন বাইরে থেকে। সরকার থেকে। এরপর কিছুদিন চুক্তিতে এসেছেন, তা–ও সরকারের পছন্দের লোক। বিষয়টা হচ্ছে, সরকারের নিয়ন্ত্রণ যত দিন থাকবে, সরকার যেভাবে চাইবে, সেভাবে খবর প্রচারিত হবে। তবে একটা সময় পর্যন্ত প্রোগ্রামে তা ছিল না, আস্তে আস্তে ঢুকেছে। তাই অনুষ্ঠানের মানও পড়েছে। কারণ, যে দল ক্ষমতায় আসত, তারা প্রভাবিত করত। নিয়োগেও খবরদারি চলত। সৃজনশীল ও মেধাবী থাকা সত্ত্বেও দলের পক্ষের না হওয়াতে চাকরির ক্ষেত্রে যথাযথ স্থানে অনেককে প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি।’
দক্ষ লোকের অভাবও একটা বড় সমস্যা। ১৯৬৪ সাল কিংবা তারপরও যাঁরা নিয়োগ পেতেন, পরীক্ষা দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির পাশাপাশি সংস্কৃতিমনা এবং নাটক ও গান সম্পর্কে ধারণা একজন প্রযোজকের যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হতো। এখন বেশির ভাগই রাজনীতিকীকরণ হয়েছে। যে দল ক্ষমতায় থাকবে, তাদের চাওয়া প্রাধান্য পায়। নওয়াজীশ আলী খান জানালেন, তাঁদের সময়ে অনুষ্ঠানে অন্তত তা পারত না। কখনোই হতে দেননি। তিনি বললেন, ‘আমি আমার এক নাটকে তো “তুই রাজাকার” শব্দও ব্যবহার করেছি। সম্ভব ছিল, আমরা সাহস করতাম। ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতাও ছিল। আমাদের প্রশ্ন করলে যৌক্তিক জবাব দিতাম। অযৌক্তিক কিছু মেনে নিতাম না। যুক্তিবাদী ছিলাম, সাহসীও ছিলাম। এখন সাহস কমে গেছে। মনে হয়, বিটিভিতে সাহসী মানুষ নেওয়া হয়ও না। নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব সবচেয়ে বেশি, এটাই ক্ষতিকর।’
সমালোচনাকে স্বাগত জানাতে হবে
বরাবরই সরকার নিয়ন্ত্রিত সংগঠন হিসেবে কাজ করেছে বিটিভি। সরকারকে সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা, প্রোপাগান্ডা এজেন্সি হিসেবে কাজ করাটাই যেন এর প্রধান উদ্দেশ্য, মনে করছেন এনটিভির বার্তা বিভাগের প্রধান জহিরুল আলম। এসবের বদল প্রয়োজন, যদিও ভাবমূর্তির এই সংকট রাতারাতি বদলানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, সরকারি একটা নীতি প্রণয়নের প্রয়োজন। সমাজের মানুষের ভিন্নমত, সব পক্ষের বক্তব্যকে ধারণ করার যে সাংবাদিকতার নীতি, সেই নীতির ব্যাপারে বিটিভি কখনোই অনুগত থাকেনি। সমালোচনাকে স্বাগত জানাতে হবে। বিটিভিতে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ হয়েছে, জনমতের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে, যখন যাঁর স্বার্থ, সে অনুযায়ী তথ্যপ্রবাহ করা হয়েছে।
বিটিভিকে সরকারের মালিকানাধীন না রেখে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় রূপ দিতে পারলে ভালো হবে মনে করেন জহিরুল আলম। তিনি বলেন, ‘পতিত সরকারের সময়ও শুনেছি, সরকারপ্রধান বলতেন, “সপ্তাহে এক দিনও আমার চেহারা দেখাবে না।” কিন্তু তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি থেকে পুরোপুরি সরে গেছেন!’ কেমন বিটিভি দরকার, তা জানতে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে সামগ্রিক একটা সংলাপ আহ্বান করার প্রস্তাবও দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি নতুন সংগঠন বা নতুন একটা প্রতিষ্ঠান করা যেতে পারে, যা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়, স্বাধীনভাবে কাজ করবে। তারা বিটিভির স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পাশাপাশি নাগরিক কণ্ঠস্বর যেন ওঠে আসে, সেদিকে খেয়াল রাখবে। তারা পর্যবেক্ষক, পর্যালোচক হিসেবে কাজ করবে।’
