অভিনেত্রীর সুখের দিন তছনছ করে দিল ক্যানসার

অভিনেত্রী আফরোজা। ছবি: অভিনেত্রীর সৌজন্যে
অভিনেত্রী আফরোজা। ছবি: অভিনেত্রীর সৌজন্যে

তখন বয়সটা স্বপ্ন দেখার। সবে ভর্তি হয়েছিলেন দশম শ্রেণিতে। জীবন তাঁকে স্বপ্নও দেখাতে শুরু করেছিল। ঠিক তখনই তাঁকে থেমে যেতে হয়, পরিবার থেকে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয়।

বিয়ের এক বছরের মাথায় মা হলেন, তখন উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। মাত্র ৩০ দিনের ছেলেকে বাসায় রেখে এইচএসসি পাস করেন। কয়েক বছর পর স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়। আর যুদ্ধটা তখনই শুরু হয়, যখন একক মা হিসেবে তাঁকে সমাজে এগিয়ে চলতে হয়। আফরোজা জানান, সব সময় তিনি নিজের পরিচয়ে বড় হতে চাইতেন। নিজের ইচ্ছায় পড়াশোনা শেষ করেছেন। সন্তান দেখাশোনা আর চাকরি সমানতালে করতে থাকেন।

সবকিছু নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে ২০০০ সাল থেকে সংগ্রাম শুরু করেন। সব দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পার করতে থাকেন দীর্ঘ ক্লান্তির পথ, যার শেষ প্রতিমুহূর্তে দেখেছেন আফরোজা। চোখের সমানে সন্তানেরা বড় হতে থাকে। আফরোজা একটু আশ্বস্ত হন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন শান্তির নিশ্বাস নিতে। তাঁর সামনে হাসছিল সুখের দিন। সেই দিনগুলোতে পা দিয়েই একদিন জানতে পারেন ভয়ংকর এক দুঃসংবাদ। তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যানসার। সেটা দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে। সেদিন যেন সবকিছুকে তছনছ করে দিয়েছিল ক্যানসারের সংবাদ।

অভিনেত্রী আফরোজা। ছবি: অভিনেত্রীর সৌজন্যে

আফরোজা থেমে থাকার পাত্রী নন। আফরোজা বাঁচতে চান। আবার ঘুরে দাঁড়াতে চান। সন্তানেরা তাঁকে আশ্বাস দেয়, ‘মা, তুমি ভালো হয়ে ফিরবে। তুমি আবার অভিনয়ের ফিরবে। আগামীর দিনগুলো তোমার।’ দীর্ঘ ক্লান্তির পর এখন সুখের দিনের আশায় বুক বেঁধে বেঁচে থাকার সাহস সঞ্চয় করছেন এই অভিনেত্রী।
আফরোজা বলেন, ‘চাকরি ছেড়ে দিই। সিঙ্গেল মা হিসেবে অনেক দিন ধরে সংগ্রাম করেছি। মনে হলো, একসঙ্গে চাকরি আর অভিনয় সম্ভব নয়। বিশ্রামের দরকার আছে। আমি অনেক ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। তখন সিদ্ধান্ত নিই, শুধু অভিনয়টাই করে যাব। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারলেই আমি খুশি ছিলাম। আর ভাবছিলাম, আমার জীবনের বড় পাওয়া ছেলেদের মানুষ করেছি। এর বাইরে আমার কখনোই কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। শুধু ইচ্ছা ছিল, নিজের মতো করে একটু বাঁচা। নিজের পরিচয়ে বাঁচা।’

সময়ের স্রোতে বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছেন। ছোট ছেলে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ছেন। আফরোজা তাঁর জীবনের সেরা সময়টা পার করছিলেন। তখনই যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয় অসুস্থতা।

বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন তাঁর পরিচিত চিকিৎসক ডা. রোমানা। তাঁরা মিরপুরে পাশাপাশি থাকেন। সেই চিকিৎসক রিপোর্টগুলো দেখে চুপ হয়ে যান। সেদিনই আফরোজাকে জানান, তাঁর শরীরে ক্যানসার বাসা বেঁধেছে। ক্যানসার দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে। দ্রুত এর চিকিৎসা করানো দরকার। সেদিনের কথা মনে করে আফরোজা বলেন, ‘আমি বেডে শোওয়া। ডাক্তার কিছু বলতে পারছেন না। পরে বলেন, “আন্টি, এটা আমি কী দেখলাম! আপনার তো ক্যানসার।” বেড থেকে নামার পর আমার গগনবিদারী চিৎকার, মনে হচ্ছিল আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। আকাশটা আমার মাথায় ভেঙে পড়েছে। তখন শুধু আমার এটাই মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবীতে আমি কাউকে আর দেখব না।’ শেষ লাইনের পর কিছু সময় চুপ থাকেন এই অভিনেত্রী।

