বন্যার্তদের সাহায্যার্থে টানা দুই দিন বন্যাদুর্গত এলাকায় ছিলেন অভিনয়শিল্পী রুকাইয়া চমক। এরই মধ্যে তিনি ঢাকায় ফিরেছেন। তবে টিমের কেউ আবার ছুটেছেন বন্যাদুর্গত এলাকায়। অভিনয়শিল্পী চমক শোনালেন সেই অভিজ্ঞতা।
‘তোমার ভয় নেই মা/ আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’—আমার কাছে এটি শুধু একটি গান নয়, জাতিগতভাবে আমাদের পরিচয়ও। আমরা প্রতিবাদী, বিপ্লবী, হার না মানা নির্ভীক যোদ্ধা। যেকোনো দুর্যোগ, হোক তা প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট, বুক পেতে হাসিমুখে তা আমরা প্রতিহত করতে পারি। আমরা যেমন রাজপথে দুহাত মেলে বুকে গুলি নিতে পারি, তেমনি বন্যার কবল থেকে দেশকে বাঁচিয়েও আনতে পারি। আমাদের ভাসিয়ে দেওয়া, উজাড় করে দেওয়া, নিশ্চিহ্ন করা এত সহজ নয়। শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত আমরা লড়তে জানি। আপাতত চোখের সামনে অনেক হাসিমুখ দেখছি, যারা সারা দিন পানির মধ্যে যুদ্ধ করে, দুটো শুকনা টোস্ট আর গুড় খেয়েও প্রাণ খুলে হাসছে—এসবকে অনুপ্রেরণা মেনে পাঁচ দিন আগে ঢাকা থেকে খুব ভোরে রওনা দিই ফেনীর পথে। বন্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাহাযার্থে ২৭ জনের একটি টিম আমাদের।
কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে বিভিন্ন জেলায় ছুটছি। যাওয়ার দিন কুমিল্লার দিকে রাস্তা ছিল প্রচণ্ড খারাপ। পথে এমনও দেখি, বৃষ্টির পানিতে যেন রাস্তার মাঝামাঝি ভাগ হয়ে গেছে! শুধু আমাদের মতো যাঁরা ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁরা উল্টো পথে চলাচল করতে পেরেছেন। কুমিল্লার পর রাস্তাটা বেশি খারাপ ছিল। এমনও শুনেছি, অনেকের ঢাকা থেকে ফেনী-নোয়াখালীর দিকে যেতে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময়ও লেগেছিল। অনেকে এক জায়গায় চার-পাঁচ ঘণ্টা বসে ছিলেন। মাইক্রোবাস আর একটি ট্রাক নিয়ে আমরা পৌঁছাই ১৩ ঘণ্টায়!
১ হাজার ২০০ পরিবারের খাবার নিয়ে আমরা গেছি। সেখানে গিয়ে দেখেছি, যাঁরা নৌকা নিয়ে গেছেন, চাইলেই ট্রাক থেকে নামাতে পারছেন না। জেলা প্রশাসকের অনুমতি সাপেক্ষে সেখানকার কর্মকর্তারা এসব ঠিক করে দিচ্ছেন। সকালে এ কারণে কার্যক্রম শুরু করতে দেরি হতো। দিনে যা–ও ত্রাণ বিতরণ করা যেত, রাতের বেলা পরিস্থিতি হতো কঠিন। ঝুঁকি ছিল; কারণ, কোথাও বিদ্যুৎ নেই। স্বেচ্ছাসেবী আছে। তারপরও চারপাশ অন্ধকার। শুরুতে আমরা ফেনী সদরে ছিলাম। এরপর আমরা লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও পাগলার চরে যাই।
ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মনে হয়েছে, এ সময় মানুষ ভয়াবহভাবে গুজবও ছড়াচ্ছে। নানাজন নানা কথা বলছে। কেউ বলছে মৃত নগরী! বিষয়টা মোটেও তা নয়। বলার চেষ্টাও করেছি, কেউ যেন গুজব না ছড়ায়। কারণ, যাঁদের পরিবারের সদস্যরা দেশের বাইরে আছেন, তাঁদের মানসিক অবস্থা একবার ভাবা উচিত। ওখানকার অনেকে প্রবাসে থাকেন। তাঁরা এমন খবরে আতঙ্কিত। অনেকে আমাদের মেসেজ পাঠিয়েছেন। কারণ, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে। ফেনী সদর কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরের অবস্থা ভালো ছিল না। এখনো মানুষজন সেখানে ঝুঁকিতে আছেন।
আমি যেখানেই গেছি, ওখানকার মানুষের মধ্যে দৃঢ় মনোবল দেখেছি। তাঁদের মনে হয়েছে যোদ্ধা। তবে যাঁদের পরিবার একটু বেশি দূরে, তাঁরা কান্নাকাটি করছিলেন, কষ্টে আছেন—এমনটাও বলছিলেন। হয়তো আমরা দুর্গম এলাকায় যাইনি বলে এমনটা দেখিনি। তবে ত্রাণ দিতে যেখানে গেছি, কেউ কেউ কান্নাকাটি করছিলেন। বলছিলেন, এত অল্প ত্রাণে কীভাবে কী হবে! এক দিনে তো খাবার শেষ হয়ে যাবে! আমরাও যে পরিমাণ খাবার দিয়েছি, দুই দিনের বেশি যাবে না। ওসব এলাকায় তাই বেশি বেশি ত্রাণ দেওয়া উচিত। অনেক দিন ধরে পানিবন্দী মানুষ।
পরশু আমরা ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরে ত্রাণ বিতরণ করে ঢাকায় ফিরেছি। বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে টানা দুই দিন কাজ করে জ্বরে পড়েছি। এর মধ্যে আমাদের আরও দুটি টিম দুর্গত এলাকায় গেছে। সুস্থ হয়েই আমরা একটা মেডিকেল টিম নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি।