‘মেয়েদের গোছলের টাইম, সকাল ৮ ঘটিকা থেকে ১০ ঘটিকা পর্যন্ত। বি.দ্র. পুরুষরা ১০০ হাত দূরে থাকুন।’—একটি ব্যানারে লেখা। জনপ্রিয় ‘ভবের হাট’ ধারাবাহিক নাটকে ন্যাটা চরিত্রের অভিনেতা আ খ ম হাসানকে পুকুরপাড়ে ব্যানারটি লাগাতে দেখা যায়। সেই সময়েই পুকুরে মুখ ধুতে আসেন আশান খাঁ। কিন্তু সকাল ৮টা পেরিয়ে যাওয়ায় আশান অনেক অনুরোধ করেন পুকুরঘাটে যেতে। ‘এখনো মেয়েরা কেউ আসেনি, যাবে আর আসবে’—এই বলে অনেক অনুনয়-বিনয় করেও কোনো লাভ হয় না। তাকে একপর্যায়ে জাপটে ধরে নিয়ে যায় ন্যাটা। ধারাবাহিকের এই প্রথম দৃশ্য থেকে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করে দর্শকদের নজর কাড়েন এই আশান খাঁ চরিত্রের অভিনেতা শামীম হাসান। পরবর্তী সময়ে তিনি নাটক থেকে হারিয়ে যান।
‘ভবের হাট’ নাটকের গুণী অভিনয়শিল্পী এ টি এম শামসুজ্জামান, হুমায়ুন ফরীদি, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, রহমত উল্লাহ, ফজলুর রহমান বাবু, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, দিতি, তানিয়া আহমেদদের সঙ্গে অনেক দৃশ্যে সমান তালে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন এই তরুণ। প্রথম ধারাবাহিকেই চমক দেখানো সেই তরুণের দর্শক বাড়তে থাকে। রাস্তাঘাটে শুনতে হতো, ‘আপনি আশান খাঁ না? এ টি এমের ছেলে।’
ভক্তদের কাছে আলোচনার পাত্র হওয়া এই তরুণ হঠাৎ করেই অভিনয় থেকে দূরে সরে যান। একসময় তাঁকে আর কোনো পর্বে দেখা যায়নি। মর্মাহত হন দর্শকেরা।
পরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, এই অভিনেতা আর নেই। সেই গুজব এখনো চলছে। প্রায়ই ফেসবুকে নাটক–সংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলোতে দেখা যায়, সেই আশান খাঁর ছবি পোস্ট করে কেউ লিখেছেন, এই অভিনেতা অকালপ্রয়াত হয়েছেন। কেউ কেউ মন্তব্যে দুঃখ প্রকাশ করে লেখেন, ‘পছন্দের অভিনেতা ছিল।’ আবার কেউ লেখেন, ‘তিনি এখনো বেঁচে আছেন।’ তবে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। হঠাৎ পর্দা থেকে উধাও হয়ে যাওয়া সেই আশান খাঁ এখন কোথায়? জানার জন্য নাটকের পরিচালক ও অভিনেতা সালাহউদ্দিন লাভলুর দ্বারস্থ হয়ে হতাশ হতে হয়।
সালাহউদ্দিন লাভলু জানান, ‘অনেক দিন হলো ওর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। সে শিক্ষকতা করে, এটা শুনেছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘শামীম দারুণ অভিনয় করেছিল। সে নতুন, এটা কেউই বুঝতে পারেনি। দর্শকদের কাছ থেকে তুমুল সাড়াও পাচ্ছিল। হঠাৎ করে একদিন শুনি, সে অভিনয় করবে না। আমরা সবাই আকাশ থেকে পড়লাম। আমাদের সেটের সবাই তাকে বুঝিয়েছি। কিন্তু সে একপর্যায়ে আর ভবের হাট নাটকের সঙ্গে যুক্তই হলো না। কেন যে দূরে সরে গেল, এটা এখনো একটা রহস্য বলা যায়।’
২০০৪ সালের কথা। তখন গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রের জন্য তরুণ মুখ খুঁজছিলেন সালাহউদ্দিন লাভলু। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দম্পতি ওয়াহিদা মল্লিক জলি ও রহমত উল্লাহর কাছ থেকে ছেলেটির তথ্য পান। প্রথম দেখায়ই মারেম খাঁ পরিবারের ছোট ছেলে আশান খাঁ চরিত্রের জন্য পছন্দ করেন লাভলু। পরে শামীমকে নিয়েই শুরু হয় শুটিং। এই পরিচালক বলেন, ‘আমি এখনো তাকে খুঁজছি। কাস্টিংয়ের জন্য। শুনেছি, সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক। অনেক দিন ধরেই তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এত মেধাবী, সম্ভাবনাময় একজন অভিনেতা হারিয়ে গেল। অথচ আজ তার কোথায় থাকার কথা ছিল। সেই সময় এ টি এম, ফরীদি ভাইসহ সবাই তাকে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু পরীক্ষা আর কী কী যেন বলে যায়। তখন কষ্ট লেগেছিল।’