জীবনের নানা উপলব্ধি সেই সময়ে আফরোজাকে ভাবিয়ে তুলছিল। নিজের পায়ে দাঁড়ানো আফরোজার পা যে আর চলতে চাইছিল না, সেটি টের পাচ্ছিলেন। কী করবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ‘জীবনের সবকিছু যখন একটু গুছিয়ে আসছিল, ঠিক তখনই আমার অসুখটা ধরা পড়ল।’ ১০ ডিসেম্বর মুম্বাই থেকে কথাগুলো বলছিলেন এই অভিনেত্রী। তাঁর কণ্ঠে বারবার দীর্ঘশ্বাসের ছোঁয়া।
দ্রুতই জরায়ুর ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে থাকেন। ঢাকায় কেমোথেরাপি নেওয়ার পর তিনি বর্তমানে মুম্বাইতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ৭ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার তিনি মুম্বাই গিয়েছিলেন। একটি কেমোথেরাপি ও একটি ইনজেকশন নিয়ে শনিবার দেশে ফেরার কথা। চিকিৎসক বলে দিয়েছেন, ছয়টি কেমোথেরাপি নিলে তিনি আবার সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।

বাকি কেমোথেরাপি দেশেই নিতে হবে। কারণ, মাসে দুইবার বিদেশে এসে চিকিৎসা নেওয়া তাঁর জন্য খুবই কঠিন। এমনিতেই ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা করাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জানালেন, সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও অভিনয় শিল্পী সংঘ সব সময় তাঁর পাশে আছে। কিন্তু ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না। আফরোজা বলেন, ‘মুম্বাইতে ডাক্তার আমাকে বলেছেন, কেমোথেরাপি নিলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব। আমি আবার সুস্থ হয়ে ফিরতে চাই। ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে চাই। আমি অভিনয় শিল্পী সংঘের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সহায়তার আবেদন করেছি। সহায়তা পেলে আমার জন্য ভালো হতো। অভিনয় শিল্পী সংঘ থেকে সহায়তা করেছে।’

জানা যায়, এ মাসের শুরুতেই অভিনয় শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক রওনক হাসান একটি বেসরকারি টেলিভিশনের কুইজ প্রতিযোগিতায় জিতেন এক লাখ টাকা। সে অর্থ এই অভিনেত্রীর হাতে তুলে দেন। রওনক বলেন, ‘আমরা সব সময় আফরোজা আপার পাশে আছি। ক্যানসারের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়াটা কষ্টের। আমরা সংগঠন থেকে সরকারের কাছে আবেদন করেছি। সহযোগিতা পেলে হয়তো ঠিকমতো চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।’

ক্যানসার ধরা পড়ার পরে গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে অভিনেত্রী আফরোজা আর কোনো শুটিংয়ে অংশ নিতে পারেননি। তাঁর আয় থেমে গেছে। তার পর থেকে ঘরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বেড়েছে বহুগুণ খরচ। আফসোস করে তিনি বললেন, ‘আমি এত দিন ধরে অভিনয় করি, কিন্তু সেই অর্থে পার্শ্বচরিত্রের বাইরে আরও ভালো চরিত্র আমার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাইনি। এই নিয়ে আমি সব সময় আমার গুরু মামুনুর রশীদের কথা মেনে চলি। তিনি বলেছিলেন, “লিফট ধরে কখনো ওপরে ওঠার চেষ্টা করবে না। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ওপরে ওঠো, অনেক দিন টিকে থাকতে পারবা।” আমি সবার দোয়ায় মোটামুটি যে কাজ করেছি, ভালোই করেছি। হয়তো আরও ভালো জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল, সচ্ছল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্য সাপোর্ট করেনি। আমার ইচ্ছা, সুস্থ হয়ে কিছু ভালো কাজ করার চেষ্টা করব। যে কাজগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।’

কীভাবে অভিনয়ে এসেছেন, জানতে চাইলে আফরোজা জানান, ২০০৮ সালে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। ইউনেসকোর সচেতনতামূলক নাটক দিয়ে তাঁর পথচলা শুরু হয়। এটি দুই বছর ধরে বিটিভিতে প্রচারিত হয়। তখন তিনি ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে চাকরি করতেন। চাকরির ফাঁকে অভিনয় করতেন। তিনি মামুনুর রশীদ, জাহিদ হাসান, মাহফুজুর রহমান, কচি খন্দকারসহ অনেকের নির্মিত নাটকে অভিনয় করতে থাকেন। ২০১৩ সালে সিদ্ধান্ত নেন, শুধু নাটকেই অভিনয় করবেন। সেই থেকে চাকরি ছেড়ে টানা অভিনয়ে। তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন অনন্য মামুনের পরিচালনায় ‘আবার বসন্ত’ সিনেমায় অভিনয় করে। এ ছাড়া ‘ঠেটারু’, ‘সূর্য অস্তের আগে’, ‘বিদেশি ছেলে’সহ একাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন। নাটকের চেয়ে তিনি ইউনেসকো, ইউনিসেফ, ইউএনডিপি ও বিবিসির তথ্যচিত্রে বেশি নাম লিখিয়েছেন।