ক্যারিয়ারের শুরুতে শর্মিলী আহমেদ ছিলেন ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী। পরবর্তী সময়ে ছোট পর্দার মা, দাদি কিংবা ভাবির চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের মনে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছিলেন। বছরের পর বছর বিনোদনজগতে তাঁর বিচরণ ছিল। ছোট–বড় পর্দায় দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। তবে অনেকের চেয়ে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম, অভিনয় ও সংসার—দুটোই সামলেছেন তিনি। তারপর সব ছেড়ে ২০২২ সালের আজকের দিনে, অর্থাৎ ৮ জুলাই তিনি পাড়ি দেন না ফেরার দেশে।
সংসারে কী রান্না হবে, কে কী খাবেন—সব বুঝিয়ে দিয়েই প্রতিদিন ছুটতেন শুটিং সেটে। তাঁর কাছে পরিবার আগে গুরুত্বপূর্ণ, তারপর কাজ। এ কারণে পরিবারের সদস্যরা সব সময়ই শর্মিলী আহমেদকে অভিনয়ে সহযোগিতা করেছেন। ছোট পর্দায় তাঁকে বেশির ভাগ সময় মায়ের চরিত্রে দেখা গেছে। আর বাস্তবেও মায়ের মতোই আগলে রেখেছেন পুরো পরিবারকে। জীবনকালে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য তিনি নিজেই দিয়েছেন। প্রথম আলোর বিনোদন পাতায় এসব কথা প্রকাশও হয়েছিল। আজ তাঁকে স্মরণ করে আবার জেনে নিই একজন অভিনেত্রী, মা, প্রিয় মুখ শর্মিলী আহমেদকে।
বিনোদন অঙ্গনে সবাই জানেন অভিনেত্রী ও মা—দুই জায়গাতেই সফল শর্মিলী আহমেদ। শুটিংয়ে যেমন তিনি সময় দিয়েছেন, তেমনি পরিবারের প্রতিটি কাজের দিকে খেয়াল রেখেছেন। প্রথম দিকে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব কম থাকলেও মা হওয়ার পর দায়িত্ব বেড়ে যায়। সে সময় অবশ্য অভিনয় কমিয়ে দেন। সিনেমা ও নাটকের বেশির ভাগ শুটিং তিনি ঢাকার মধ্যেই করতেন। যেন সন্তানদের সময় দিতে পারেন। সন্তানদের মানুষ করতে অভিনয়টা একটু কমিয়ে দিয়েছিলেন।
এরপর মেয়ে যখন বড় হয়, তখন আবার অভিনয় বাড়িয়ে দেন। তত দিনে মেয়েও বুঝতে পেরেছেন, মাকে শুটিংয়ে যেতে হয়। মা ও মেয়ের মধ্যে একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়ে যায়। পরে শর্মিলী আহমেদকে শুটিং করতে উৎসাহ দিতেন মেয়ে। তাঁর মেয়ে তনিমা আহমেদও অভিনয়শিল্পী।
এক সাক্ষাৎকারে শর্মিলী আহমেদ বলেছিলেন, ‘মেয়ের জন্মের পর মা হিসেবে সব সময় তাঁকে সময় দিয়েছি। মানুষ করেছি। মা হিসেবে কতটা পেরেছি, জানি না। আমাকে নিয়ে মেয়ের কোনো অভিযোগ আছে কি না, আমি জানি না। থাকলে সে বলত। কারণ, আমাদের সম্পর্কটা এমনই। এটুকু বলতে পারি, ব্যস্ততার জন্য মেয়েকে কম সময় দিইনি। একজন মা হয়েই সংসার করে গেছি।’
মেয়েকে সুশিক্ষায় বড় করতে হবে, এই চিন্তা সব সময়ই ছিল শর্মিলী আহমেদের। তাই শুটিংয়ে কখনো ঢাকার বাইরে যাননি। দূরে শুটিংয়ে গেলে যত রাতই হোক, বাসায় ফিরে আসতেন। যদি কখনো এমন হতো, তিনি ফিরতে পারবেন না, তাহলে বোনকে বাসায় এনে রাখতেন মেয়েকে দেখাশোনার জন্য। তিনি বলেন, ‘পরিবার, মেয়ে—সবার কথা চিন্তা করে কাজ কম করেছি। শুটিং শেষে বাসায় ফিরেই মা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।’
সংসার বা বিনোদন অঙ্গন, সব জগৎ থেকেই আজ অনতিক্রম দূরে শর্মিলী। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। অভিনয়শিল্পী বোন ওয়াহিদা মল্লিক জানান, মৃত্যুর মাস দুয়েক আগে তাঁর বোনের ক্যানসার ধরা পড়ে। এ নিয়ে তাঁর মধ্যে কিছুটা হতাশা কাজ করছিল।
শর্মিলী আহমেদের প্রকৃত নাম মাজেদা মল্লিক। ১৯৪৭ সালের ৮ মে তাঁর জন্ম। এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী অভিনয় শুরু করেন মাত্র চার বছর বয়সে।
রাজশাহী বেতারের শিল্পী ছিলেন তিনি। ষাটের দশকে চলচ্চিত্রাঙ্গনে নাম লেখান শর্মিলী। এর মধ্যে অবশ্য প্রথম চলচ্চিত্র ‘ঠিকানা’ (উর্দু ভাষায় নির্মিত) আলোর মুখ দেখেনি। তবে সুভাষ দত্তের ‘আলিঙ্গন’, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ এবং ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্র দিয়ে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
শর্মিলী আহমেদের স্বামী রকিবউদ্দিন আহমেদও ছিলেন পরিচালক। তাঁর নির্মিত ‘পলাতক’ ছবিতে অভিনয় করেছেন শর্মিলী আহমেদ। স্বাধীনতা–পূর্ববর্তী সময়ে আরও কিছু উর্দু ছবিতেও তিনি অভিনয় করেন। স্বাধীনতার পর ‘রূপালী সৈকতে’, ‘আগুন’, ‘দহন’-এর মতো জনপ্রিয় সব চলচ্চিত্রে ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি।
এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ নাটক ও ১৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। অভিনয়জীবনে মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রের বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সবার মন জয় করেছেন সাবলীল অভিনয় দিয়ে। অভিনয়জীবনে মায়ের চরিত্রে এত বেশি অভিনয় করেছেন যে বিনোদন অঙ্গনে তিনি সবার কাছে ‘মা’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। সবাই তাঁকে ‘শর্মিলী মা’ বলেই ডাকতেন।