দীর্ঘদিন পরে সেই শামীম হাসানকে পাওয়া গেল। তিনি এখন যুক্তরাজ্যে পিএইচডি করছেন। আগে জানালেন, অভিনয় থেকে দূরে সরলেও নাটকের ওপর পড়াশোনা নিয়মিত করে যাচ্ছেন। জানতে চাই, ‘আপনাকে নিয়ে তো অনেক গুজব ছড়িয়েছে, সেগুলো কতটা জানেন?’ প্রশ্ন শুনে তিনি বলেন, ‘প্রায়ই শুনি, নাটকের বা সিনেমার বিভিন্ন গ্রুপে আমার সেই ভবের হাটের ছবি পোস্ট করে লেখা হয়েছে, আমি নাই। আমি যে ফেসবুকে কতবার মারা গেছি, তার হিসাব নাই। যদিও আমার শিক্ষার্থীরা একাধিকবার সেসব গ্রুপে জানিয়েছে, আমার বর্তমান অবস্থা। তারপরেও গুজব ছড়িয়েছেই। কারণ, আমি ফেসবুক ব্যবহার করি না। কোনো মন্তব্যও কখনো করিনি।’
তিনি ‘অরণ্য প্রভা’ একক নাটক দিয়ে অভিনয় শুরু করেন। আরও দুটি নাটকে অভিনয়ের পরে সুযোগ পান ‘ভবের হাট’ নাটকে। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী। পড়াশোনার ফাঁকে ৪ থেকে ৫ মাস সময় হাতে ছিল। তাই শিক্ষক ওয়াহিদা মল্লিক জলির কথা শুনে ‘ভবের হাট’ নাটকে অভিনয় করেন। সেই শুটিংয়ের সময়গুলো ছিল তাঁর জীবনের স্মরণীয় ঘটনা।
‘আমি ছিলাম শুটিংয়ের সবচেয়ে ছোট। যে কারণে সবাই আমাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। তাঁদের মধ্যে প্রথমেই বলব মোশাররফ করিম ভাইয়ের নাম। তিনি ছিলেন আমার বড় ভাই ভাসান চরিত্রের অভিনেতা। তাঁর সঙ্গে আমার অনেক দৃশ্যের শুটিং হয়। এভাবে ভালো বন্ধুত্ব হয়। তিনি ছিলেন অনেক বড় মনের মানুষ। লাভলু ভাই, চঞ্চল ভাই, দিতি আপা, হুমায়ুন ফরীদি ভাই, এ টি এম আংকেলসহ সবাই। আমার জীবনের জন্য ও অভিনয়ের জন্য আমি অনেক কিছু সেই সময়ে শিখেছি। আমার একটাই চাওয়া ছিল অভিনেতা হব। তাই সবার কাছ থেকে যতটুকু পারি শেখার চেষ্টা করতাম।’—বলেন শামীম হাসান
নাটকে তিনি ছিলেন এ টি এম শামসুজ্জামানের ছোট ছেলে। তাঁর সঙ্গেও অনেক স্মৃতি জমিয়ে রেখেছেন। সেগুলো একজন অভিনেতা হিসেবে শামীমকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি জানান, একবার এ টি এম শামসুজ্জামানের পুরান ঢাকার বাড়িতে যান। গিয়ে দেখেন তাঁর বাড়িতে অনেক বড় একটি লাইব্রেরি। তিনি সব সময় পড়তেন। সেদিনই তিনি এই গুণী অভিনেতার কাছ থেকে শেখেন, একজন অভিনেতাকে সব সময় শৈল্পিক আবহের মধ্যে থাকতে হয়।
শামীম বলেন, ‘একইভাবে মোশাররফ করিম ভাইকে শুটিংয়ে সব সময় দেখতাম বই পড়তে। শুটিংয়ের ফাঁকে উপন্যাস, কবিতার বই হাতে থাকতই। হুমায়ুন ফরীদি ভাই আমাকে বলেছিলেন, বেশি করে অবজার্ব করার কথা। আর শিশুদের কাছে ফিরে যেতে। তাদের কাছ থেকে শিখতে। এটা আমাকে অনেক কাজে দিয়েছিল। এ টি এম আংকেল ভালোবেসে বলতেন, প্রতি মুহূর্তে অভিনয় লালন করতে। এগুলো আমাকে বদলে দিয়েছে।’
