এক যুগের বেশি সময়ের অভিনয় ক্যারিয়ার রাশেদ মামুন অপুর। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি আলোচিত সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন এই অভিনেতা। চলচ্চিত্রেও সফল তিনি। অভিনয়ের ব্যস্ততার পাশাপাশি এই অভিনেতাকে নির্মাণেও দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে সিনেমা ও ওয়েবের কাজেই তাঁর ব্যস্ততা বেশি। আজ গুণী এই অভিনেতার জন্মদিন। ১৯৭৯ সালের ১৩ জুলাই রাজশাহীর মিশন হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। জন্মদিনে এ শিল্পীর সম্পর্কে আবারও কিছু তথ্য জেনে নিই।
এটা হয়তো অনেকেরই জানা, প্রথম ‘সিটিবাস’ নাটক দিয়ে দর্শকের কাছে পরিচিতি পান এই অভিনেতা। নাটকটি প্রচারিত হওয়ার পর ‘মামুর বেটা নাকি’, ‘আমি তোতা মিয়া’, ‘যবের ব্যাপার’, ‘ছোট ভাইকে বাচতেই পারছেন না’সহ বেশ কিছু সংলাপ দর্শকদের মুখে মুখে ঘুরেছে অনেক দিন। বললে বাড়াবাড়ি হবে না, ছোট পর্দায় অভিনেতা রাশেদ মামুন অপুর পরিচিতি পাওয়ায় বেশি ভূমিকা রয়েছে রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষার।
প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে এই অভিনেতা জানান, প্রথম থেকেই তাঁর ইচ্ছা ছিল একটু গুরুগম্ভীর বা নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করা। কিন্তু শুরুতে তিনি জনপ্রিয়তা পান কৌতুকাভিনয়ের জন্য। প্রতিটি নাটকেই তাঁকে কমেডি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নির্মাতারা ডাকতেন। সেসব চরিত্রে অভিনয় করলেও ভেতরে ভেতরে তিনি গুরুতর নেতিবাচক চরিত্রগুলোর প্রতি আগ্রহী ছিলেন।
এই অভিনেতা জানান, প্রথম সাত বছর ধরে তিনি যেসব চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সেগুলোর বেশির ভাগই তাঁকে ততটা টানেনি। যেমন করোনার আগে টানা চার মাস তিনি মাসে ২৫ দিন শুটিং করেছেন। কিন্তু একটা চরিত্রও টানেনি তাঁকে। শুধু টাকার জন্যই কাজ করে গেছেন।
এই অভিনেতা বলেন, ‘আমি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছি, চাইলে আইন নিয়েই থাকতে পারতাম। পরে আমি একটি এনজিওতে চাকরি করেছি। কিন্তু অভিনয়ের জন্য বিদেশি সংস্থার চাকরি ছেড়েছি। একটা সময়ে এসে অভিনয় আমাকে হতাশ করে ফেলেছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম, যদি টাকার জন্যই অভিনয় করি, তাহলে চাকরি করলে সমস্যা কী? করোনার বিধিনিষেধের সময় টানা ৭০টি সিনেমা দেখার পর রায়হান রাফী আমাকে একটি কাজের জন্য ডাকেন। সেখানকার নেতিবাচক চরিত্রটি আমার পছন্দ হয়। ছবিটি মুক্তির পর দেখা গেল, দর্শকও সেটি পছন্দ করেছেন। পরে “নবাব এলএলবি” সিনেমায় অভিনয় করার পর আমার সবকিছু বদলে যায়।’
‘দহন’ সিনেমায় ডোমের চরিত্রে অভিনয় করেন অপু। এ ছবির একটি দৃশ্যে অপুকে দেখে ভালো লেগে যায় পরিচালক রায়হান রাফীর। তাঁকে আবার গুরুগম্ভীর চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন রাপী। এর ভেতরই ‘নবাব এলএলবি’ মুক্তি পায়।
পরে ‘জানোয়ার’ ওয়েব সিরিজ দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। এখানে প্রধান খলনায়ক হিসেবে অভিনয় করেন। এই সিনেমা তাঁকে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের পথে একধাপ এগিয়ে দেয়। মামুন বলেন, ‘ক্যারিয়ারে দীর্ঘদিন ধরে যেসব চরিত্রের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেগুলোই আমার কাছে ধরা দিতে লাগল। আমি রাত–দিন একাকার করে পরিশ্রম করেছি। ভেবেছি আমাকে খল চরিত্রে টিকে থাকতে হবে। কারণ, তখন হাতে যেসব নাটকের কাজ ছিল, সেগুলোয় অভিনয়ের কোনো সুযোগ ছিল না। নিজের কাছে নিজের পরীক্ষার আগেই আমি ফেল করছিলাম। একরকম জোর করেই সেসব কাজ করতাম। তবে ভেতরে ভেতরে নিজের সঙ্গেই গুরুগম্ভীর অভিনয়টা চালিয়ে যেতাম। সেটাই এখন কাজে দিচ্ছে। অভিনয় নিয়ে আমার নিজের সঙ্গে প্রচুর জেদ ছিল। এখন নিজের মতো করে কাজ করে যেতে চাই।’
