অনুষ্ঠানটির রচনা, পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেছেন হানিফ সংকেত
অনুষ্ঠানটির রচনা, পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেছেন হানিফ সংকেত

ঠাকুরগাঁওয়ে ইত্যাদির শুটিংয়ে কী ঘটেছিল, জানালেন হানিফ সংকেত

বরাবরই দেশের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন স্থানে শুটিং হয় হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানের। সেই ধারাবাহিকতায় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ এবার শুটিংয়ের জন্য বেছে নেয় ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলের টংকনাথ জমিদারবাড়ি। কিন্তু শুটিং শুরুর কিছুক্ষণ পর চেয়ার ছোড়াছুড়ির ঘটনার কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে নানাজন নানা কথা বলেন। ঘটনার সত্যতা জানতে যোগাযোগ করা হয় ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানের পরিকল্পক, নির্মাতা ও উপস্থাপক হানিফ সংকেত এর সঙ্গে। আজ শুক্রবার সকালে তাঁর সঙ্গে যখন কথা হয়, তিনি তখন সৈয়দপুর বিমানবন্দরে ঢাকায় ফেরার অপেক্ষা করছিলেন। চলুন তাঁর মুখে শুনে নিই কী ঘটেছিল গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুর কাদের

প্রশ্ন

একেকজনের কাছে একেক রকম কথা শোনা যাচ্ছে। ফেসবুক ও ইউটিউবে ভিডিও ক্লিপও দেখা যাচ্ছে। আপনি যদি বলতেন, আসলে কী হয়েছিল?

হানিফ সংকেত : এই ঘটনার পর এখন পর্যন্ত আমি কারও সঙ্গে কথা বলিনি। আসলে আমরা কোনো মাঠে এই অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং করি না। সাধারণত যেকোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বা দেশের কোনো ঐতিহ্যবাহী স্থানে আমরা অনুষ্ঠানটা করি। প্রতিটি জায়গারই আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য থাকে। ঠাকুরগাঁওয়ে এ রকম কিছু নেই। তারপরও আমরা জানতে পেরেছি, রানীশংকৈল উপজেলায় টংকনাথের রাজবাড়ি নামে একটি জমিদারবাড়ি আছে, যেটা খুবই বিখ্যাত, প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনও। আমাদের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটা সংরক্ষণও করেছে। এরপর আমরা ওখানকার জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললাম। তাঁরা বললেন, ‘এটা তো গ্রামীণ এলাকা, এখানে অত লোক পাবেন? অন্য জায়গায় করা যায় কি না, ঠাকুরগাঁওয়ে।’ আমি তখন বলেছি, ‘ঠাকুরগাঁওয়ে করব না। আমরা তো মাঠে করি না।’ তখন তাঁরাও বলছিলেন, ‘দর্শক না এলে হবে?’ আমি তখন বলেছি, ‘আমাদের দুই থেকে তিন হাজার দর্শক হলেই চলবে। আমরা তো স্থাপনার বাইরে যেতে পারব না।’ সবকিছু মিলে টংকনাথ রাজবাড়িতে আমরা করলাম। অনুষ্ঠানের আগে আমরা আট হাজার প্রবেশ পাস দিয়েছি। ওখানে কিন্তু আর্মি, পুলিশ সবাই ছিল। যখনই আমরা অনুষ্ঠান শুরু করলাম। দর্শক তালি দিল। যেই আমি মঞ্চে এলাম, শুনলাম, চারদিক থেকে তিন কিলোমিটারের মতো রাস্তা প্যাকড। পাঁচ লাখের অধিক লোক। এত মানুষকে আমি কোথায় বসতে দেব। লোকজন করল কি, বাঁশের ব্যারিকেড ছিল, তা ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন তো ম্যাচাকার অবস্থা। ওখানে নারী আছেন, শিশু আছে, আছেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। এরপর হাউকাউ শুরু হয়ে গেল। পুলিশ থামানোর চেষ্টা করছে, আমিও করছি। অস্থির অবস্থা। কেউ কেউ চেয়ার–ছোড়াছুড়ি করছে।

প্রশ্ন

অনুষ্ঠানস্থলে যখন এই অবস্থা, তখন আপনি কী করলেন?

হানিফ সংকেত : আমি তখন প্রশাসনকে ডেকে বললাম, ‘এভাবে অনুষ্ঠান করা যাবে না। মানুষ শান্ত হোক, তারপর অনুষ্ঠান শুরু করব। আপাতত আমরা অনুষ্ঠান কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখি।’ আমরাও অনুষ্ঠানের দৃশ্যধারণ বন্ধ করে দিয়ে লাইট বন্ধ করে দিলাম। জানিয়ে দিলাম, ‘অনুষ্ঠান আপাতত হচ্ছে না। আপনারা শান্ত হন।’ এ–ও অনুরোধ করেছি, ‘চলে যান। পরবর্তী সময় আমরা চিন্তা করব কী করা যায়।’ লোক যেতে তিন ঘণ্টা লেগে গেল।

হানিফ সংকেত
প্রশ্ন

ঘটনার সূত্রপাত অনুমানিক কখন?