অল্প সময়ের ক্যারিয়ার হলেও চ্যানেল আইয়ের জনপ্রিয় এই ধারাবাহিক দিয়ে আলোচনায় আসেন। তখন তিনি ঢাবির মুহসীন হলে থাকতেন। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ক্যাম্পাসে ও বাইরে প্রচুর ভক্তের মুখোমুখি হতে হয়। সবাই তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করতেন। বড় চুল থাকায় অনেকেই তাঁকে সহজে চিনতে শুরু করেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে এই অভিনেতা বলেন, ‘বাইরে বের হলেই অনেকে বলত, “ওই দেখ, নাটক করেন, তিনি যাচ্ছে।” তারকা খ্যাতি বুঝতে শুরু করেছিলাম। আর সেই সময়ের আরেকটি স্মরণীয় ঘটনা ছিল, আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল বাগেরহাটের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। সেই এলাকায় টিভি ছিল না। তখন আমার এলাকার মানুষ আমার নাটক দেখার জন্য বাস ভাড়া করে আমাদের উপজেলা প্রেসক্লাবে যেত।’
ক্যারিয়ারের শুরুতেই গুণীজনদের কাছে শিখেছেন। ইচ্ছাও ছিল অভিনয় করবেন। এখনো তিনি নাটক নিয়ে পড়াশোনা করছেন। তাহলে সেই অভিনয় হঠাৎ ছেড়ে দিলেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তর যেন তাঁর নিজের কাছেও নেই। বললেন, ‘আমার ভবিষ্যতে ইচ্ছাই ছিল অভিনয়কে ঘিরে। সেভাবেই নিজেকে তৈরি করছিলাম। সেই সময়ে হঠাৎ মাথায় ভর করে, পড়াশোনা আর অভিনয় একসঙ্গে চালানো কঠিন। কিছু শিক্ষকও জানালেন পড়ায় মনোযোগ দিতে। পড়ায় ক্ষতি হচ্ছিল। তখন আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে, নাটকের সেই বড় চুল কেটে ফেলি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি, অভিনয় করব না। পরে লাভলু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। আমাকে এভাবে চুল কাটা দেখে লাভলু ভাই অবাক। তাঁকে সব বললাম। তিনি শুনে বললেন, অভিনয় করতেই হবে। আমার জন্য গল্পের চিত্রনাট্য পরিবর্তন করার কথা জানালেন। সবাই আমাকে বোঝালেন, কিন্তু কেন যেন আমার আর মন চাইল না, অভিনয় ছেড়ে দিই। পরে আর অভিনয় করিনি।’
ভবের হাট নাটক থেকে সরে দাঁড়ালেও পরে পড়াশোনা শেষ করে আরও কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছেন। তবে সেভাবে জনপ্রিয়তা পাননি। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। কখনোই তিনি শিক্ষক হতে চাননি। সেই শিক্ষকতা এখন করছেন। যে অভিনয়কে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন, সেই অভিনয় থেকে সরে দাঁড়ানোর পরে এখন কী ধরনের উপলব্ধি হয়?
এমন প্রশ্নে কিছুটা চুপ থেকে শামীম হাসান বলেন, ‘আমি সব সময়ই চেয়েছিলাম অভিনেতাই হতে। যে কারণে কখনোই শিক্ষক হওয়ার পেছনে ছুটিনি। কিন্তু সেই অভিনয়ই করা হলো না। সবাই আমাকে যেভাবে ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন, ক্যারিয়ার এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিতেন। সেই অভিনয়ে আমার অনেক ভালো একটি ক্যারিয়ার হতে পারত। সেই জায়গা থেকে আমি বলব, আমার অভিনয় ছাড়া ঠিক হয়নি, আমি আসলে অনুতপ্ত। মানুষের জীবনে তো কিছু ভুল থাকে। তবে আমি এখন শিক্ষক পেশায় রয়েছি। খারাপ নেই, ভালোই আছি। হয়তো মাঝেমধ্যে চিন্তা করি, অভিনয়টা করলেই পারতাম।’
শামীম ২০২৬ সালে দেশে ফিরবেন। জানালেন, ফিরে আবার অভিনয়ে নিয়মিত হতে চান। জানিয়ে রাখলেন, চট্টগ্রামে তীরন্দাজ, সাধনা থিয়েটারের নিয়মিত নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন। ভবিষ্যতে তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি অভিনয় ও নির্দেশনা নিয়েই থাকতে চান।