প্রথম আলো পত্রিকার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের আবেগ ও ভালোবাসা। ২৪ বছরে প্রথম আলো নিয়ে একটু একটু করে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর মনে জমে উঠেছে নানা স্মৃতির ভান্ডার। সেই স্মৃতি আওড়াতে গিয়ে কাঁদলেন ‘মনপুরা’, ‘হাওয়া’, ‘কারাগার’খ্যাত এই অভিনেতা। আজ রোববার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় প্রথম আলোর কর্মী উৎসব। আয়োজনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চঞ্চল চৌধুরী। প্রথম আলোর পাঠক হিসেবে প্রত্যাশার কথা বলতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন দেশের জনপ্রিয় এই অভিনেতা।
ছাত্রজীবন থেকে প্রথম আলোর নিয়মিত পাঠক চঞ্চল চৌধুরী। প্রথম আলোর পছন্দের সংখ্যাগুলো নিয়মিত সংরক্ষণ করতেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী চঞ্চলকে জীবনের নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অর্থ দিয়ে পত্রিকা কেনা ছিল তাঁর কাছে বিলাসিতা। বন্ধুর বাসা থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করতেন। চঞ্চল বলেন, ‘প্রথম আলোর সঙ্গে শুধুই যে আমার অথবা বাংলাদেশের পাঠকশ্রেণির খুব সাধারণ পত্রিকা এবং পাঠকের সম্পর্ক, তা নয়; আমার মতো হয়তো অনেকের আবেগের সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, আবেগে আক্রান্ত হওয়ার মতো অনেক আয়োজন প্রথম আলো করে। প্রায়ই প্রথম আলোর এসব আয়োজনে আমি অংশগ্রহণ করি এবং আবেগে আপ্লুত হই।’
চঞ্চল একসময় প্রথম আলোয় প্রকাশিত কার্টুন সংগ্রহ করতেন। তখন চঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিশির ভট্টাচার্য্য প্রথম আলোয় নিয়মিত কার্টুন আঁকতেন। প্রিয় শিক্ষকের শিক্ষণীয় সেই কার্টুনগুলো প্রথম আলোর পাতা থেকে সংগ্রহ করতেন।
এখনো চঞ্চলের বাসায় সেগুলো যত্নে রয়েছে। চঞ্চল বলেন, ‘আমার সংগ্রহে থাকা কার্টুনগুলোর কথা শিশির স্যারকে বলেছিলাম। সংগৃহীত পাঁচ শতাধিক কার্টুন প্যাকেটে করে একদিন শিশির স্যারকে দেখিয়েছিলাম। সেদিন স্যার আমাকে কার্টুনের একটি বই গিফট করেছিলেন।’ প্রথম আলোকে নিয়ে চঞ্চলের আবেগের কথাগুলো দর্শকসারিতে থাকা সাংবাদিকেরা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। একসময় সবাই জোর করতালি দিয়ে চঞ্চলকে শুভকামনা জানান।
পাবনা জেলার অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম চঞ্চলের, যে গ্রামে একসময় বিদ্যুৎ ছিল না। পত্রিকা পৌঁছাত না। হঠাৎ একদিন চঞ্চল জানতে পারেন পাবনা সদরের সেই অজপাড়াগাঁয়ের নাজিরগঞ্জ বাজারে পত্রিকা পৌঁছানোর কথা। চঞ্চল তখন ঢাকায়। গ্রামের শুভাকাঙ্ক্ষীদের মাধ্যমের জানতে পারেন, প্রথম আলোই তাঁদের বাজারে পৌঁছায়। গ্রামের মানুষ দলবদ্ধ হয়ে চঞ্চলের খবর পড়তেন। গাঁয়ের ‘ছাওয়াল’ বলে কথা। সেই পত্রিকা একসময় পৌঁছে যায় চঞ্চলের মা-বাবার কাছে। তখন ছেলে দেশে নাম করছেন। নাটক-সিনেমায় তাঁর অভিনয়ের সাফল্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বাবার কাছে পত্রিকা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন চঞ্চল। হোক সেটা দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা কিংবা পরদিন। অপেক্ষা করতেন তাঁর বাবা। চঞ্চলের বাবা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। গভীর মনোযোগে পুরো পত্রিকা পড়েন। এর মধ্যে প্রায়ই তাঁর শিক্ষক বাবা ছেলের খবরের অংশটুকু নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠতেন। স্কচটেপ দিয়ে বাড়ির দেয়ালে লাগিয়ে রাখতেন ছেলের খবরের পেপার কাটিং। চঞ্চলের বাবা এখন বৃদ্ধ। পত্রিকা পড়েন, কিন্তু পত্রিকার ছেলের খবরের অংশটুকু এখন আর স্কচটেপ দিয়ে দেয়ালে লাগানোর শক্তি শরীরে নেই। ছেলের প্রিয় স্মৃতিগুলো কখনো দেয়াল থেকে খসে পড়লেও সেগুলো সাঁটিয়ে দিতে পারেন না। সে কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন চঞ্চল। কথা ভার হয়ে আসে।
কিছুটা জড়তা নিয়ে চঞ্চল বলেন, ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছি, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি, নাটক-সিনেমা করছি। আমি যা-ই করতাম, সেগুলোর খবর প্রকাশিত হতো। সেই খবরের কাটিং বাবা ঘরের দেয়ালজুড়ে লাগিয়ে রাখত। কষ্টটা আমার এখানেই, বাবার বয়স এখন অনেক বেশি। বাবা আর প্রথম আলো কেটে আমার ইন্টারভিউটা লাগাতে পারে না!’ শেষ বাক্যটি কান্নাজড়িত কণ্ঠ বলেন এই দাপুটে অভিনেতা। একসময় নিজেকে সামলে নিয়ে প্রথম আলোর জন্য শুভকামনা জানিয়ে আসন গ্রহণ করেন। সবশেষে সমাগতদের অনুরোধে শোনান ‘হাওয়া’ সিনেমা জনপ্রিয় গান ‘সাদা সাদা কালা কালা’।