কখনো কাজের অংশ হতে গিয়ে আলোচনায় এসেছেন। কখনো কাজ থেকে বাদ পড়ে। কখনোবা প্রেম, বিচ্ছেদ ও ফেসবুক লাইভে খোলাখুলি কথা বলা বা সাজসজ্জা নিয়েও আলোচিত তিনি। তাঁকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা হতো। বলছি তানজিম তাসনিয়ার কথা, যিনি তাসনিয়া রহমান নামেই পরিচিত। গত শুক্রবার এই তাসনিয়া রহমানকে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি ফ্ল্যাট থেকে ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর পর নতুন করে আলোচনায় এই অভিনেত্রী ও মডেল।
বেঁচে থাকলে আলোচনা-সমালোচনা পাশ কাটিয়ে তাসনিয়া চেয়েছিলেন তাঁর ক্যারিয়ার সুন্দরভাবে এগিয়ে নিতে। ইচ্ছা ছিল অভিনেত্রী হবেন। পাঁচ বছর ধরে চেষ্টাও করেছিলেন। ছুটেছেন কাজের পেছনে। পড়াশোনার পাশাপাশি অভিনয় ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। একদিন নায়িকা হবেন, তাই সবচেয়ে বেশি সময় দিয়েছেন অভিনয়ের পেছনে। কিন্তু সেই অর্থে কাজ মেলেনি। শুনতে হয়েছে কাজের বাইরে নানা রকম কথা। এসব নিয়ে একের পর এক হতাশ হতে হয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে তাঁর জীবনকে ঘটনাবহুল করে তুলেছে।
তাসনিয়ার ক্যারিয়ার শুরু ২০১৭ সালে। এক বন্ধুর মাধ্যমে তিনি বিনোদন অঙ্গনে কাজ শুরু করেন। র্যাম্প মডেলিং দিয়ে পথচলা শুরু করা তাসনিয়া ২০২০ সালে আর নিজেকে মডেলিংয়ে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, নায়িকা হওয়ার জন্য অনেকে তাঁকে ঘুরিয়েছে। পরে নাটক, সিরিজ ও সিনেমায় অভিনয় করেন। এর মধ্যেই হঠাৎ করে আলোচনায় আসেন তাসনিয়া। গত বছর এই অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার আবেদন করেন একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক।
এই মডেল তখন গণমাধ্যমে জানান, প্রযোজক ও পরিচালকের একটি সিনেমা করার কথা ছিল। এ নিয়ে সিনেমাটির সম্ভাব্য পরিচালকের সঙ্গেও কথা হয়। কিন্তু কাজ এগোয়নি। এই প্রসঙ্গে তাসনিয়া তাঁর ফেসবুক লাইভে তখন বলেন, ‘একপর্যায়ে আমি যখন বুঝতে পারি, সিনেমার কাজ নয় বরং অকাজের কথাই বেশি হয়। তখনই ঝামেলার সৃষ্টি হয়।’ গত বছরের ১২ আগস্ট প্রযোজকের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয় এবং এই মডেল আহত হন। সেদিন আহত হয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রয়াত এই মডেল। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করে করে প্রযোজক দাবি করেন, অনেককেই টার্গেট করত এই মেয়ে। যা অবশ্য সরাসরি অস্বীকার করেন তাসনিয়া। এরপর পক্ষে-বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি কথা চলতে থাকে।
পরে তাসনিয়া রহমানকে নিয়ে ফেসবুকে নানা রকম কথা হতো। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের বক্তব্যও তুলে ধরতেন এই মডেল। তখন কেউ কেউ তাঁর বিরুদ্ধে মাদক গ্রহণের অভিযোগ করেন।
এগুলো নিয়ে নিউজ ২৪ নামে এক অনলাইন সংবাদমাধ্যমে তাসনিয়া বলেন, ‘আমাকে নিয়ে নানা রকম আপবাদ দেওয়া হয়। আমি নেশা করি। তাদের বলছি, আমি কখনোই মদ খাইনি। আমার রক্ত পরীক্ষা করতে পারেন। আমি আমার মতো করে থাকতে চেয়েছি। শান্তি চেয়েছি। আমি কাজ করতে চেয়েছি। কিন্তু আমাকে বিভিন্ন কথা শুনতে হয়েছে। কম্প্রোমাইজ প্রসঙ্গে কথাও এসেছে। কিন্তু আমি বলেছি, কম্প্রোমাইজ ছাড়াও কাজ হয়। আমি অমিতাভ রেজা স্যারের “মুন্সিগিরি”, এফডিসির “সিক্রেট এজেন্ট”–এর কাজ করেছি—সেখানে আমি সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি। সেই পরিবেশ ছিল।’
বিভিন্ন সময় প্রযোজকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে তাসনিয়া রহমানকে শুনতে হয়েছে নানা কথা। সিনেমায় কাজ পাওয়ার জন্য তিনি প্রযোজকদের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু খুব কমই তিনি সাড়া পেয়েছেন। এসবের ভিড়ে যে তাঁকে নিয়ে সিনেমা বানাতে চেয়েছেন, তার সঙ্গে মিটিং করেছেন, দেখা করেছেন। কিন্তু কাজ তেমন একটা পাননি। ‘আমি কেন এই প্রযোজকদের পেছনে ঘুরেছি’—নিজেকে এই প্রশ্নও করেছিলেন তাসনিয়া রহমান। সেই প্রশ্নের উত্তরে বলতে শোনা যায়, ‘আপনার যদি স্বপ্ন থাকে অভিনয় নিয়ে, নায়িকা হওয়া নিয়ে, আর আপনাকে যদি কেউ সেই স্বপ্ন দেখায়, অনেক উঁচুতে ওঠার, তাহলে কী করতেন, আপনি যেতেন না? যদি কেউ প্রলোভন দেখায় আপনি যাবেন না? আর বিনোদন অঙ্গনের পরিচিত একজন আমাকে তার কাজ দেখিয়ে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলে আমি কেন যাব না। কেন তাঁদের পেছনে ঘুরব না?’
