২৪ বছর আগের কথা। ‘নাল পিরান’ টেলিফিল্ম বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছিল। বলা যায়, এটি একটি বিখ্যাত টেলিভিশন চিত্র। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের রচনায় নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন সাইদুল আনাম টুটুল (প্রয়াত)। লেখকের ‘নিধুয়া পাথার’ উপন্যাসের গল্প অবলম্বনে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত এই নাটকটি দর্শক হৃদয়ে এখনো জড়িয়ে আছে।
সেই নাটকের দুটি চরিত্র সবুজ ও মুকুল। তারা দুই ভাই। সবুজ বড়, মুকুল ছোট। তার মায়ের নাম নালবি বেগম। বড় ভাই সবুজের বড় শখ ঈদে একটি লাল জামা পরবে। অভাব-অনটনের সংসার। পরিবারে নুন আন্তে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়ার অবস্থা। নাল পিরানের জন্য বাবার কাছে বায়না ধরে সবুজ। বড় ভাইয়ের দেখাদেখি ছোট ভাই মুকুলেরও আবদার। অভাবের সংসারে খাবার জোটে না। সম্বল একটি বকনা গরু।
সেটি হাটে বিক্রি করতে নিয়ে যায় সবুজ-মুকুলের বাবা। সন্তানের জন্য একটি টকটকে লাল জামা কিনে আনবে। কিন্তু তাদের বাবা ফিরে আসে না। বাবার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তাদের কষ্ট আরও বেড়ে যায়। রংপুরের গ্রামের ছোট্ট দুই বালক মায়ের সঙ্গে ঢাকায় চলে যায়, জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে। ঢাকায় এসে একটি স্কুলে জাকাত প্রার্থীদের ভিড়ে পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিল সবুজ।
সাইদুল আনাম টুটুল পরিচালিত ‘নাল পিরান’ নাটকটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। ঈদুল ফিতরের আগের রাতে (চাঁদ রাত) বেসরকারি টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’ নাটকটির পুনঃপ্রচার বহু বছর করেছে।
নাটকের চরিত্রে ছোট ভাই মুকুলের আসল নাম মনজুর মোসাদ্দেক উৎস, বড় ভাই সবুজের আসল নাম মামুনুর রশীদ মুকুট। ১৯৯৮ সালে নাটকটি নির্মাণের সময় মুকুলের বয়স ছিল আট বছর। দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাড়ি রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ায়। লায়ন্স স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও রংপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকায় আহ্ছানউল্লা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন। এরপর চাকরির জন্য ছোটেননি। তাঁর বাবা আবদুস সালামের রংপুরে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) রয়েছে। বাবার বয়স হওয়ায় সেই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছেন। পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে সুনামের সঙ্গে সংস্থাটি পরিচালনা করে চলেছেন। থাকেন রংপুরেই। বিয়ে করেছেন। তিন বছরের একটি সন্তান রয়েছে।
‘নাল পিরান’ নাটকের সেই ছোট্ট শিশু মুকুল (উৎস) এখন কেমন আছেন? তাঁর সঙ্গে অনেক কথা হলো।
প্রথম কথাতেই বলে উঠলেন, ‘আঙ্কেল, ভালো আছি। আমাকে এখনো অনেকেই “নাল পিরান” বলে ডাক দেয়, তখন মনটা ভরে যায়। স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে নাল পিরানের গল্প কতজনইনা বলেছে। সেই শিশুকালের ছবির শুটিংয়ের কথা আবছা আবছা মনে পড়ে।’ বিয়ের পর মুকুল তাঁর স্ত্রীসহ একসঙ্গে নাটকটি দেখেছেন।
উৎস এই জীবনে টেলিভিশনের জন্য একটিমাত্র নাটকে শিশুশিল্পী হয়ে নাটক করেই আলোচিত হয়েছেন। সেই নাটকের কথা তুলে এনে বললেন, ‘আমি নাটকের জগতে না থাকলেও ভালো আছি। এখন পর্যন্ত ভুল পথে পা বাড়াইনি। বাবার স্বপ্নের গড়ে তোলা এনজিও পরিচালনা করছি। এই এনজিওতে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আমার পরিবারের সবার জন্য দোয়া করবেন।’
নাল পিরান নাটকে মুকুলের বড় ভাই সবুজ নামের বালকটি একটা লাল জামা চেয়েছিল। রংপুরের একটি গ্রাম থেকে মায়ের সঙ্গে ঢাকায় যায় জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে। ঢাকায় গিয়ে একটি স্কুলে জাকাত প্রার্থীদের ভিড়ে পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিল সবুজ।
নাটক নির্মাণের সময় ১১ বছর বয়সী সবুজ (মুকুট) ছিল ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। সেই দিন থেকে ২৪টি বছর পেরিয়ে গেছে। এখন তাঁর বয়স ৩৫ বছর। রংপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও রংপুর সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেছেন। সবুজের বাড়ি শহরের শালবল এলাকায়। বাবার সঙ্গে থাকেন। তিনি এখন ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বাবা অসুস্থ। অভাব-কষ্ট থাকলেও মানুষের কাছে হাত পাততে হয়নি। এরপরও সংসারের হাল ধরেছেন।
নাটকের চরিত্রের বড় ভাই সবুজও ছোট ভাই মুকুলের মতো বললেন, ‘চাচ্চু, আমাকে নাল পিরান বলে সম্মোধন করে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্পের আড্ডায় বসলে নাটক নাল পিরানের গল্প বারবার উঠে আসে। এ সময় কেউ কেউ গুগলে সার্স দিয়ে নাটকটির অংশবিশেষ দেখা শুরু করে দেয়। মনোযোগ দিয়ে দেখলে চোখে পানি আসে, আর ভাবতে থাকি এই কি আমি ছিলাম। কী না অভিনয় করেছি।’ কেউ কেউ বলেন, ‘তুই যদি অভিনয় জগতে থাকতিস, ভালোই করতি।’