হানিফ সংকেত : আমরা অনুষ্ঠান শুরু করি সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। সাড়ে সাতটা কি আটটার সময় ঘটনার সূত্রপাত, যখন আমি মঞ্চে উঠলাম। ওঠার পর যখন কথা বললাম, তখনই বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এরপর একটা নাচ করলাম। তারপর রবি চৌধুরী ও লিজার গানের অর্ধেকটা করলাম, তখন সেকেন্ড বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এক থেকে দেড় ঘণ্টা অনুষ্ঠানের দৃশ্যধারণ বন্ধ রেখে রাত সাড়ে ৯টা কি ১০টার দিকে আবার শুরু করেছি। দিবাগত রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত শুটিং করেছি। এখানকার স্থানীয় লোকজন খুবই আন্তরিক। তাঁরা এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। লজ্জিত হয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘ঠাকুরগাঁওয়ের লোক ভালো।’ তখন আমিও বলেছি, ‘আমি তো বলিনি ঠাকুরগাঁওয়ের লোক খারাপ। ভালো বলেই তো শুটিং করতে এসেছি।’ আসলে সেখানে সমস্যাটা হয়েছে কি, আমরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে গেছি। আমরাও বুঝিনি যে এত লোক হবে। কর্তৃপক্ষও বোঝেনি যে এত লোক হবে। আমাদের জায়গাটা আসলে আরও বড় হওয়া উচিত ছিল।

প্রশ্ন

এই ঘটনাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

হানিফ সংকেত : এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এখানে কিন্তু কোনো ঝগড়া নেই, মারামারি নেই। হামলা নেই। সবাই পরে খুব দুঃখ প্রকাশ করেছে। তারা এ–ও বলেছে, ‘আপনাদের ভালোবাসে, এটা তো অন্যায় না। ভালোবাসি বলেই এই ঘটনা ঘটেছে।’ এখানে কেউই মারামারি করতে আসেনি, হামলাও করতে আসেনি। এখানে এসেছিল উৎসুক জনতা। তারা এসেছে ‘ইত্যাদি’ দেখবে, আমাদের দেখবে, ‘ইত্যাদি’র শুটিং দেখবে বলে।

প্রশ্ন

ঘটনার পর ‘ইত্যাদি’র দৃশ্যধারণ কেমন ছিল? কোনো প্রভাব তো পড়েনি?

হানিফ সংকেত : সাংঘাতিক স্মুথ হয়েছে। ঘটনার পর যখন শুটিং শুরু করেছি, সেখানে থাকা সবাই বেশ আন্তরিক ছিল। আমাদের অনুষ্ঠান যখন শেষ হয়, তখনো দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ ছিল। আমরা যখন অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিই, তখন স্বাভাবিকভাবে লোকজন কমে যেতে শুরু করে। নারীরা বাসায় ফিরে যান। এর মধ্যে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান করতে পারব কি না, এ নিয়ে তারাও সন্দেহের মধ্যে ছিলেন। আমরাও তা–ই চেয়েছিলাম, না হলে তো সমস্যা। আমরা তো আর সবাইকে জায়গা দিতে পারব না।

অনুষ্ঠানটির রচনা, পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেছেন হানিফ সংকেত
প্রশ্ন

তিন যুগ ধরে ‘ইত্যাদি’ নিয়ে আপনি দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমন ঘটনা কি আর ঘটেছিল?

হানিফ সংকেত : এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা আরও হয়েছে। ময়মনসিংহের ত্রিশালে ঘটেছে, ওখানেও কয়েক লাখ লোক হয়েছিল। এরপর তো ছাদ ভাঙার উপক্রম হয়েছিল। তেঁতুলিয়ায়ও যখন শুটিং করেছি, তখন ছাদ ভেঙে পড়ে গিয়েছিল। এমন ঘটনা আমার জীবনে নতুন নয়। তবে আমরা এত কিছুর মধ্যে অনুষ্ঠান একেবারের জন্যও বন্ধ করিনি। এবার যে এক থেকে দেড় ঘণ্টা স্থগিত করেছি, এ রকম হয়নি। হট্টগোল হয়েছে, চালিয়ে গেছি। এখানে পারিনি, ভয়ে ছিলাম যে অনেক নারী দর্শক ছিলেন। শিশুরা ছিল। তাদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়। তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি অনুষ্ঠান বন্ধ রেখেছিলাম। সবাইকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করেছি, তাঁরা শুনেছেনও। এত লোক, ভয়ে কেউ কেউ কান্নাকাটি শুরু করেছিল। আমরা তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠান বন্ধ করে অনেক দর্শককে স্টেজের পেছনে নিয়ে আসি। তাদের অভয় দিই। অনেক লোক চলে গেল। সরকারি, বেসরকারি, রাজনৈতিক দলের লোকজনও ছিল অনুষ্ঠানে। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও অনেকে কাজ করেছে। ছাত্রদলের লোকজনও দেখলাম। এর বাইরে বিভিন্ন দলের লোক এসে সামাল দিল দেখলাম। দর্শকের কোনো অপরাধ আমি বলব না। এখন কেউ যদি আমাকে ভালেবাসে, তা তো অন্যায় নয়। সেই ভালোবাসা থেকে তারা এসেছে। এরপর বসতে না–পারায়, অনুষ্ঠান দেখতে না–পারায়, তাদের খারাপ লেগেছে। কে কার চেয়ে এগিয়ে বসে, এটার প্রতিযোগিতা করছিল। যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল, তা এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে থেমে গেছে। আমরাও চমৎকারভাবে অনুষ্ঠান করেছি। আমার খুব খারাপ লেগেছে, আমাদের সো কলড কিছু মিডিয়া ইউটিউব, ফেসবুকে এবং প্রথম সারির কয়েকটি মিডিয়া এমনভাবে খবর প্রকাশ করেছে, মনে হয়েছে এখানে হামলা হয়েছে, এই হয়েছে, সেই হয়েছে, মারামারি হয়েছে। কিন্তু কোনো মারামারি হয়নি। চেয়ার মানুষের গায়ে লাগছিল, মানুষ সরিয়ে দিচ্ছিল, এই যা। এগুলো তো অন্য জিনিস। আমার কাছে ন্যুইসেন্স (উপদ্রব) মনে হয়নি। হুলুস্থুল হয়েছে, হুড়োহুড়ি হয়েছে, বিশৃঙ্খলা হয়েছে।