গত তিন বছরে একাধিক প্রযোজকের সঙ্গে পরিচয় তাসনিয়া রহমানের। সবাই তাঁকে আশ্বস্ত করেছিল, সিনেমায় কাজ দেবেন। তাদের মধ্যে কেউ তরুণ এই মডেলকে জানিয়েছিলেন, চিত্রনায়িকা ববিসহ অনেকেই তাঁদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিনেমায় কাজ করেছেন। তাঁরা একসঙ্গে ছবিও দেখান। সেখানে কাজ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন এই অভিনেত্রী। এই নিয়ে তিনি ফেসবুক লাইভে প্রায়ই হাজির হতেন। সবকিছু ভক্তদের কাছে ভাগাভাগি করতেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘কাজের জন্য গুলশান, বনানী, এখানে-সেখানে কত ঘুরেছি। কিন্তু কাজ পাইনি। অনেক সময় কাজের জন্য রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্তও বসে থেকেছি, কিন্তু অকাজের কথা বেশি হয়েছে। খুশি করতে হবে, এই-সেই এমন অনেক কথা শুনতে হয়েছে।’
তাসনিয়া রহমান নিজে গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, অতিরিক্ত রাগের কারণে ক্রমেই তিনি একা হয়ে যাচ্ছিলেন। তেমন কাজও পাচ্ছিলেন না। কিন্তু চেষ্টা করছিলেন কাজ করে যেতে। এর মধ্যে তিনি হঠাৎ করেই কাজ থেকে দূরে থাকায় হতাশ হয়ে পড়েন। প্রেম-বন্ধুত্ব নিয়েও তিনি মানসিক দ্বন্দ্বে ছিলেন। একসময় তিনি বিনোদন অঙ্গনের সবার সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। অনিকা শর্মা নামে এই মডেলের এক সহকর্মীর সঙ্গে বেশ আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তিনিও তাসনিয়াকে খুঁজছিলেন। ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘৬–৭ মাস আগে দেখলাম তাসনিয়া মানসিকভাবে খুব খারাপ অবস্থায় আছে, সারা দিন ফেসবুকে এইটা-ওইটা লিখতে থাকে। আমি নিজেও ওকে টেক্সট করি, কয়েকবার কথা বলেছি। আমি ওর কোনো কাজে আসতে পারব না জেনেও, আমি ওর সঙ্গে কথা বলতাম, ওর কথা শুনতাম। আমি সব সময় চেয়েছি, তাসনিয়া কোনো ভুল সিদ্ধান্ত না নিক।’
প্রায় চার মাস ধরে তাসনিয়া রহমান ফেসবুকে অনিয়মিত। একসময় সে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট করে দেয়। সেই থেকে এই মডেল সবকিছু থেকে দূরে ছিলেন। তেমন কোনো কাজেও দেখা যায়নি তাঁকে। পরিচিতদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। অনিকা লিখেছেন, ‘তিন চার মাস ধরে তাঁকে অনেক খুঁজেছি! আমার পরিচিত সব ইউটিউবার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, হোস্ট, আরজে অমিসহ সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি—তাসনিয়ার খোঁজ ওরা পেয়েছে কি না? তাসনিয়ার সঙ্গে যারা শো করেছে, তাদের কাছেও জানতে চেয়েছি, তাসনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি না? তাসনিয়া কোথায়! কেউ কিছুই বলতে পারেনি। আমি অনেক খুঁজেছি মেয়েটাকে! এখন আমার খোঁজা শেষ হলো। তাসনিয়া এইবার তুমি ভালো থেকো।’
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তাসনিয়া ইউল্যাবের মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। কী কারণে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় পাওয়া গেছে, তা এখনো জানা যায়নি। ধানমন্ডি থানার উপপরিদর্শক জান্নাতুল ফেরদৌসী প্রথম আলোকে জানান, শনিবার তাসনিয়া রহমানের লাশ গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে দাফন করা হয়েছে। তারা জানতে পারেননি কী কারণে আত্মহত্যা করেছেন এই মডেল।