ঝলমলে জীবন, একাকীত্ব এবং হঠাৎ এক বিকেলে বিদায়

তাজিন আহমেদ
ছবি : সংগৃহীত

কোথাও কোনো খবরে নেই। কারও কারও মনেও নেই তিনি। বিনোদন অঙ্গনের কাছের দু-একজন ছাড়া অন্যদের সঙ্গেও দেখাসাক্ষাৎ নেই। কাজকর্মে সেভাবে উপস্থিতি না থাকায় নিজেকে গুটিয়েও নিয়েছিলেন। হাসিমুখের চেনা মুখ তাজিন বেছে নিয়েছিলেন একাকিত্বের জীবন।

ঠিক ছয় বছর আগের আজকের দিনে বিকেলে হঠাৎ তাঁর আবার খবর নেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল! কেউ বাসার উদ্দেশে ছুটছেন, কেউবা হাসপাতালে। সবার একটাই উদ্দেশ্য তাজিন আহমেদকে দেখা। ততক্ষণে অবশ্য তিনি এই পৃথিবীতে নিশ্বাস নেওয়ার সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। চিরদিনের জন্য পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তের পথে। সেদিন বিকেলে তাজিনের মৃত্যুর খবরে টনক নড়ে দীর্ঘদিন ধরে খোঁজ না-নেওয়া সহকর্মীদের। অপরাধবোধে ভোগেন তাঁরা। একসময় যাঁকে ঘিরে মুখর থাকত বন্ধু-সহকর্মীরা, অভিনয় ও উপস্থাপনায় যিনি আলো ছড়িয়েছেন, সেই তাজিনের এমন অসহায় মৃত্যু নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। যার জবাব খুঁজতে গিয়ে ভুল তথ্যের গুজবে ছড়িয়েছে বিভ্রান্তিও।

তাজিন আহমেদ।

বাংলাদেশের বিনোদন অঙ্গনে নব্বইয়ের দশকে আগমন ঘটে তাজিনের। মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি উপস্থাপনার জন্য সমসাময়িকদের চেয়ে নিজেকে আলাদা করে তুলছিলেনও। ভদ্র-পরিচ্ছন্ন এই অভিনেত্রী মানুষের মনজয় করেছিলেন। ২০১৮ সালের ২২ মে মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরার বাসায় হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। ওই সময়ে আত্মীয়স্বজন কাউকে তাঁর পাশে পাওয়া যায়নি। বাসায় সঙ্গে থাকা রূপসজ্জাশিল্পী অচেতন অবস্থার তাজিনকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে আইসিইউতে থাকা অবস্থায় বিকেলে মারা যান ৪৩ বছরের এ অভিনয়শিল্পী।

মৃত্যুর সময় সেদিন আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের কাউকে পাশে না পাওয়াতে তাজিনের কোনো কোনো সহকর্মী আফসোস করে বলেছেন, ‘খারাপ লাগল এই ভেবে যে মৃত্যুর সময় তাজিনের পরিবারের কেউ পাশে ছিলেন না।’

তাজিনের মৃত্যুসংবাদ যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন জানা যায়, তাঁর মা গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন।

তাজিন আহমেদ

মৃত্যুর আগের দিন তাজিন আহমেদ তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘ভালো লাগা মুহূর্তগুলো সব সময় স্মৃতি হয়ে যায়...।’ ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সত্যি সত্যিই তিনি স্মৃতি হয়ে যান।

১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন তাজিন আহমেদ। ছোটবেলায় তাঁর বাবা কামাল উদ্দিন আহমেদ মারা যান। এরপর তাজিনকে নিয়ে পাবনায় বাবার বাড়িতে চলে যান বিধবা দিলারা জলি। সেখানে শৈশব কাটানোর পর কৈশোরে রাজধানীর আদাবরে নানার বাড়িতে চলে আসেন তাজিন। পরে ইডেন কলেজে পড়াশোনা করেন। এখানে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন তিনি।
মায়ের হাত ধরেই অভিনয়ে নাম লেখান তাজিন আহমেদ। একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও ছিল তাঁর মায়ের, যেখান থেকে নিয়মিতভাবে নাটক নির্মিত হতো। এরপর ১৯৯১ সালে বিটিভির ‘চেতনা’ নামের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপস্থাপনা শুরু করেন।

তাজিন আহমেদ

মায়ের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় টেলিভিশন নাটকে অভিনয় শুরু করেন। টিভি নাটকে অভিনয় ও উপস্থাপনা তাঁকে পরিচিতি এনে দেয়। তাঁর অভিনীত ‘আঁধারে ধবল দৃপ্তি’ অনেক বেশি প্রশংসিত হয়। নাটকের দল ‘নাট্যজন’ দিয়ে মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন। নাট্যজনের হয়ে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন তিনি। এরপর ‘আরণ্যক’ নাট্যদলের হয়ে ‘ময়ূর সিংহাসন’ নাটকে কাজ করেছিলেন। এতে তিনি বলাকা চরিত্রে অভিনয় করেন, এটি তাঁর অভিনীত সর্বশেষ মঞ্চনাটক। ১৯৯৬ সালে ‘শেষ দেখা শেষ নয়’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাজিনের টেলিভিশনে অভিনয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশ টেলিভিশনে এটি প্রচারিত হয়। এরপর তিনি অসংখ্য নাটক-টেলিছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের নাটক ‘নীল চুড়ি’তে অভিনয় করেও বেশ আলোচিত হন। তাজিন অভিনীত সর্বশেষ ধারাবাহিক নাটক ‘বিদেশী পাড়া’।

তাজিন আহমেদ

অভিনয় ও উপস্থাপনার বাইরে লেখালেখির কাজেও যুক্ত ছিলেন তাজিন। তাজিনের লেখা ও পরিচালনায় তৈরি হয় ‘যাতক’ ও ‘যোগফল’ নামের দুটি নাটক। আর অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে আছে ‘বৃদ্ধাশ্রম’, ‘অনুর একদিন’, ‘এক আকাশের তারা’, ‘হুম’, ‘সম্পর্ক’ ইত্যাদি। এনটিভিতে প্রচারিত ‌‘টিফিনের ফাঁকে’ অনুষ্ঠানে টানা ১০ বছর উপস্থাপনা করেন তিনি। একাত্তর টিভিতেও ‘একাত্তরের সকালে’ হাজির হয়েছেন তিনি।

তাজিন আহমেদ রাজনৈতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)’-এ যোগ দিয়েছিলেন। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির বিভাগীয় সম্পাদক (সাংস্কৃতিক) পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তবে জীবনের নানা টানাপোড়েনের কারণে আস্তে আস্তে মিডিয়া ছেড়ে নিবৃত্ত জীবনে চলে যান তাজিন। প্রথম ধাক্কা আসে দাম্পত্য জীবনে। ভালোবেসে নাট্যনির্মাতা এজাজ মুন্নাকে বিয়ে করলেও সেই সংসার বেশি দিন টেকেনি। এরপর গায়ক ও সংগীত পরিচালক রুমি রহমানের সঙ্গে সংসার শুরু করলেও সেটিও খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।