ওটিটির উত্থান নিয়ে যা ভাবছে টিভিগুলো

সাম্প্রিতক সময়ে জনপ্রিয় সিরিজ ‘কারাগার’-এর একটি দৃশ্যে
ছবি : সংগৃহীত

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ওয়েব সিরিজ দেশের পাশাপাশি ভারতেও সাড়া ফেলেছে। ইউটিউবে এসব কনটেন্টের ট্রেলারের নিচে অনেক দর্শক মন্তব্য করেছেন, দেশের টিভি চ্যানেলগুলো তাঁদের প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ করতে পারছিল না, ওয়েবের কনটেন্টে তাঁরা টিভির চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্য পেয়েছেন। তবে টিভি কর্তৃপক্ষগুলো বলছে, ওটিটির সঙ্গে তাদের মেলালে হবে না। তারা নিজেদের মতো করে দর্শকচাহিদা পূরণের চেষ্টা করে যাচ্ছে।


গত ২ মাসে ২টি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ও ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ৬০টি নতুন কনটেন্টের ঘোষণা দিয়েছে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ১০টি নতুন কনটেন্ট নিয়ে আসার কথা জানিয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বিঞ্জ। এর কয়েক দিন পরেই পশ্চিমবঙ্গের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই তাদের নতুন সিজনে ২৫টি কনটেন্টের প্রচারের ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে আছে বেশ কয়েকটি বাংলাদেশি ওয়েব সিরিজও। যার একটি অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘বোধ’ মুক্তি পাবে আগামীকাল।

অমিতাভ রেজা চৌধুরীর সিরিজ ‘বোধ’ –এর একটি দৃশ্য

গত ১৫ অক্টোবর চলচ্চিত্রবিষয়ক অনলাইন গণমাধ্যম ভ্যারাইটি জানায়, বাংলাদেশি ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকিতে নতুন ২৫টি কনটেন্ট মুক্তি পাবে। এসব কনটেন্টে পরিচালক হিসেবে দেখা যাবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, আবু শাহেদ ইমন, আশফাক নিপুন, সঞ্জয় সমাদ্দার, গৌতম কৈরী, মিজানুর রহমান আরিয়ান, শিহাব শাহীনসহ অনেককেই।

পরিচালকের মধ্যে বেশ কয়েকজন আছেন, যাঁরা নিয়মিত টিভি নাটক বানাতেন। এখন অনিয়মিত। এর আগে ওটিটির ব্যস্ততায় অনেক অভিনয়শিল্পী টিভিতে কাজ কমিয়ে দিয়েছেন বা বাদ দিয়েছেন।


অভিনয়শিল্পী থেকে পরিচালক—সবাই যদি কাজ কমিয়ে দেন, টিভি চ্যানেলের জনপ্রিয়তায় কতটা প্রভাব পড়বে? দেশের কয়েকটি প্রথম সারির টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধানেরা মনে করছেন, ওটিটির সঙ্গে তাঁদের কোনো প্রতিযোগিতা নেই। দুটি দুই ধরনের মাধ্যম।

‘শহরবাস’ নাটকের একটি দৃশ্য

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান আলফ্রেড খোকন বলেন, ‘টেলিভিশন হলো জাতীয় গণমাধ্যম। সেখানে নানা ধরনের অনুষ্ঠান থাকে। ওটিটিতে মূলত ওয়েব সিরিজনির্ভর। টিভিকে সরকারের নিয়ম অনুযায়ী চলতে হয়। এ ছাড়া টিভি তো পারিবারিক গণমাধ্যম, যা বাড়ির সবাই একসঙ্গে দেখে। আমাদের একটা দায়বদ্ধতাও থাকে।’


গত এক বছরে ওটিটির বেশ কয়েকটি সিরিজ আলোচিত হয়েছে। তখন ফেসবুকের বিভিন্ন চলচ্চিত্রবিষয়ক গ্রুপে অনেক দর্শকই সিরিজগুলো নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তবে ওটিটির উত্থানে টিভির অনুষ্ঠান আড়ালে পড়ে গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহুল আলোচিত—এই ধারণার সঙ্গে একমত নন আলফ্রেড খোকন।

চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠান বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আমীরুল ইসলামও তুলে ধরেন নিজের বিশ্লেষণ। তিনি বললেন, নতুন কোনো মাধ্যম এলে পুরোনো মাধ্যম চলে যাবে কি না, সেটা পুরোনো বিতর্ক। যেমনটা টিভি আবিষ্কারের পর মনে করা হয়েছিল, সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাবে। তাঁর মতে, ওটিটি কনটেন্ট অনেক জনপ্রিয় হতে পারে, কিন্তু পরিবারের সবাই মিলে দেখার যে আনন্দ, সেটা এ মাধ্যমে নেই।


তবে আমীরুল ইসলাম মনে করেন, টিভি চ্যানেলগুলোকে তাদের অনুষ্ঠানের বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে, আরও জনগণের কাছে যেতে হবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ওটিটিতে কিন্তু সেভাবে খেলা দেখার সুযোগ নেই, টিভির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সামনে হয়তো এমন অনেক অনুষ্ঠান মানুষ দেখবে, যেটা কেবল টিভিতেই প্রচারিত হবে।

‘সিন্ডিকেট’ –এ অভিনয় করেন আফরান নিশো

চলতি বছর দেশের টিভি নাটকগুলোতে বেশ কয়েকজন বড় তারকার উপস্থিতি কম দেখা গেছে। বিশেষ করে গত ঈদে ওয়েব সিরিজ ‘সিন্ডিকেট’ ও ‘কাইজার’ সিরিজে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা আফরান নিশোকে সেভাবে টিভিতে পাওয়া যায়নি। বড় তারকাদের অনুপস্থিতির কতটা প্রভাব পড়েছে টিভি চ্যানেলগুলোতে? বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান তারেক আখন্দ স্বীকার করলেন, কিছুটা প্রভাব পড়েছে। তবে তিনি মনে করেন, ভালো গল্প হলে বড় তারকারাও নিশ্চিতভাবেই টিভিতেও কাজ করতে আগ্রহী হবেন।


এনটিভির আলফ্রেড খোকন বলেন, দু-একজন ছাড়া বেশির ভাগ বড় তারকাই টিভিতে কাজ করছেন। প্রতিবছরই ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো ঘটা করে তাদের পরবর্তী সিজনের কনটেন্টগুলোর ঘোষণা দেয়, মুক্তির আগে ব্যাপক প্রচার করে। টিভি চ্যানেলগুলো নিজেদের অনুষ্ঠানের খবর দর্শকের কাছে কতটা পৌঁছে দিতে পারছে, এ বিষয়ে আলফ্রেড খোকন মনে করেন, তাঁর চ্যানেল যথেষ্ট ভালো কনটেন্ট প্রচার করছে। সেগুলোর আলাদা করে প্রচারণার দরকার আছে বলে মনে করেন না তিনি। উদাহরণ দিয়ে তিনি তাঁদের চ্যানেলে প্রচারিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত নাটক ‘মা বাবা ভাই বোন’ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘শহরবাস’-এর কথা বলেন।

বাংলাভিশনের তারেক আখন্দ মনে করেন, ওটিটি ও টিভি চ্যানেলগুলোর প্রচারের ক্ষেত্রে ভিন্নতা আছে। তিনি বলেন, ‘শিল্পীরা ওটিটির হয়ে প্রচার করেন, এ ছাড়া আরও নানাভাবে প্ল্যাটফর্মগুলো তাঁদের কনটেন্টের প্রচার করেন। টিভির ক্ষেত্রে আমরাও কিন্তু ডিজিটালি কাজ করি। ইউটিউব বা ফেসবুক দিয়ে প্রচার ও আয় দুটিই হয়। আমাদের কোনো নাটকের প্রমো যদি বিকেল ৫টা থেকে রাত ১২টার মধ্যে ৩ বার যায়, তাহলে সেটা কমবেশি ২০ লাখ দর্শকের কাছে পৌঁছায়। এটাও আমাদের প্রচারেরই অংশ।’


দেশের প্রথম সারির তিন অনুষ্ঠানের বিভাগের প্রধানই ওটিটির উত্থানকে স্বাগত জানিয়েছেন। ওটিটি যে ভবিষ্যতে আরও বড় জায়গা নেবে, সেটাও স্বীকার করছেন কেউ কেউ। তাঁরা মনে করছেন, টাকা খরচ করে দেখতে হয় বলে ওটিটির গ্রাহকসংখ্যা এখনো কম। তাই টিভির সঙ্গে ওটিটির কোনো তুলনাই চলে না।