অবশ্য ঢাকায় এসেছিলেন নির্মাতা হতে। অভিনেতা হয়ে গেলেন কীভাবে? এ প্রসঙ্গে রাশেদ মামুন বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমি থিয়েটার করেছি। ঢাকায় এসে গিয়াস উদ্দীন সেলিমের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পর নিজে চারটি নাটক পরিচালনা করি। পরে আমার বন্ধু পরিচালক নোমান রবিনের “সিটিবাস” নাটকে “তোতা মিয়া” চরিত্রে অভিনয় করি। চরিত্রটি দর্শক পছন্দ করে ফেলেন। আমার তখন থেকেই শুরু।’
প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানান, মা–বাবা দুজনই ছিলেন ব্যাংকার। তবে তাঁরা সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। ছোটবেলায় মামুনের ঘুম ভাঙত বাবার আবৃত্তি এবং মা ও বোনের গানের রেওয়াজ শুনে। ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মহড়া হতো বাড়িতে। পরিবেশই তাঁকে বিনোদন জগতে টেনে এনেছে।
অভিনয় করতে এসে পরিবারের সহযোগিতা পেয়েছেন?
জানতে চাইলে মামুন বলেন, ‘লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কী করতে চাই? আমি বলেছিলাম, নির্মাতা হতে চাই। বাবা তখনই আমাকে ঢাকায় আসার ব্যবস্থা করে দেন। আমার পেশার প্রতি বাবার শ্রদ্ধা ছিল। অভিনয়ের জন্য আমি বাবাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারিনি, কিন্তু বাবার সম্মান সেদিন রেখেছিলাম।’
সেদিনের বেদনার স্মৃতিচারণা করেন তিনি, ‘সেবার বাবার বড় রকম একটা হার্ট অ্যাটাক হয়। তিনি হাসপাতালে ছিলেন। বাসার সবাইকে নিষেধ করেছিলেন যেন আমাকে জানানো না হয়। বাবা মনে করতেন, আমার কাজের সমস্যা হবে। তিন দিন পর কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার পর সেদিনই তাঁর আবার হার্ট অ্যাটাক হয়। তখন পরিবার থেকে আমাকে সব জানানো হয়। আমি শুটিংয়ে ছিলাম। সবাই তখনই আমাকে বাড়িতে যেতে বলেন। আমি একটু দেরি করেছিলাম। জরুরি কয়েকটা দৃশ্যের শুটিং করে রাজশাহীতে গিয়ে শুনি, বাবা এক ঘণ্টা আগে মারা গেছেন।’
বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী মামুন। ‘নবাব এলএলবি’ ছবিতে শাকিব খানের বিপরীতে তিনি খলনায়ক। তা ছাড়া ‘বর্ডার’, ‘পরান’, ‘মিশন এক্সট্রিম’, ‘গাঙচিল’ ছবিতেও খলনায়ক। অভিনয় করেছেন ‘দামাল’, ‘প্রহেলিকা’র মতো আলোচিত সিনেমায়।
সফল এ অভিনেতার বিনোদন জগতে পথচলার শুরুটা মসৃণ ছিল না। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘দেখা গেল নির্মাতা বলছেন, আমিই প্রধান চরিত্রের অভিনেতা। শুটিংয়ে গিয়ে শুনি, নায়িকা আমার বিপরীতে কাজ করতে চাচ্ছেন না। অনেক সময় দেখেছি, কিছু সহশিল্পী আমাকে ঠিকমতো কাজ করতে দেননি। অনেক সময় আমার সংলাপ ও দৃশ্য কেটে ফেলা হতো। অনেক সময় চরিত্র কমিয়ে ছোট করে ফেলা হতো। এমনও হয়েছে, সহশিল্পী আমাকে গালাগালিও দিয়েছেন। আমার পাশ থেকে উঠে চলে গেছেন। এমন দিনও গেছে, কষ্ট পেয়ে বাথরুমে গিয়ে কেঁদেছি। আসলে সিরিয়াসলি অভিনয় করার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু এসব বাধাই আমাকে অভিনেতা বানিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সারা জীবন অভিনয়ের চেষ্টাই করে যাব।’
(এ লেখার তথ্য প্রথম আলোয় প্রকাশিত রাশেদ মামুন অপুর বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে নেওয়া)