আমলাদের নিয়োগ দেওয়া যাবে না
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইমরান হোসেন বিটিভি নিয়ে তাঁর ছোটবেলার স্মৃতির কথা তুলে ধরে বললেন, ‘বিটিভিতে অনুষ্ঠান দেখার যে ছোটবেলার স্মৃতি আমাদের রয়েছে, তা তুলনাহীন। সে সময় বিটিভি ব্যতীত আর কোনো চ্যানেল ছিল না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত এই চ্যানেল আর জ্বলে উঠতে পারেনি। নানা সময়ে যাঁরা সরকারে এসেছেন, তাঁদের একটি চটুল নির্বাচনী ইশতেহারে থাকত বেতার–টিভির স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই কেউই কাজটি করেননি। মোটাদাগে বিটিভিকে যে দল যখন সরকারে ছিল, তারাই তাদের ইচ্ছে–খুশিমতো ব্যবহার করেছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে বিটিভির খুব একটা পরিবর্তন সম্ভব নয়। বিবিসির মতো পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং করা গেলে এটিকে বাঁচানো সম্ভব।’
টেলিভিশন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি ট্রাস্টি কমিটি করার পরামর্শ দিয়েছেন ইমরান হোসেন। তাঁর মতে, সব কর্মকর্তা–কর্মচারী ট্রাস্টি কমিটির তত্ত্বাবধানে কাজ করবেন। দরকার হলে আইন সংশোধন করতে হবে। ইমরান হোসেন বললেন, কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তিন–পাঁচ বছরের চুক্তিতে তাঁদের নিয়োগ দিতে হবে, যাঁরা ভালো পারফর্ম করতে পারবেন না, তাঁদের বাদ দিতে হবে। সব ধরনের স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে। দেখা যায়, আমলাদের একটি অংশ এখানে নিয়োগ দেওয়া হয়, যাঁরা তা শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে দেখে থাকেন এবং কাজে খুব একটা আগ্রহ বোধ করেন না। একই সঙ্গে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সম্প্রচার কৌশল যুক্ত করতে হবে। গবেষণা সেল তৈরি করতে হবে, সেটার ভিত্তিতেই নতুন নতুন অনুষ্ঠান তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। বিটিভি যেন ‘ভয়েস অব দ্য ভয়েসলেস’ হয়ে উঠতে পারে।
বিটিভির মতো অবকাঠামো ও টেরেস্ট্রিয়াল সম্প্রচারের সুবিধা আর কোনো টিভি চ্যানেলের নেই, মনে করছেন গীতি আরা নাসরীন। কিন্তু আধেয়ের দিক থেকে বিটিভি খুবই গড়পড়তা অনুষ্ঠান তৈরিতে আটকে আছে। তিনি বললেন, দর্শকের সব অংশের স্বার্থে জনসেবামূলক সম্প্রচারের লক্ষ্য থাকতে হয় শিক্ষা, তথ্য ও বিনোদনের মাধ্যমে সচেতন নাগরিক গড়ে তোলা; সংস্কৃতির বহুমুখী দিকসহ দেশের ইতিহাস–ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিতি ঘটানোর পরিকল্পনা থাকতে হবে। পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং একই সঙ্গে স্থানীয় ও বৈশ্বিক ইস্যুগুলো তুলে ধরবে। সব বয়স, জেন্ডার, গ্রামীণ ও শহুরে মানুষ যেন এখান থেকে আনন্দ ও শিক্ষামূলক উপকরণ খুঁজে পায়। বাংলাদেশে এটি সম্ভব হবে, যখন বিটিভি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। স্বায়ত্তশাসিত একটি কাঠামো থাকলে এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হলে দক্ষ জনবল দিয়ে বিটিভির পক্ষেও সবার মাধ্যম হয়ে ওঠা সম্ভব।